Electoral Bonds TMC

নির্রাচনী বন্ডে তৃণমূলকে ৪৪ কোটি আরপিজি'র

রাজ্য

বিদ্যুৎ বিলের ছ্যাঁকায় গরিব মধ্যবিত্তের যখন নাভিশ্বাস অবস্থা তখন এরাজ্যের শাসকদল তৃণমূলকে প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা দান করেছে আরপিজি-সঞ্জীব গোষ্ঠী। 
কলকাতা ও শহরতলি এলাকার বিদ্যুৎ বণ্টনের একচেটিয়া অধিকার সিইএসসি’র ওপর। নির্বাচনী বন্ডে সেই সিইএসসি’র মালিকানাধীন আরপিজি-সঞ্জীব গোষ্ঠী ৪৪৪ কোটি টাকার বন্ড কিনেছিল। নির্বাচনী বন্ডের তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর দেখা যাচ্ছে, বিপুল এই অর্থ দেওয়া হয়েছে তৃণমূলের তহবিলে।
হলদিয়া এনার্জি আরপিজি-সঞ্জীব গোয়েঙ্কা গোষ্ঠীর মালিকানাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি। এই কোম্পানি ২৮১ কোটি টাকার বন্ড কিনেছিল। আরপিজি-সঞ্জীব গোষ্ঠীর মালিকানাধীন শুধু নয়, কলকাতার সিইএসসি দপ্তরের ঠিকানা ব্যবহারকারী ধারিওয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড কোম্পানি কিনেছিল ৯০ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড। একইসঙ্গে আরপিজি-সঞ্জীব গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত পিসিবিএল লিমিটেড কোম্পানি ৪০ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কেনে। ক্রিসেন্ট পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানিও আরপিজি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। এই কোম্পানিটিও এসবিআই থেকে ৩৩ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছিল। 
রাজ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত আরপিজি-সঞ্জীব গোষ্ঠীর এই চার কোম্পানি মিলিতভাবে মমতা ব্যানার্জির দলকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৪৪৪ কোটি টাকা সাহায্য করেছে। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে সর্বোচ্চ টাকা প্রাপ্তির তালিকায় বিজেপি’র পরেই আঞ্চলিক দল হিসাবে শীর্ষে তৃণমূল। ১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা নির্বাচনী বন্ড থেকে আয় করেছে রাজ্যের শাসকদল। তারমধ্যে ৪০ শতাংশ টাকা এসেছে ডিয়ার লটারির কাছ থেকে। লটারির পরই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে তৃণমূলকে টাকা জুগিয়ে দেওয়ার পর দ্বিতীয় স্থানে আছে আরপিজি-সঞ্জীব গোয়েঙ্কা গোষ্ঠী।  
সিইএসসি এলাকায় বর্তমানে ইউনিট পিছু বিদ্যুতের দাম দিতে হয় ৭ টাকা ৩১ পয়সা। ২০১০-১১ সালে এরাজ্যে কলকাতা ও শহরতলি এলাকায় সিইএসসি’র ইউনিট পিছু বিদ্যুৎ মাশুল ছিল ৫ টাকা ৮৭ পয়সা। মমতা ব্যানার্জির আমলে শুধু এমভিসিএ’র (মাল্টি ভ্যারিয়েবল কস্ট অ্যাডজাস্টমেন্ট) মাধ্যমে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। আর শেষ পর্যন্ত তার ফল ভুগতে হচ্ছে গরিব ও মধ্যবিত্তকে। 
এরাজ্যে গরিব, বড়লোক নির্বিশেষে মহিলাদের ‘পকেটমানি’ হিসাবে রাজ্য সরকার ৫০০ টাকা করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পে অনুদান দেয়। আগামী এপ্রিল মাস থেকে সেই অনুদান বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। রাজ্য প্রশাসনের এক অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিকের কথায়, ‘‘মহিলাদের ৫০০ টাকা ভাতা দিয়ে, বর্ধিত বিদ্যুত বিলের মাধ্যমে অন্যদিক দিয়ে সেই টাকা সিইএসসি নিয়ে যাচ্ছে। আবার ওই টাকাই একত্র করে নির্বাচনী বন্ডের মধ্য দিয়ে আরপিজি-সঞ্জীব গোষ্ঠী তৃণমূলের তহবিলে ঘুরপথে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে।” 
অথচ বিদ্যুতের দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই। বরং ইউনিট পিছু বিদ্যুতের দাম অর্ধেক হওয়া উচিত বলে মনে করেছেন বিদ্যুৎ পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘এরাজ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ হয় কয়লা থেকে। সেই কয়লার দাম প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। একইসঙ্গে জিএসটি কমেছে ৭ শতাংশ। আগে ১২ শতাংশ হারে জিএসটি দিতে হতো। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশে।” অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমার পরেও কমানো হয়নি ইউনিট পিছু বিদ্যুতের মাশুল। 
