পীযূষ ব্যানার্জি
বড় ভাবনা নিয়ে ধরনায় বসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। এক বছর ধরে গ্রামে গরিবের কাজ নেই। মাথার ওপর ছাদ নেই। রাজ্যের প্রাপ্য টাকা নেই। সরকার চালাতে হলে মানুষের জন্য বড় ভাবনারই কথা।
অনেক ভেবে আর্থিক বছর শেষ প্রহরে এসে মমতা ব্যানার্জি ভাবলেন যা তাতে রবি ঠাকূরের গানের কথাই মনে পড়ে যায়: তোমার আপন খেলার সাথি করো, তা হলে আর ভাবনা তো নাই/ কোন খেলা যে খেলবো কখন, ভাবি বসে সেই কথাটাই।
মার্চ মাসের শেষ পর্বে এসে সেই খেলাই দেখলেন রাজ্যের মানুষ। কলকাতা ময়দানে তাঁবু খাটিয়ে মমতা ব্যানার্জির দল মাতলো রাতভরের এক খেলায়। যে খেলা শুরু হয়েছিল বাংলার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে। কিন্তু তা থাকলো কার্যত কাগজে-পোস্টারে। মঞ্চের পিছনে টাঙানো ব্যানারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খেলা দেখালো মমতা ব্যানার্জির সরকারি প্রশাসন, পুলিশ। পুড়লো ঘরবাড়ি, দোকানপাট। আতঙ্কিত হলো সাধারণ মানুষ। সংখ্যালঘু জনতা। জয় শ্রীরাম স্লোগানের খেলা দেখলো বাংলা।
খেলা হবে— খুবই পছন্দের লব্জ মুখ্যমন্ত্রীর। দু’বছর আগে বিধানসভা নির্বাচনে জেতার জন্য ভাঙা পা নিয়ে হুইল চেয়ারে বসে ফুটবল ছুঁড়তেন মমতা ব্যানার্জি। দলের নির্বাচনী সভায় কর্মীরা মমতা ব্যানার্জির ছোঁড়া বল ধরতেন। বাহবা পেতেন। না ধরলে জুটতো মমতার ব্যানার্জির উষ্মা।
এবারও ধরনা মঞ্চ থেকে বল ছুঁড়েছেন মমতা ব্যানার্জি। নির্ভুল লক্ষ্যে। মাঠের বাইরে থাকা খেলোয়াড়রা সেই বল ধরতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। মুখ্যমন্ত্রীর ছোঁড়া সেই বিষ মাখানো বল ধরে নিপুণ দক্ষতায় রামনবমীর দিন আতঙ্কের খেলা সাঙ্গ করেছেন সঙ্ঘীরা। যার রেশ এখনও রাজ্যে বহমান দেখে ‘তোমার আপন খেলার সাথি’ হওয়ার লক্ষ্যে সফল কালীঘাটও।
কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে বঞ্চনা করছে জানিয়ে ধরনায় বসেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই ধরনাকারী কে? মুখ্যমন্ত্রী না, তৃণমূলের চেয়ারপার্সন? পুরী যাওয়ার পথে ধরনা কর্মসূচি ঘোষণা করার সময় কলকাতা বিমানবন্দরে ঘোষণা করলেন, ‘‘২৯ মার্চ বেলা ১২টা থেকে ধরনায় বসবো। অ্যাজ এ চিফ মিনিস্টার বসবো।’’ দ্রুত বদলে গেল ধরনা মঞ্চ। ঘাসফুলের প্রতীক আঁকা মঞ্চে দলের ধরনায় বসলেন মমতা ব্যানার্জি। তার থেকে একটাই অর্থ দাঁড়ায়, সরকারি টাকায় ধরনামঞ্চ সাজিয়ে নিয়ে দলের স্বার্থ দেখা হলো। সামান্য এক ধরনা মঞ্চ নিয়েও এরাজ্যের শাসকদলকে নিতে হয় ছলের আশ্রয়। সরকারি টাকায় দলের প্রয়োজনে ব্যবহার করার প্রবণতা বাইরে থাকলো গরিবের স্বার্থরক্ষার দাবি আদায়ের মঞ্চে। সঙ্গত প্রশ্ন তাই উঠে যায়, আদৌ কি ১০০দিনের টাকা প্রাপ্তি, মাথার ওপর গরিবের ছাদের টাকার জন্যই মমতা ব্যানার্জি ধরনায় বসতে চেয়েছিলেন? না, তোমার আপন খেলার সাথি হওয়ার উদগ্র বাসনাই মমতা ব্যানার্জিকে রেড রোডে এক রাতের তাঁবু খাটাতে বাধ্য করেছিল?
