প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বহুল প্রচারিত ডাবল ইঞ্জিনের সরকার ঠিক কেমন তার একেবারে হাতে গরম উদাহরণ মণিপুর। গত বিধানসভা নির্বাচনেও মণিপুরে প্রচারে গিয়ে ডাবল ইঞ্জিনের মাহাত্ম্য শুনিয়ে এসেছেন। ভোটের পর মোদীর প্রত্যাশা মতো সেখানে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার গঠন হয়েছে। মোদী প্রিয় সেই ডাবল ইঞ্জিনের অধীনে গত প্রায় দু’মাস ধরে মণিপুরে জাতি দাঙ্গা তথা গোষ্ঠী যুদ্ধের আগুন জ্বলছে। হিংসা আর সন্ত্রাসকবলিত এই রাজ্যে সরকার বলতে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। কার্যত সব মহল থেকে নিন্দিত, সমালোচিত একা কুম্ভ মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং ছাড়া রাজধানী ইম্ফলে আর কারও পাত্তা নেই। কুকি জনগোষ্ঠীর মন্ত্রীরা সকলে রাজধানী ছেড়ে পাহাড়ে নিজেদের এলাকায় চলে গেছেন। মেইতেই জনগোষ্ঠীর মন্ত্রীরা দিল্লিতে গিয়ে বসে আছেন। এদিকে বিধানসভার অধ্যক্ষ বেশকিছু বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি পাড়ি দিয়েছেন ডাবল ইঞ্জিনের প্রবক্তার দর্শনের আশায়। সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা কেউই প্রায় ইম্ফলে থাকা নিরাপদ মনে করছেন না। রাজ্যের একমাত্র মহিলা মন্ত্রী নেমচা কপিজেনর সরকারি বাংলো পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হলো। সেই আগুন নিভতে না নিভতেই পরদিন মোদী সরকারে মন্ত্রী রাজকুমার রঞ্জন সিংয়ের বাড়িতে সহস্রাধিক সশস্ত্র জনতা চড়াও হয়ে ভেঙে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। মন্ত্রীর ব্যক্তিগত রক্ষী ও নিরাপত্তা রক্ষীবাহিনী কার্যত পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে। গোটা মণিপুর রাজ্য এখন কার্যত সরকার বর্জিত। দুই জনগোষ্ঠীর উগ্রপন্থীরা এবং দুষ্কৃতীরা এখন সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। জায়গায় জায়গায় সংঘর্ষ হচ্ছে দফায় দফায়। চলছে গুলির লড়াই। থামানোর বা হস্তক্ষেপ করার কেউ নেই। নেই অসহায় বিপন্ন রাজ্যবাসীর পাশে দাঁড়ানোর কেউ। ডাবল ইঞ্জিনের ব্যাপার-স্যাপার দেখে ধন্দ তৈরি হয়েছে মণিপুরটা কি আদৌ ভারতের অংশ! তা না হলে এক ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যেও কেন্দ্রীয় সরকারের এমন অবিশ্বাস্য নীরবতা কেন? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীরও সম্ভবত মণিপুর নিয়ে ভাববার সময় নেই। তিনি বিশ্বগুরু হবার স্বপ্নে বিভোর।
হিংসা ও সন্ত্রাস কবলিত রাজ্যটিতে বিবাদমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছে প্রায় দু’মাস ধরে। অসংখ্য গ্রাম লোকালয় জনশূন্য হয়ে গেছে। লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে আশ্রয় শিবিরে। ইতিমধ্যে প্রায় দেড়শো লোকের মৃত্যু হয়েছে। আহত-জখমের সংখ্যার সীমা পরিসীমা নেই। রাজ্যে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুরোপুরি স্তব্ধ। মানুষের জীবিকার কোনও উৎস খোলা নেই। এক অভূতপূর্ব মানবিক সঙ্কটে নিমজ্জিত মণিপুরের মানুষ। এত কিছুর পরও ডাবল ইঞ্জিনের সরকার গড়ার আহ্বান জানিয়ে আসা প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। তিনি কানে তুলো গুঁজে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন দায় এড়াতে। মণিপুর জাহান্নামে যাক প্রধানমন্ত্রীর কিছু যায় আসে না। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ কর্ণাটকের নির্বাচনে প্রচার কাজ সেরে কোনোরকমে সময় বের করে ইম্ফলে গিয়েছিলেন। দফায় দফায় বৈঠক করে, শান্তি কমিটি গঠন করে ১৫ দিনের মধ্যে মণিপুর স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন। ফিরে আসার পর শান্তি কমিটির সদস্য বিশিষ্টজনরা সকলেই প্রায় নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। পাশাপাশি শান্তি ফেরার বদলে প্রতিদিন বাড়ছে সংঘর্ষ। মৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিন। এখন অমিত শাহও মৌনব্রত নিয়েছেন। আসলে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে সমঝোতা করে তাদের সাহায্য নিয়ে বিজেপি’র ক্ষমতা দখলের চরম মূল্য আজ দিচ্ছে মণিপুরের মানুষ। যাকে দলের লোকরাও চায় না তাকে মুখ্যমন্ত্রী করে মেইতেই-কুকি বিভাজনের ছকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন মোদী-শাহরা। সঙ্কীর্ণ ক্ষমতার রাজনীতির বিষফল আজ ছারখার করে দিচ্ছে মণিপুরকে।
Comments :0