Nuh violence

হাসপাতালও গুঁড়িয়ে দিয়েছে বুলডোজার

জাতীয়

Nuh violence

অরূপ সেন: নূহ

সঈদ হুসেইন খান মেওয়াতি হসপিটালের সামনে গিয়ে দেখা গেল, গোটা জায়গাটার উপর দিয়ে খাট্টারের বুলডোজার যেন হাল-চাষ করেছে। ভাঙা-চোরা ধ্বংসস্তুপের নিচে কোথাও মনিহারি দোকানের সাইনবোর্ড, কোথাও উঁকি মারছে ‘এক্সরে ডান হেয়ার’ সাইনবোর্ড। একটু এগিয়েই পরপর লাইন দিয়ে ‘বাছাই করে’ গুঁড়িয়ে দেওয়া ওষুধের দোকানের ধ্বংসাবশেষ। ওর নিচেই চাপা পড়ে রয়েছে কোটি কোটি টাকার ওষুধপত্র। 
সেখানেই কথা হলো নবাব শেখের সঙ্গে। সেদিন বুলডোজার যখন এলাকায় ঢুকলো নবাব জমির দলিল-কাগজপত্র নিয়ে ৪০টা দোকান বাঁচাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। পুলিশ তাঁকেই তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল। বুলডোজার ধ্বংসলীলা থামার আগে ছাড়া পাননি। দিন দুয়েক পর উকিলরা গিয়ে ছাড়িয়ে এনেছেন নবাবকে।
এই প্রথম যেন মনের কথা বলার লোক পেয়ে যেন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না নবাব। নীলোৎপল বসুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। স্বগতোক্তির মতো মুখ থেকে বেরিয়ে এলো প্রশ্ন, ‘এখন আমার পরিবারের চলবে কী করে? এই দোকানগুলো যাঁদের পেটের ভাত জোটাতো, তাঁদেরই বা কী হবে?’

এতদিন বারেবারে চেষ্টা করেও কোনও রাজনৈতিক দল যে নূহতে পৌঁছাতে পারেনি, বৃহস্পতিবার সেখানেই পৌঁছে গেল সিপিআই(এম)’র এক প্রতিনিধি দল। পলিট ব্যুরোর সদস্য নীলোৎপল বসুর নেতৃত্বে সেই দলে ছিলেন দুই সাংসদ ভি শিবদাসন আর এ এ রহিম। নূহতেই সেই দলে যোগ দিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইন্দরজিৎ সিংও। এক সাম্প্রদায়িক হিংসার পর বিজেপি সরকারের বুলডোজার এখানে শয়ে শয়ে দোকান, বাড়ি, ঝুপড়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সরকারী রেকর্ড ৭৫৩টি, আর নাগরিক সমাজের দাবি হাজারের উপর ধাঁচা ভাঙা পড়েছে। 
প্রতিনিধি দল যখন নবাবের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন সেখানে এসে দাঁড়ালেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। শোনালেন কীভাবে এখানে বুলডোজার শাসন চলেছে। উনিই জানালেন, মসজিদকে মুসাফির খানা বানাতে নবাব বেশ কিছুটা জমি দিয়েছিলেন। তৈরি হচ্ছিল সেটা। শুধু ওই চল্লিশটা দোকান ঘর নয়, ভাঙা পড়েছে সেই নির্মীয়মান মুসাফিরখানা। হাসপাতালে যাঁরা চিকিৎসা করাতে আসেন তাঁদের আত্মীয় বাড়ির লোকের থাকার জন্যই তৈরি হচ্ছিল মুসাফির খানা।
সিপিআই(এম) নেতারা মন দিয়ে শুনলেন সবটা। কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘আপনাদের ইনসাফের লড়াইয়ে আমরা সবসময়েই পাশে আছি, থাকবো। হসপিটালের পরই প্রতিনিধি দল এগিয়ে গেল হাফ কিলোমিটার দূরের সেই মন্দিরের দিকে। আরাবল্লী রেঞ্জের এক টিলার মাথায় ছোট্ট এক মন্দির। সেখানে যাওয়ার পথেই গোদী মিডিয়ার প্রতিনিধিদের নজরে পড়ে গেল সিপিআই(এম)-র প্রতিনিধিরা। তাঁরা কী দেখছেন, কী শুনছেন বা কী বলছেন তা নিয়ে গোদী মিডিয়ার মাথা ব্যথা নজরে এলো না। বরং তাঁদের প্রশ্ন, এরা এলো কী করে।

