AILU Conference

চিন্তার অধিকারে মোদী সরকারের হস্তক্ষেপ সংবিধান-বিরোধী কাজ সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি

রাজ্য

নরেন্দ্র মোদীর সরকার দেশের বিচার ব্যবস্থাকে মানছে না। এই সরকার সংবিধানের দেওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার, এমনকী শ্রমিক কৃষকের খেটে খাওয়ার জন্য যে আইন রয়েছে, তাকে পরিবর্তন করছে। ফৌজদারি আইনও নিজেদের মতো করে তৈরি করছে। এই অবস্থায় দেশের সংবিধান রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করার সময় এসেছে, মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সঙ্গে থেকেই মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে আইনজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বৃহস্পতিবার অল ইন্ডিয়া ল’ইয়ার্স ইউনিয়নের (এআইএলইউ) চতুর্দশ সর্বভারতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন করে একথা বলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দীপক গুপ্তা। 

এদিন হাওড়ার শরৎ সদনে শুরু হয়েছে এআইএলইউ’র তিন দিনের সর্বভারতীয় সম্মেলন। এই উপলক্ষে প্রয়াত আইনজীবী রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হাওড়া শহর এলাকার নামকরণ হয়েছে নরনারায়ণ গুপ্ত নগর। প্রয়াত আইনজীবী অশোক বকশি স্মরণে সম্মেলন মঞ্চের নামকরণ হয়েছে। এদিন বিচারপতি গুপ্তা তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, ‘‘মানুষের চিন্তার অধিকার খর্ব হচ্ছে। নানা বৈচিত্রের এই দেশে সবার চিন্তা একইরকম হবে, তা আমরা বিশ্বাস করি না। কিন্তু প্রতিটি মানুষের মুক্ত চিন্তার অধিকার রয়েছে, এটা আমাদের মানতে হবে। বর্তমান দেশের সরকার এই মুক্ত চিন্তার অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে। সরকার নিজেদের চিন্তা-ভাবনা মানুষের উপর আরোপ করছে, যা সংবিধান-বিরোধীই শুধু নয়, মানুষের মৌলিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ। দেশের গোটা বিচারধারাকে একটা রাজনৈতিক মোড়কে আড়াল করে সংবিধানকে অসম্মান করার প্রক্রিয়া চলছে।’’ বিচারপতি গুপ্তা আরও বলেন, সংবিধানে মৌলিক অধিকার বলে যে শব্দবন্ধনী রয়েছে, তার মধ্যেই রয়েছে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, মানবাধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা। দেশের মানুষকে দেওয়া সংবিধানের চিরায়ত সত্যকে সরিয়ে বিকৃত করার অপচেষ্টাকে প্রতিহত করতেই হবে।

এদিন সম্মেলনে স্বাগত ভাষণে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলি বলেন, ‘‘সংবিধান রক্ষা, গণতন্ত্র রক্ষা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়ে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখন আমাদের ভাবতে হবে, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে গান্ধীজী যে স্বরাজের কথা বলেছিলেন, তা শুধু স্বাধীনতার প্রাপ্তির জন্য নয়। মানুষের অধিকারের স্বরাজের কথা বলেছিলেন তিনি, যাকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে। তাই সংবিধান শুরুর প্রথম শব্দটাই ছিল এবং রয়েছে ‘উই দ্য পিপল’। এই সংবিধানই মানুষকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে। মানুষের যে অধিকারের কথা সংবিধানে বলা আছে, বর্তমান সরকার তার কোনও কিছুই পরোয়া করছে না। বর্তমান সরকার যেমন দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে সুরক্ষিত রাখতে পারেনি, তেমন দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকেও সুরক্ষিত রাখতে পারছে না। বিচারপতি গাঙ্গুলি এদিন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা, কাশ্মীর থেকে ৩৭০ নম্বর ধারা তুলে নেওয়ার প্রসঙ্গগুলি উল্লেখ করে বলেন, দেশের বর্তমান সরকারের ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে মানুষের সংবিধান প্রদত্ত ভাবনা-চিন্তা মিলছে না। ফলে সংবিধানকে উপেক্ষা করার একটা দানবীয় মানসিকতা কাজ করছে এই সরকারের মধ্যে। এই অবস্থা থেকে রেহাই পেতে হলে দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ পথে এগতে হবে।

এদিন সম্মেলন শুরুর প্রারম্ভিক বক্তৃতায় সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মানুষের চিন্তাভাবনা ও বিশ্বাসকে ভাগ করে দিতে চাইছেন। দেশের শ্রমিকশ্রেণির মধ্যেও বিভেদ তৈরি করতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলছেন। একদিকে সংবিধানের উপর আক্রমণ ও অন্যদিকে সংসদীয় ব্যবস্থার উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। সংসদীয় ব্যবস্থাকে অকেজো করে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। সংসদ থেকে বিরোধী সদস্যদের বহিষ্কারের কাজ শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে গোটা দেশে হিন্দুত্ববাদের প্রচার এবং প্রসারের লক্ষ্যে দেশের সরকার কাজ করছে। সংবিধানে যে ফৌজদারি আইন রয়েছে, সেই আইনকেও সংশোধন করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের উপযোগী আইন তৈরি করা হচ্ছে। এই অবস্থায় বিরাট সংখ্যক আইনজীবীকে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব এআইএলইউ’র। 

এদিনই সম্মেলনে সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেছেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্পাদক পি ভি সুরেন্দ্রনাথ। প্রতিবেদনে গোটা দেশের আইনজীবীদের সংগঠনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, দেশের নির্বাচন কমিশন তৈরি করতে বর্তমান সরকার দেশের শীর্ষ আদালতকেই বাদ দিয়ে দিয়েছে। দেশের নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন নিয়োগে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত দেশের বিচারব্যবস্থার উপর বড় ধরনের আক্রমণ। একদিকে বিচারপতি নিয়োগে কলেজিয়ামের সুপারিশ গ্রহণ না করা, অন্যদিকে দেশের প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করা— এই দু’টি বিষয়ই দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকর। বর্তমান সরকার সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে একক শাসন কায়েম করার পথে অগ্রসর হচ্ছে। এটাই দেশের সামনে বড় বিপদ। এদিনই সম্পাদকীয় খসড়া প্রতিবেদনের উপর প্রতিনিধিদের আলোচনা শুরু হয়েছে। এদিন সম্মেলনের শুরুতে সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি রবিলাল মৈত্র। শহীদবেদীতে মাল্যদান করেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলি, সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক অরিন্দম ভট্টাচার্য প্রমুখ। 

Comments :0

Login to leave a comment