Bolpur rally

কুরবানি-পুজোর বিভেদ মুছে রুটি-রুজির দাবিতে পদযাত্রা

জেলা


১৫ নভেম্বর— ফুটবল মাঠই সীমারেখা। ওপারে দান্দুপুর, যা ঝাড়খণ্ডে। আর এপারে কাংলাপাহাড়ি। আদিবাসী নিবিড় বাংলার গ্রাম। ইউক্যালিপটাসের অপরূপ বিন্যাসে ঘেরা গ্রামের দিকে তাকালেই জুড়িয়ে যায় চোখ।
আচমকাই এই কাংলাপাহাড়ি এসে গিয়েছিল আলোচনায়। এক অনভিপ্রেত ঘটনাকে ঘিরে। গ্রামে তৈরি হয়েছিল 'সংঘাতে'র বাতাবরণ। কারণ পাশের গ্রাম হচ্ছে লক্ষ্মীনারায়ণপুর। সংখ্যালঘু মানুষের বসবাস বেশি সেখানে। দুর্গাপুজো এবং কুরবানি হবে কি হবে না— তাই ছিল এই 'সংঘাতে'র নেপথ্যে। গত কয়েক বছর ধরে যা জিইয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে নানা ভাবে। বারেবারেই দেওয়া হয়েছে নানা উসকানি। 
আজ কী হাল সেই গ্রামের?  
সূর্যের দেখা মিলতেই কাংলাপাহাড়ির ফুটবল গ্রাউন্ডের সিমেন্টের বসার জায়গা মুড়ে ফেলা হয়েছিল সাদা ধুতিতে। তার উপর বসানো হয়েছিল বীরসা মুন্ডার বড় ছবি। ধামসা মাদল নাকাড়ার বোলে উঠেছিল আওয়াজ। তার তালে তালে একে একে বিপ্লবী বীরসার প্রতিকৃতিতে মালা দিয়েছেন উজির মুর্মু থেকে শিস মহম্মদ, শান্তিলতা বাসকি থেকে ইয়াসিন সেখরা। বীর বিপ্লবীর লড়াই, ত্যাগকে স্মরণ করে আদিবাসী বাদ্যযন্ত্রে আওয়াজ তুলেই এরপর এগিয়েছে পদযাত্রা। তাতে শামিল হয়েছিলেন দলিত শোষণ মুক্তি মঞ্চের সারা ভারতের নেতা রামচন্দ্র ডোম, সঞ্জীব বর্মণ, সনৎ প্রামাণিকরা।   
রুটি রুজিতে বিধ্বস্ত নয় এমন একটি বাড়িও পাওয়া যাবে না তল্লাটে। তাই কাংলাপাহাড়ির অন্তত পঞ্চাশ জন আর লক্ষ্মীনারায়ণপুরের প্রায় তিনশো জন— কেউ মুম্বাই তো কেউ দিল্লি, কেউ বা চেন্নাইয়ে আছেন। কাজ করছেন সেখানে। এই তল্লাটে কাজ নেই।
সাইকেলে করে ঘুরে ঘুরে বেলুন বেচেই দিন চালান লক্ষ্মীনারায়ণপুরের জিয়ারুল। তিনিও সাইকেল ছেড়ে হেঁটেছেন। বেলুন বিক্রি বন্ধ রেখে পদযাত্রা করেছেন। বড় ছেলে কাজ করেন মুম্বাইয়ে। ছোট ছেলে স্নাতক। টিউশনি পড়িয়ে চলে। সেই জিয়ারুলের কথায়, ‘‘আমার আর রোজগার কত বলুন? বড় ছেলের পাঠানো টাকাতেই চলে দিন। ছোট ছেলেটা জুনিয়র পুলিশে পেয়েছিল ২০১৩ সালে। কিন্তু দশ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছিল। ছোট ছেলে বলে দিয়েছিল, টাকা দিয়ে পড়ি নাই। ঘুষ দিয়ে চাকরিও লিব না। খুব চেষ্টা করছে একটা চাকরির।’’
রুক্ষ, শুষ্ক জনপদ। চাষের ভরসা একমাত্র বৃষ্টি। এবছর তারও দেখা মেলেনি। চারিদিকে বিঘার পর বিঘা জমি পতিত হয়ে পড়ে রয়েছে। সেই দুশ্চিন্তার কথাই শুনিয়েছেন, পদযাত্রার সামনে মাদলে বোল তোলা কাংলাপাহাড়ির মতিলাল সরেন, ভগন হেমব্রমরা। ভগনের কথায়, ‘‘গাঁয়ে গাঁয়ে মুনিষ খেটে খাই। কাজ পেলে দুশো টাকা। না পেলে খালি হাতেই ফিরতে হয়। এবার তো অবস্থা আরও খারাপ। চাষবাসই নেই। কেই বা কাজ দেবে। দেখুন না গাঁয়ে ছেলে খুঁজে পাবেন না। সব তো এখন মুম্বাইয়ে।’’ 
যে কাংলাপাহাড়ি গমগম করত, ফুটবলে মাঠে সব সময় জমে থাকত ভিড়, আয়োজন হতো খেলাধুলার সেই কাংলাপাহাড়িকে দেখে মনে হবে যেন প্রাণ হারিয়েছে। চারপাশে ইউক্যালিপটাসে ঘেরা অপরূপ এক গ্রাম জলুস হারিয়েছে স্রেফ অনটনের থাবায়। এমনই এক সুন্দর গ্রামেই কি না তৈরি হয়েছিল বিভেদের বাতাবরণ! পাশের লক্ষ্মীনারায়ণপুরে ঢালা হয়েছিল বিভাজনের বিষ। রামপুরহাট শহর থেকে বিশ কিমি উত্তরে প্রত্যন্ত গ্রামগুলিকে উৎসবের মরশুমেও সাক্ষী হতে হয়েছিল পুলিশ মোতায়েনের! দুর্গাপুজো-কুরবানি নিয়ে বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আজ ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে সব। গ্রামেরই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জানিয়েছেন, ‘‘আপাতত ওই সব সমস্যা নেই। থাকবে কী করে? মানুষ পেটের ভাত জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। পুজো হবে কি হবে না, কুরবানি হবে কি হবে না তা নিয়ে ভাববে কখন। তবে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’’  
সকাল-সন্ধ্যা চুলোয় ভাতের হাঁড়ি চাপানোর তাগিদে হয়রান মানুষগুলোর কাছে আজ ফিকে হয়েছে পুজো-পরবের সংঘাত। বরং রুটি রুজির যন্ত্রণা মেলানোর বার্তা নিয়েই চুড়কি, ফুলমণি, জবির, জিয়ারুল হেঁটেছেন দীর্ঘ পথ, কাংলাপাহাড়ির ফুটবল গ্রাউন্ডে থেকে লক্ষ্মীনারায়ণপুর। কাঁধে ছিল লাল ঝান্ডা। হৃদয়ে বীরসা মুন্ডা। 
 

Comments :0

Login to leave a comment