Editorials on Center

মুখ খুলতে বাধ্য করলেন বিরোধীরা

সম্পাদকীয় বিভাগ


লোকসভায় মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার প্রশ্নে বিরোধীদের পক্ষ থেকে বারবার স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে এই অনাস্থা নয়, প্রধানমন্ত্রীকে সংসদের ভেতরে মণিপুরের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য পেশ করতে বাধ্য করার জন্যই এই অনাস্থা প্রস্তাব। তিন মাসের বেশি সময় ধরে জাতি দাঙ্গার আগুনে মণিপুর জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেলেও প্রধানমন্ত্রী অনন্ত নীরবতার আশ্রয় নিয়েছেন। দে‍শের মানুষ জানতে চান মণিপুরে ঠিক কি ঘটছে। ডাবল ইঞ্জিনের সরকার থাকা সত্ত্বেও সেখানে হানাহানি বন্ধ হচ্ছে না কেন। মণিপুরে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক কি কি ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে সেটা দেশবাসীকে বলুন। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশবাসীর কাছে এটা তাঁর দায়বদ্ধতা। আর এখন যেহেতু সংসদের অধিবেশন চলছে তাই সংসদীয় রীতি অনুযায়ী যা বলার প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে দাঁড়িয়েই বলতে হবে। মণিপুর জুড়ে দিনের পর দিন ধারাবাহিক খুন, সন্ত্রাস, হামলা, ধর্ষণ, নির্যাতন, পীড়ন, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার আরজি নিয়ে বিরোধীরা সহস্রবার কেন্দ্রীয় সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তিনি কোনোভাবেই সাড়া দেননি। দেশের ও দুনিয়ার সর্ব বিষয়ে অনর্গল কথা বলে গেলেও মণিপুর নিয়ে তিনি আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। তাঁর অহঙ্কারী আচরণ, প্রতিমুহূর্তে বুঝিয়ে দিয়েছে মণিপুর নিয়ে কথা বলে অযথা সময় নষ্ট করতে তিনি চান না। হোক না সেখানে মহিলাদের বিবস্ত্র করে রাস্তায় হাঁটানোর ঘটনা বা প্রতিদিন নিরপরাধ মহিলাদের ধর্ষণ-নির্যাতনের ঘটনা, সে সব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিন্দুমাত্র উদ্বেগ বা বিবেক দংশন নেই। তিনি আছেন তাঁর আকাশচুম্বী ‍‌ইগো নিয়ে খোশ মেজাজে। তিন মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানো ও দলবদ্ধ ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় যখন দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে তখন একরকম বাধ্য হয়ে সংসদ চত্বরে সেই ঘটনার নিন্দা করেছেন মাত্র কিন্তু মণিপুরে সামগ্রিকভাবে কি ঘটছে তা নিয়ে যথারীতি নীরবই ছিলেন। তিন মাস ধরে মণিপুরে মানবতার নিকৃষ্টতম ধ্বংসলীলা চললেও শান্তির জন্য তিনি আবেদন জানাননি। আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার এবং অপরাধীদের সাজা দেবার ন্যূনতম আশ্বাসটুকুও বিপন্ন অসহায় মণিপুরবাসীদের দেননি। এমন এক অমানবিক বিবেকহীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন একগুঁয়ে দাম্ভিক প্রধানমন্ত্রীকে সংসদের ভেতরে কথা বলাতে বাধ্য করার আর কোনও উপায় না থাকায় অনাস্থা প্রস্তাব আনে বিরোধীরা।
আংশিক হলেও বিরোধীদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বাধ্য হয়েছেন অনাস্থা প্রস্তাবের উপর আলোচনার জবাব দেবার সময় মণিপুর নিয়ে দু’চার কথা বলতে। তাঁর অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতা খানিকটা হলেও খর্ব করতে পেরেছে বিরোধীরা। অবশ্য ২ ঘণ্টা ১২ মিনিটের বক্তৃতার একেবারে শেষে ১ঘণ্টা ৫২ মিনিট পর আসে মণিপুর প্রসঙ্গ। তখন অবশ্য তাঁর ভাষণ শোনার জন্য একজনও বিরোধী সাংসদ ছিলেন না। মণিপুর নিয়ে কিছু না বলায় বিরোধীরা ওয়াক আউট করে বেরিয়ে যান। বিরোধী শূন্য সংসদে দলীয় সমাবে‍‌শের ঢঙে তিনি কার্যত নির্বাচনী সভা করেছেন। নিজের ও সরকারের সাফল্যের ফিরিস্তি দিয়েছেন। আর অনর্গল গালি দিয়ে গেছেন কংগ্রেস এবং অন্য বিরোধী দলকে। তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য সংসদে না থাকায় বিরোধীদের কটাক্ষ করেছেন অথচ অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে তিনদিন ধরে আলোচনার সময় তিনি নিজে সংসদের চৌকাঠ মাড়াননি। এসেছেন শুধু বক্তৃতা দিতে। তাঁর কথা সবাইকে শুনতে হবে তিনি কারো কথা শোনেন না। গণতন্ত্র নিয়ে লম্বা লম্বা ভাষণ দেন অথচ গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র সংসদে তাঁর টিকিও মেলে না। সারা দেশ থেকে জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে সংসদে যারা আসেন তাদের কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেন না। তিনি সংসদে যান শুধু ভাষণ দিতে তাও বাধ্যবাধকতা থাকলে। দেশের ও জনগণের নানান জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে কোনোদিন কোনও কথা বলতে দেখা যায় না। গত সাড়ে চার বছরে যে ৭ বার তিনি সংসদে বক্তব্য রেখেছেন একটি ছাড়া সবক’টিই ছিল বাধ্যতামূলক। সংসদ তাঁর কাছে অবজ্ঞার কেন্দ্র। দেশে যা কিছু সমস্যা, তার যা কিছু ব্যর্থতা তার দায় তিনি কংগ্রেস ও বিরোধীদের ঘাড়ে চাপিয়ে হাত ধুয়ে নিয়েছেন। এমনকি মণিপুরে ১০০ দিন ধরে যা ঘটছে তার দায়ও অতীতের কংগ্রেস সরকারের উপর চাপিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন মণিপুর নিয়ে বলার মুখ তাঁর নেই। প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন ডাবল ইঞ্জিনের চূড়ান্ত অপদার্থতা।

Comments :0

Login to leave a comment