প্রতীম দে
আগে কয়েকটা প্রশ্ন সামনে রাখা উচিত
সরকার কেন প্রথম থেকেই মেসির কলকাতা সফর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখলো না? কেন কর্পোরেট সংস্থাদের হাতে এই গোটা বিষয় আয়োজনের ছাড়লো রাজ্য সরকার?
হাজার হাজার টাকা খরচ করে যারা টিকিট কেটে এলেন মেসিকে দেখতে তারা কেন দেখতে পেলেন না? কেন মেসিকে ঘিরে থাকলেন অরূপ বিশ্বাস সহ বাকিরা?
এবার আসা যাক আসল কথায়,
কলকাতায় এসেছিলেন পেলে, মারাদোনা, অলিভার কান। কিন্তু কখনও এই বিশৃঙ্খলা দেখেনি কলকাতা। ৬ ডিসেম্বর ২০০৮, ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর উদ্যোগে কলকাতায় আসেন আর্জেন্টিনার তাকরা দিয়াগো মারাদোনা। সুশৃঙ্খল ভাবে সেদিন মারাদোনাকে চোখের সামনে দেখেছিলেন দর্শকরা। গোটা মাঠ ঘুরে ছিলেন মারাদোনা। তার শট করা ফুটবলও অনেকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন, হয়তো তাদের কাছে এখনও সেই বল গুলো রয়েছে। তারপর দিন মোহনবাগান মাঠে গিয়েছিলেন মারাদোনা সেখানেও কোন সমস্যা হয়নি। দেখা করেছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সাথে। কারা দায়িত্বে ছিলেন তখন? রাজ্য প্রশাসন। কলকাতা বার বার স্বাগত জানিয়েছে ক্রীড়া এবং রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্যদের। কখনও কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু আজ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে যেই ঘটনা ঘটলো তাতে গোটা বিশ্বের কাছে মুখ পুড়লো ভারতের। কয়েক ঘন্টার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন মেসি। সাথে করে যেই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি যাচ্ছেন তা কলকাতা জন্য ভালো নয়।
মারাদোনা যখন কলকাতায় আসেন ২০০৮ সালে তখন রাতে বিমানবন্দরে মানুষের আবেগ মুগ্ধ করেছিল মারাদোনাকে। সেই সময় শাসক দলের কোন নেতাকে দেখা যায়নি নিজের এলাকায় মারাদোনার ৭০ ফুটের মূর্তি বানিয়ে নাম কেনার। এবার দেখা গিয়েছে। সুজিত বসু তার ক্লাব শ্রীভূমির সামনে মেসির মূর্তি বসিয়েছেন। অরূপ থেকে সুজিত সবাই ব্যাস্ত ছিল নিজেদের তুলে ধরতে, ক্ষমতা দেখাতে। মানুষের আবেগের কথাকে তারা মাথাতেই আনেনি।
পেলে যখন তার কসমস দল নিয়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলেছিল তখনও কোন বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটেনি।
মারাদোনা যখন কলকাতায় এসেছিলেন তখন যুবভারতীতে মঞ্চ করা হয়েছিল সেখানে একা ক্রীড়া মন্ত্রী ছিলেন। তাকে ঘিরে ছিলেন না কোন আমলা বা অন্য কেউ। মারাদোনা বক্তব্য রেখেছিলেন, তার তর্জামা করা হয়েছিল বাংলায়। গোটা যুবভারতী তা শুনেছিল। সেই সময় সরকার এবং প্রশাসন দেখিয়ে দিয়েছিল সরকার চাইলে শৃঙ্খলা মেনে কি ভাবে মানুষের সামনে তার প্রিয় তারকাকে আনতে পারে। সেদিন কোন দর্শকের গায়ে পুলিশের লাঠি পড়েনি, আজ পড়েছে।
২০০৮ সালে বামফ্রন্ট সরকারের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের কাছে মারাদোনাকে নিয়ে আসা। মাত্র ৫০ টাকা দিয়ে যুবভারতীতে গিয়ে মারাদোনাকে দেখেছিলেন সাধারণ মানুষ। শীতের কলকাতায় তৈরি হয়েছিল এক আলাদা উন্মাদোনা। এবার কিন্তু পরিস্থিতি প্রথম থেকেই অনেকটা আলাদা। ডালমিয়া সিমেন্টের মতো বিভিন্ন সংস্থার হাতে এই গোটা অনুষ্ঠানের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল। কর্পোরেট সংস্থা সব সময় নিজের মুনাফার দিকেই নজর রাখবে এটাই স্বাভাবিক। মেসিকে সামনে রেখে বিপুল টাকা তোলাই তাদের লক্ষ। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ৫০ টাকা খরচ করে যেই কলকাতা মারাদোনাকে দেখেছিল সেই কলকাতা মেসি, মার্টিনেজকে দেখার জন্য খরচ করলো ১৫ হাজার টাকা। ছয় হাজার টাকার টিকিটও ছিল। অনেকে কষ্ট করে টাকা জমিয়ে একবারের জন্য দেখতে এসেছিলেন মেসিকে। কিন্তু সেই আশা তাদের পুরণ হয়নি। মাঠের বাইরে যেই জলের বোতল ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, ভিতরে তার দাম ১৫০ টাকা।
মাঠে যখন মেসি প্রথম ঢোকেন তখন প্রথম থেকেই তাকে ঘিরে ছিলেন বেশ কয়েকজন। ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। একে বারে মেসির পাশে ছিলেন তিনি। দর্শকদের অভিযোগ এই মানুষদের মাঝে তারা তাদের প্রিয় তারকাকে দেখতে পাননি। বিক্ষুব্ধ এক দর্শন বলেন, ‘একজনকেই শুধুমাত্র দেখতে পেয়েছি। সে হলো অরূপ বিশ্বাস।’
মেসিকে দেখতে না পেয়ে মাঠেই ক্ষোভে ফেট পড়েন দর্শকরা। মাঠে উড়ে আসতে থাকে জলের বোতল। যুবভারতীর বাকেট চেয়ার তুলে মাঠে ছুঁড়তে শুরু করেন দর্শকরা। তারপর মাঠের ব্যারিকেড টোপকে মাঠে ঢুকে পড়েন দর্শকরা। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় ভিআইপিদের জন্য রাখা সোফায় এবং সামিয়ানায়।
মেসির এই কলকাতা সফরে যুবভারতীতে মোহনবাগান এবং ডায়মন্ড হারবারের মধ্যে একটা প্রদর্শনী ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল সেটাও বাতিল হয়েছে।
মাঠের পরিস্থিতি এমন হয় যে র্যাফ নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে প্রশাসন। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়া স্টেডিয়াম মুখো হননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং শাহরুখ খান। ক্ষুব্ধ দর্শকরা অরূপ বিশ্বাস এবং আয়োজকদের গ্রেপ্তারির দাবি জানায়। যুবভারতীর এই ঘটনার দায় নিজের দিক থেকে প্রথমেই ঠেলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি এক্সহ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘এই ঘটনায় বিশদে অনুসন্ধান করবে কমিটি। যাঁরা দায়ী, তাদের চিহ্নিত করা হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সুপারিশ করবে।’
Comments :0