গতকাল বিজেপি’র একটা টিম এসেছিল। প্রশাসন সাদরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। বিজেপি’র সেই নেতারা অবশ্য ধ্বংসস্তূপ, পিড়ীত মানুষের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করেননি। বরং প্রশাসনের আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলেই নূহকে ‘শান্তিপূর্ণ’’ বলে ঘোষণা করে চলে গিয়েছেন। তাই সেই গোদী মিডিয়ার সিঙ্গল পয়েন্টেড প্রশ্নের উচিত জবাব দিয়েছেন নীলোৎপল বসু। বললেন, ‘কেন শুধু বিজেপি’কেই আসতে দেওবা হবে? আর কাউকে নয়? সরকার এত নার্ভাস কেন? দ্বিধা কীসের?’ সঙ্গে যোগ করলেন, যে লোকটার প্ররোচনায় এমন ঘটনা, সে কী করে এখনও ঘুরে বেরাচ্ছে। এতদিন ধরে তার ভিডিও ঘরুরে বেড়ায় কী করে? বসুর প্রশ্ন, অথচ একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ছক চলছে কেন?
‘উচ্ছেদ অভিযান’ যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত সেটা আর চাপা নেই। পুলিশের বড় কর্তা থেকে প্রশাসনের লোকজনের থেকেই তার স্পষ্ট হয়ে গেছে। আদালত বাধ সাধায় আপাতত থেমেছে খাট্টারের বুলডোজার। কিন্তু গোটা হরিয়ানা জুড়ে এখন চলছে একটা আতঙ্কের রাজ। গ্রামে গ্রামে চলছে ‘মুসলিম বয়কট’ ফতোয়া। এমনিতেই প্রাণ বাঁচাতে মুসলিমদের অনেকেই ঘর ছেড়েছেন। যাঁদের উপায় নেই, রয়ে গেছেন। আতঙ্ক নিয়ে। কারণ এই মানুষগুলির পক্ষে যাঁরা দাঁড়াতে চেয়েছেন, তাঁদেরও হামলার শিকার হতে হচ্ছে। এই তো সেদিন ৫০-৬০ টা পুলিশের একটা দল এসে তুলে নিয়ে গেছে সাহাবুদ্দিন নামে এক উকিলকে তুলে নিয়ে গেছে, আন্ডারওয়ার পরা অবস্থায়। এই হিংসার ছুতোয় ধরপাকড়ে তুলে নিয়ে যাওয়া ৩৬৫টি যুবকের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন ওই আইনজীবী। খাট্টারের পুলিশ তাঁকেই ঢুকিয়ে দিয়েছে জেলে।

প্রতিনিধি দল দেখা করলো আরেক আইনজীবী রমজান চৌধুরী আর সঈদ সিদ্দিকি নামে এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গেও। পুলিশের তৈরি শান্তি কমিটিতে দুজনেই রয়েছেন। তবু দুজনেই আতঙ্কিত। ভয়েই এখন গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে সিদ্দিকির নিজের ছেলেই। সেই মানুষটি আর আতঙ্কিত মানুষকে কতটা ভরসা যোগাবেন! 
সাতচল্লিশের দেশভাগের আগুনে যখন দিল্লি ও তার আশপাশ জ্বলছে। মুসলিমদের অনেকেই পাকিস্তানে চলে যেতে উদ্যত। সেসময় এখানকারও বহু মানুষ তোড়জোর শুরু করেছিলেন সীমান্ত পেরিয়ে নতুন দেশে চলে যাওয়ার। এখানে এই মেওয়াত অঞ্চলের মুসলিম মানুষকে ‘মেয়ো মুসলিম’ বলা হয়ে থাকে। এঁরা ধর্মাচারণে মুসলিম, তবে জীবন-আচারের বেশিরভাগটাই হিন্দুদের মতো। স্বাধীনতার আগে থেকে এখানের মানুষের মধ্যে ভাগাভাগি প্রায় ছিলই না। দিল্লির ফেরার সময় গাড়ি সন্ধ্যায় এসে দাঁড়ালো ঘসেরা নামেই সেই গ্রামের পাশের ধাবায়। এলাকার অনেক কিছু খবর রাখা ইন্দরজিৎ শোনালেন, সেদিন এই মেওরা যাতে দেশ ছেড়ে চলে না যান তার জন্য এই গ্রামেই মানুষকে বোঝাতে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। মেওরা সেদিন ভরসা পেয়েছিলেন গান্ধীজীর কথায়। থেকে গিয়েছিলেন।

কিছুদিন পর খুন হলেন সেই গান্ধীজী। সেদিন ঘসেরার মেয়েরা গান বেঁধেছিলেন, ‘ভরসা উঠ গায়ে মেওয়ারন কা, গোলি লাগী হ্যাণ গান্ধীজি কে ছাতি বিচ’। 
ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি নয়, গান্ধীজীর ছাতিতে কারা সেদিন গুলি ফুঁড়েছিল, আর কার আজ মেওয়াত অঞ্চলকে জ্বালাচ্ছে তা এখানকার মানুষ জীবন দিয়েই বুঝছেন।

Comments :0

Login to leave a comment