Modi Trudeau

কানাডার অভিযোগ নিয়ে আরও চাপের মুখে ভারত

জাতীয় আন্তর্জাতিক

কানাডায় হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যা নিয়ে ভারত ক্রমে আরও ধারালো আক্রমণের মুখে পড়ছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডু এবার দাবি করেছেন, যে কথা তিনি সংসদে বলেছেন, সেই তথ্যপ্রমাণ কয়েক সপ্তাহ আগেই ভারতকেও দেওয়া হয়েছিল। অন্তত চারবার ট্রুডু নিজ্জরের হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের এজেন্টদের যোগসাজশের অভিযোগ প্রকাশ্যে আনলেন। নয়াদিল্লির তরফে তাঁর দাবি খারিজ করা এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেবার পরেও ট্রুডু তাঁর বক্তব্যে অনড় রয়েছেন। ইতিমধ্যেই জানা গেছে, ট্রুডু জি-২০ বৈঠকের সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে তাঁর হাতে থাকা প্রমাণের কথা জানিয়েছিলেন। শুধু ট্রুডুই নন, জি-২০তে আসা পশ্চিমী দেশগুলির অনেক রাষ্ট্রপ্রধানই মোদীর সঙ্গে বৈঠকে কানাডার অভিযোগের কথা জোরের সঙ্গে বলেছেন। তার মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রপতিও রয়েছেন। জি-২০’র আয়োজন নিয়ে প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রশংসা করলেও মোদীর সঙ্গে আলোচনায় তাঁরা উদ্বেগ জানিয়েছেন কানাডার মাটিতে কানাডার নাগরিক হত্যায় ভারত সরকারের যদি ভূমিকা থেকে থাকে, তা মারাত্মক। 
কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন পশ্চিমী দেশগুলির এই উদ্বেগের কথা জানার পরেও ভারত সরকার যথাযথ কূটনৈতিক উদ্যোগ নিল না কেন। কানাডা কেন প্রকাশ্যে এমন বিস্ফোরক অভিযোগ করলো। সম্ভাব্য কারণ হলো ভারত কানাডার উদ্বেগকে পাত্তা দেয়নি। কানাডার নিরাপত্তা উপদেষ্টা আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লি এসে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে দু’দফায় চারবার বৈঠক করেছেন। দোভাল সমস্ত ঘটনা সম্পর্কেই অবহিত ছিলেন। কিন্তু ভারত সরকারের তরফে পরিস্থিতির উত্তাপ প্রশমন করার কোনও চেষ্টা হয়নি। ‘উদ্ধত’ মনোভাব দেখানো হয়েছে। যে ঔদ্ধত্য অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মোদী সরকারের কাজের বৈশিষ্ট্য তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেখাতে গিয়ে ভারত এখন গুরুতর চাপের মুখে। 
চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিন্কেন। শুক্রবার রাতে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্নের উত্তরে ব্লিন্কেন বলেছেন, কানাডার অভিযোগ গুরুতর। অন্য দেশের মাটিতে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা গ্রহণযোগ্য নয়। যারা করেছে তাদের দায় নিতেই হবে। ইঙ্গিত ভারতের দিকেই। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্য দেশের ভূখণ্ডে গিয়ে গুপ্তহত্যার ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে, অন্য দেশে অভ্যুত্থান সংগঠিত করার তালিকাও দীর্ঘ। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে এই মন্তব্য ভারতের কাজ আরও কঠিন করে দিয়েছে। 
কানাডা যে একা নিজ্জরের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় করেনি, তা-ও সামনে চলে এসেছে। কানাডার ‘মিত্র’দের দেওয়া তথ্যও রয়েছে। তদন্তকারীদের পরিভাষায় ‘হিউম্যান’ এবং ‘সিগন্যালস’ তথ্যও তার মধ্যে রয়েছে। কানাডার সম্প্রচার সংস্থা সিবিসি সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, এই তথ্যের মধ্যে কানাডায় ভারতীয় কূটনীতিকদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগও রয়েছে। কানাডার ‘মিত্র’ বলতে বোঝানো হয়েছে গোয়েন্দা নিরাপত্তা সংক্রান্ত ‘ফাইভ আইজ’ জোটের দেশগুলিকে। কানাডা ছাড়াও এই জোটে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড। কোন দেশ থেকে কানাডা তথ্য পেয়েছে তা জানানো না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, মার্কিন গোয়েন্দারাই কানাডাকে ভারতের যোগসাজশের তথ্য দিয়েছেন। কানাডায় ভারতীয় কূটনীতিকদের ওপরে ‘নজরদারি’ করেও তথ্য পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। কানাডায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড কোহেন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘ফাইভ আইজ’ এ সংক্রান্ত তথ্য দিয়েছে কানাডাকে। তারপরে ট্রুডু প্রকাশ্যে তা জানিয়েছেন। 
খালিস্তানপন্থী নেতা নিজ্জরকে ভারত ২০২০সালে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে চিহ্নিত করে। তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারাও প্রয়োগ করে। কিন্তু নিজ্জর ভারতের নাগরিক নন। তিনি কানাডার নাগরিক অনেক দিন ধরেই। এই অবস্থায় ভারত সরকার ‘লোক লাগিয়ে’ তাঁকে কানাডাতেই হত্যা করেছে, এমন অভিযোগের কূটনৈতিক তাৎপর্য নিজ্জরের হত্যার ঘটনায় সীমাবদ্ধ থাকছে না। 
বস্তুত, ভারত সরকারের বিদেশ নীতি প্রশ্নের মুখে পড়ে গেছে। ভারত সরকার মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠ করেছে। অন্যদিকে, ওয়াশিংটনও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক আঁতাতে ভারতকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসাবে গণ্য করছে। মূলত চীন-বিরোধী তৎপরতার লক্ষ্যে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ‘কোয়াড’ গঠনও করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী ও দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠ কানাডাকে সরিয়ে রেখে নয়াদিল্লিকে তুষ্ট করতে মার্কিন রাজনীতিকরা রাজি হবেন না। ব্রিটেনও এই প্রশ্নে কানাডার পাশে রয়েছে। ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনের বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর হবার মুখে। ভারত অস্ত্র আমদানিতে এখন বিশ্বে শীর্ষে। সদ্যই ফ্রান্সের কাছ থেকে বড় আকারে অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান কেনার জন্য চুক্তি হয়েছে। কিন্তু কানাডার প্রশ্নে ফ্রান্সও ভারতকে সমর্থন দিতে অক্ষম। কূটনৈতিক মহলের ভাষ্য, সঙ্কটে পড়েছে দু’তরফই। ভারতে মোদী সরকারের কাজের ধরন এবং গণতন্ত্রের অবনতি নিয়ে বিক্ষিপ্ত মন্তব্য করলেও এতদিন পশ্চিমী দেশগুলির তরফে কোনো প্রকাশ্য সমালোচনা হয়নি। মোদীও নিজেকে ‘বিশ্বগুরু’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কানাডার অভিযোগ যদি সত্য বলে প্রমাণিত হয় তাহলে ভারত সরকারকে প্রকাশ্যে নিন্দা করা ছাড়া উপায়ান্তর থাকবে না এবং ভারসাম্য বদলে যাবে।

Comments :0

Login to leave a comment