এক মহিলার ৩৫ টুকরো দেহ ১৮ দিন যাবৎ জঙ্গলে ফেলা হলেও টের পেল না দিল্লি পুলিশ! নজরে পড়ল তাও নিহতের বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে। অথচ অন্য নানা বিষয়ে অতি সক্রিয়তা দেখাতে মোটেই গাফিলতি দেখায় না কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্ত দিল্লি পুলিশ।
২৮বছর বয়সি ওই মহিলা খুন হন তিনি যাঁর সঙ্গে থাকতেন সেই সঙ্গীর হাতেই। তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করে সেই সঙ্গী প্রতিদিন রাতে বেরিয়ে দিল্লির মেহরৌলির জঙ্গলে ফেলে আসতো। পুলিশের নজরে কিছু আসেনি ১৮ দিন যাবৎ চলা এই নৃশংসকাণ্ড। তারও আগে সে নতুন রেফ্রিজারেটর কিনে তার মধ্যে রেখে দিয়েছিল দেহাংশগুলি। পরে অনুসন্ধানে নেমে গোটা বিষয়টি পুলিশের নজরে আসে। গোটা ঘটনাটিও জানা যায় পুরুষ সঙ্গীকে গ্রেপ্তারের পর। তাও খুনের প্রায় ৬ মাস পর। সোমবার বিষয়টি সামনে আসে পুলিশ জানানোর পর। অভিযুক্ত সেই পুরুষ সঙ্গীর পাঁচ দিনের পুলিশি হেপাজত হয়েছে।
জানা যায়, আমিন পুনেওয়ালা তাঁর সঙ্গী শ্রদ্ধা ওয়াকারকে তীব্র বাদানুবাদের পর ১৮ মে খুন করে। খুনের পর দেহগুলিকে ৩৫ টুকরো করে প্রথমে। এরপর পুনেওয়ালা ৩০০ লিটারের একটি রেফ্রিজারেটর কিনে আনে এবং তার মধ্যে ওই দেহের অংশগুলি ভরে রাখে। প্রতিবেশী এবং পুলিশের নজর এড়াতে পচা দেহের দুর্গন্ধ রোধে রুম ফ্রেশনার এবং সুগন্ধী ধূপ জ্বালিয়ে রাখতো পুনেওয়ালা। এরপরেই মধ্য রাতে বেরিয়ে একেক দিন দেহের একেক অংশ ফেলে আসতো ওই জঙ্গলের বিভিন্ন প্রান্তে।
পুনেওয়ালা-শ্রদ্ধার আলাপ অনলাইন কথাবার্তায়। পরে তাঁরা মুম্বাইয়ের এক কল সেন্টারে একসঙ্গে কাজ শুরু করেন। সেই আলাপ ঘনিষ্ঠতা পায়। কিন্তু তাঁদের এই সম্পর্ক দুজনের পরিবার মেনে নেয় না মূলত ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার জন্য। ফলে তাঁরা মুম্বাই থেকে দিল্লি চলে আসেন চলতি বছরের গোড়ার দিকে। দক্ষিণ দিল্লির মেহরৌলি এলাকায় ভাড়া বাড়িতে তাঁরা একসঙ্গে থাকতেও শুরু করেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই দুজনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। পুলিশ জানাচ্ছে, এক সঙ্গে থাকার সম্পর্ককে বিবাহে পরিণত করার বিষয় নিয়েই বিরোধ বাধে। গত মে মাসে সেই বিরোধ চরম আকার নিলে পুনেওয়ালা খুন করে শ্রদ্ধাকে।
জানা গিয়েছে, শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর পরিবারের কোনও কথাবার্তা ছিল না এই সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর। তবে ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে শ্রদ্ধার বাবা পুলিশে অভিযোগ দায়ের করার পরে। সেপ্টেম্বরে শ্রদ্ধার এক বন্ধু ওঁর বাবাকে জানান যে, গত দু’মাস যাবৎ শ্রদ্ধাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন করলে ‘আনরিচেবল’ বলা হচ্ছে। তখন শ্রদ্ধার বাবা বিকাশ মদন ওয়াকার শ্রদ্ধার ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ ঘেঁটে দেখেন যে, তাতেও কয়েক মাস যাবৎ কোনও পোস্ট নেই। এতে সন্দেহ হয় তাঁর। তখন তিনি পুনেওয়ালাকে ফোন করলে জানতে পারেন যে, কয়েক মাস তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে। তারা আলাদা বসবাস করে। নভেম্বর মাসে শ্রদ্ধার বাবা মুম্বাই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিখোঁজ ডায়েরি দায়ের করেন। মুম্বাই পুলিশ তদন্ত শুরু করলে পুনেওয়ালার মোবাইল লোকেশন দিল্লি দেখায়। এও দেখে যে, শ্রদ্ধার মোবাইল মে মাস থেকে বন্ধ পড়ে আছে। তখনই মুম্বাই পুলিশ বিষয়টি দিল্লি পুলিশকে জানায়।
নভেম্বর মাসের ৮ তারিখ শ্রদ্ধার বাবা মেহরৌলির ওই বাড়িতে এসে দেখেন দরজায় তালা ঝুলছে। তখন তিনি তাঁর মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ দায়ের করেন মেহরৌলি থানায়। পুনেওয়ালা মাঝে মধ্যেই তাঁর মেয়েকে মারধর করতো বলেও অভিযোগে জানিয়েছেন শ্রদ্ধার বাবা।
এই অভিযোগের ভিত্তিতে শনিবার পুনেওয়ালাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জেরায় পুনেওয়ালা স্বীকার করে যে, তার সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হতো শ্রদ্ধার। বিরোধ বাধতো বিয়ে করা নিয়েই। প্রায়ই চেঁচামেচি হতো। একদিন চরম আকার নিলে পুনেওয়ালা প্রথমে হাত দিয়ে শ্রদ্ধার মুখ চেপে ধরে এবং গলা টিপে খুন করে। এরপরে সে দেহগুলি টুকরো টুকরো করে রেফ্রিজারেটর কিনে তার মধ্যে ভরে রাখে। পরে সময় বুঝে জঙ্গলের বিভিন্ন এলাকায় ফেলে এসেছে।
পুলিশ খুনের অভিযোগ দায়ের করেছে পুনেওয়ালার বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাজধানী দিল্লির বুকে পাঁচ মাস আগে ঘটে যাওয়ার ঘটনার হদিশ পেল দিল্লি পুলিশ মুম্বাই পুলিশের দেওয়া খবরের পর! যে কোনও বিরোধী স্বর আটকাতে তৎপর দিল্লি পুলিশ অপরাধের হদিশ পায় না।
এদিকে, জাতীয় মহিলা কমিশন এদিন দিল্লি পুলিশকে স্বচ্ছ এবং দ্রুত ওই খুনের তদন্তের দাবি জানিয়েছে। তারা পুলিশের কাছে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো এবং মেডিক্যাল রিপোর্টও চেয়েছে পুলিশের কাছে।
Comments :0