হযবরল’তে রুমাল বেড়াল হয়েছিল। আর ধরনায় বঞ্চনা ধরা দিল রামনবমীতে!
কী সুন্দর বোঝাপড়া। কী করা উচিত নয়, জানিয়ে মমতা ব্যানার্জি আসলে মিছিলকে বলে দিলেন কী করা উচিত। বেড়ালকে মাছ পাহারার দায়িত্ব দিয়ে ধরনা মঞ্চ থেকে মমতা ব্যানার্জি জানালেন, ‘‘ রামনবমীর মিটিং মিছিল করছেন, করুন। আমাদের আপত্তি নেই শান্তিতে করুন।’’ এখানেই থামলেন না। রমজান মাস চলছে, রোজা চলছে জানিয়ে সংখ্যালঘু এলাকা এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে মিছিলকারীদের ‘মুসলিম এলাকাটা অ্যাভয়েড করুন, পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করবেন না’ শোনালেন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যে আগাম খবর ছিল অস্ত্র নিয়ে, তরোয়াল নিয়ে মিছিল হবে সেটাও বলে রাখলেন।
ফল কী হলো? গতবারও হাওড়ার যে প্রান্তে রামনবমীর মিছিল থেকে অশান্তি হয়েছে এবারও সেই পথে ঘটলো গোলমাল। রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তর নবান্ন যে থানা এলাকায় রামনবমীর অশান্তি এড়াতে পারলো না সেই শিবপুর থানাতেও। যে সরকার প্রশাসনের সদর দপ্তর এলাকায় গোলমালের আগাম খবর সংগ্রহ করতে পারে না, এড়াতে না পারে সাম্প্রদায়িক অশান্তি, তাদের হাতে আদৌ কি সুরক্ষিত এরাজ্যের সম্প্রীতি? হাওড়ার পরে হুগলীও দেখল একই অশান্তি।
রামনবমীর আগের রাতে মুখ্যমন্ত্রীকে মুসলিম এলাকা এড়াতে বলার পরামর্শ দিতে হচ্ছে কেন? এই জরুরি প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে রাজ্য প্রশাসনেরই অন্দরে। যে এলাকায় গতবার গোলমাল-অশান্তি হয়েছে, সেখানে আগাম কী ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ? দৃষ্কৃতীদের চিহ্নিত করে আগাম সতর্কতামূলক গ্রেপ্তার (প্রিভেনটিভ অ্যারেস্ট) করা হয়েছিল কী? এলাকায় চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত কি হয়েছিল? হাওড়া কমিশনারেট এলাকায় গোয়েন্দা রিপোর্টে কী বলা হয়েছিল? তার ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল প্রশাসন? সব দিক বিবেচনা করে রাজ্য প্রশাসনের প্রবীণ শীর্ষ আধিকারিকরা বলছেন, এই গোলমাল সরকার ও সরকারি দলের যোগসাজশ ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব হতে পারে না। গোলমাল হচ্ছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখছে। পুলিশকে এমন অসহায় দর্শক করা হলো কীভাবে? যেখানে অশান্তি সেই জিটি রোডের পাশেই হাওড়া সিটি পুলিশের ব্যারাক। তারপরও এমন নিষ্ক্রিয়তা দেখে প্রশাসনকে আদৌ গোলমাল ঠেকাতে সক্রিয় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কি না তা নিয়েও সন্দেহ থেকে যায়।
বাবরি ধ্বংসের আগে এরাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পরামর্শ যদি সেদিনের প্রধানমন্ত্রী শুনতেন তাহলে এড়ানো যেত ইতিহাসের এক লজ্জাজনক অধ্যায়। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ ইতিহাসের কালো দিন। তার জন্য জ্যোতি বসুদের ধরনায় বসতে হয়নি। কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্য বিজেপি-কে অসভ্য বর্বর বলে গেছেন জ্যোতি বসু। কেন তাঁদের এই বিশেষণ দেওয়া হচ্ছে, তা সরাসরি জ্যোতি বসুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ঐতিহাসিক সৌধকে গাঁইতি দিয়ে গুঁড়িয়ে যাঁরা গর্ব অনুভব করে তাঁদের অসভ্য-বর্বর ছাড়া আর কী বলা যায়, জ্যোতি বসুর উত্তর পেয়ে ছিলেন প্রয়াত বাজপেয়ী।