এমনকি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য টিসি লস (টেকনিক্যাল অ্যান্ড কর্মাশিয়াল লস) কমে দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশে। এই তথ্য রাজ্যের বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছে জানিয়েছে উৎপাদন কোম্পানিগুলিই। কিন্তু তারপরও বিদ্যুৎ বিলে ইউনিট পিছু দাম অর্ধেক হওয়ার পরিবর্তে দাম বাড়ানো হয়েছে। এরাজ্যে ফি বছর দুর্গাপুজোর সময় পুজো কমিটিগুলিকে বিদ্যুৎ বিলে বিপুল ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার। কলকাতাতেই প্রায় ৫ হাজার পুজো কমিটির বিদ্যুৎ বিলে এবার ছাড় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গরিব ও মধ্যবিত্তের বিদ্যুৎ বিলের খরচ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে, সেখানে কোনও ছাড় নেই।
২০১৭ সালের পর থেকে এখনও পর্যন্ত ইউনিট প্রতি মাশুল কাগজে কলমে না বাড়ালেও ঘুরপথে মাশুল বাড়ানো হয়েছে। এরাজ্যে গত এক দশকে ১৪ বার এমভিসিএ’কে ব্যবহার করে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের মাশুল। 
বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা যদি মনে করে নানা কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়েছে তারজন্যই এই এমভিসিএ ব্যবস্থা চালু আছে। অর্থাৎ উৎপাদন সংস্থা যদি দেখে রেলের মাশুল বৃদ্ধির জন্য কয়লা আনার খরচ বেড়েছে বা কয়লার দাম বাড়ার ফলে উৎপাদন খরচ ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে, তখন হিসাব করে এমভিসিএ ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রাহকদের ওপর সেই বাড়তি খরচ চাপানোর ব্যবস্থা আছে। এমভিসিএ’র ব্যবস্থা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে নেওয়া হলেও তা চূড়ান্ত করা হয়নি। কিন্তু ২০১১ সালে ভোটের ফল প্রকাশের দিন সন্ধ্যায় অত্যন্ত দ্রুততায় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান স্বাক্ষর করে এমভিসিএ’কে বৈধতা দেন। এতদিন ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের মাশুল নেওয়া হতো। তারসঙ্গে আলাদা করে নেওয়া হতো এমভিসিএ (মান্থলি ভেরিয়েবল কস্ট অ্যাডজাস্টমেন্ট) খাতে ইউনিট পিছু মাশুল। এবারই প্রথম মূল মাশুলের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে এমভিসিএ খাতের ইউনিট পিছু মাসুলের অর্থ। ফলে ঘুরপথে ফের বাড়বে বিদ্যুতের মাশুল।
তৃণমূল কংগ্রেস আর কর্পোরেটের এই আঁতাত এমনই যে সিইএসসি’র প্রশাসনের ইউনিয়নের মান্যতা নির্বাচনে গণতন্ত্রের কোনও অস্তিত্বও পর্যন্ত রাখা হচ্ছে না। প্রতি দু’বছর অন্তর সিইএসসি’র শ্রমিক কর্মচারীদের ভোটে ইউনিয়নের মান্যতা দেওয়ার নিয়ম। ২০১১ সালের এরাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের বিদায়ের পর ২০১২ ও ২০১৪ এই দু’বার নির্বাচনে সিআইটিইউ জয়লাভ করেছিল। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে প্রহসন হয়ে দাঁড়ায় নির্বাচন। গত ১ মার্চ ভোটে সিআইটিউ’র শ্রমিক কর্মচারীদের ভোটে অংশগ্রহণ করতে না দিয়ে ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন। সিইএসসি প্রশাসন ও রাজ্য সরকার যৌথভাবে শাসকদলের ট্রেড ইউনিয়নের জয় নিশ্চিত করে। এইভাবেই তৃণমূলকে টাকা দিতে কর্মচারীদের কাছ থেকেও বাধার পথ সরিয়ে দিয়েছে সরকার ও দল। বিদ্যুৎ বিলে মানুষকে লুট করতে কোনও বাধাই রাখতে চায় না কর্পোরেট বিদ্যুৎ কোম্পানি।

.............................
হলদিয়া এনার্জি- ২৮১ কোটি টাকা 
ধারিওয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার- ৯০ কোটি টাকা

পিসিবিএল লিমিটেড- ৪০ কোটি টাকা
ক্রেসেন্ট পাওয়ার লিমিটেড- ৩৩ কোটি টাকা
আরপিজিএস গোষ্ঠী মিলিতভাবে- ৪৪৪ কোটি টাকা
২০১১ সালে ইউনিট প্রতি মাশুল ৫টাকা ৮৭ পয়সা
২০২৪ সালে মাসুল- ৭ টাকা ৩১ পয়সা
কয়লার দাম কমেছে ৪০ শতাংশ, জিএসটি কমেছে ৭ শতাংশ
বিদ্যুতের দাম ইউনিট পিছু সাড়ে তিন টাকা হওয়া উচিত
 

Comments :0

Login to leave a comment