জ্যোতি বসুই বলতেন, মমতা ব্যানার্জির সব থেকে বড় অপরাধ এরাজ্যে বিজেপিকে রাজনীতির জমি পাইয়ে দেওয়ার। সেই জমি গত এক দশকে কতটা শক্ত ভিত গড়েছে তা আরএসএস’র শাখা বিস্তারেই টের পাওয়া যাচ্ছে। রামনবমীর অস্ত্র মিছিল তো তার নমুনা মাত্র।
ধরনা মঞ্চ থেকে রামভক্তরা পেলেন মমতা ব্যানার্জি দেখানো পথ। সংখ্যালঘুদের মন বুঝতে মমতা ব্যানার্জির দরকার বিজেপি’র ভয় ধরানো। আর বিজেপি’র দরকার হিন্দু খতরে মে হ্যায়- এই আপ্তবাক্য নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি। সাগরদিঘির উপনির্বাচন দেখে শঙ্কিত দুই দলই। তিলজলার নৃশংস শিশু হত্যার পরও প্রশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভে জ্বলছে পুলিশের গাড়ি। আসলে পুড়েছে সরকারের মুখ। বগটুই গণহত্যার বছর পার হওয়ার পরও তৃণমূল বিধায়ক আশিস ব্যানার্জির মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে মহল্লার মানুষ।
আবাস যোজনার তালিকা নিয়ে ক্ষোভের আগুন দেখেছে সরকার। দিদির দূত, দিদির সুরক্ষা কবচের মতো দলীয় কর্মসূচিতেও বাগে আনা যায়নি ক্ষোভের স্রোতকে। আন্দোলন তীব্র হচ্ছে সরকারি কর্মচারী, শিক্ষকদের। কেন্দ্রীয় বঞ্চনার মঞ্চে মমতা ব্যানার্জিকে চোখ রাঙাতে হয়েছে শিক্ষকদের, সরকারি কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে। চোর-ডাকাত পর্যন্ত বলে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছেন। কিন্তু গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে, এটাই যে আগে ঘেউ ঘেউ বলে পার গিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সে সময় সোশাল মিডিয়াতে মিম বানিয়ে ছাড় পেয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। এবার পালটা সমাবেশ করে শহীদ মিনার গর্জে উঠে জবাব দিয়েছে। মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, নিজেদের ভালোর জন্য সাইলেন্ট থাকুন। পালটা কর্মচারীরা ফের ৬ মার্চ কর্মবিরতির আন্দোলনে। পরিস্থিতির এই গুণগত এক পরিবর্তনের সামনে দাঁড়িয়ে এরাজ্য।
সততার মুখোশ খসে পড়েছে। কোটি, কোটি টাকার দুর্নীতি এখন প্রকাশ্যে। শিক্ষকতা থেকে সরকারি চাকরির এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে নিয়োগ দুর্নীতি গ্রাস করেনি মমতা ব্যানার্জির দলের শীর্ষ নেতাদের। জেল থেকে আদালতে আসার পর প্রিজন ভ্যান থেকে নামার সময় গুনতি করেন পুলিশ কর্মীরা। টিভির পর্দায় দেখা যায় সেই দৃশ্য। ভ্যানের দরজায় দাঁড়িয়ে পুলিশকর্মী বলেন, এক। গাড়ি থেকে নামেন প্রাক্তন উপাচার্য সুবীরেশ। পুলিশকর্মী বলেন, দুই। জালগাড়ি থেকে নামেন মানিক ভট্টাচার্য। পুলিশ হাঁকেন, তিন, গাড়ি থেকে নামেন কল্যাণময় গাঙ্গুলি। প্রিজন ভ্যানে আটক গোটা শিক্ষা দপ্তর। পুলিশের গুনতির মধ্য দিয়ে টুপাটাপ করে গাড়ি থেকে নেমে আদালতের অন্দরে সেঁধিয়ে যায় চোর-ডাকাতরা। আর ধরনা মঞ্চ থেকে এরাজ্যের শিক্ষক, সরকারি কর্মচারীদের চোর ডাকাত বলে কদর্য ভাষায় আক্রমণ করে যান মমতা ব্যানার্জি।
২৯ মার্চ সন্ধ্যা থেকে ধরনা ৩২ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি মতোই গুটিয়ে নিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি ও তাঁর দল। তাৎপর্যপূর্ণভাবে বলেছেন, এতক্ষণ ধরনায় বসে কেউ তো একবার ভদ্রতা করেও বলল না, তোমাদের ১০০ দিনের টাকটা দিয়ে দেব। ১লক্ষ ১৫ হাজার কোটি টাকা প্রাপ্য মিটিয়ে দেব। কিছুই না। সব ভোঁ ভাঁ।
আসলে কিছুই ভোঁ ভাঁ হয়নি। যে খেলাটা ধরনা মঞ্চে খেলার কথা ছিল, খেলার সাথি হয়ে ফের একবার ভেবে দেখার বার্তা দিয়ে রাখলেন মমতা ব্যানার্জি।
Comments :0