গল্প | নতুনপাতা
নারকেল নাড়ু
সৌরীশ মিশ্র
যমজ বোন রিনি আর ঝিনি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে। বাড়ির একেবারে কাছেই তাদের স্কুল। দুই বোন একসঙ্গে হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে যায়-আসে।
ফুটপাথ ধরে হাঁটছে এখন ওরা। একটু এগোলেই সামনে বাস-রাস্তা। সেই রাস্তাটা ক্রস করলে একটা মোড় পড়ে। সেই মোড়টা ঘুরলেই ওদের পাড়া।
আজ লাস্ট পিরিওডে সুতপাম্যামের ম্যাথস্ ক্লাস ছিল। হঠাৎই ঐ ক্লাসে একটা সারপ্রাইজ় টেস্ট নিয়েছেন উনি। রিনি-ঝিনি দুই বোনেরই অঙ্ক ফেভারিট সাবজেক্ট। তাই, টেস্টটা দু'জনরেই ভালোই হয়েছে। সেই নিয়েই কথা বলছে ওরা এখন। আর, বলতে বলতেই বাস-রাস্তাটার সামনে এসে পড়ল ওরা।
এবার রাস্তা ক্রস করতে হবে ওদের। এই রাস্তাটা সব সময়ই ভীষণই ব্যস্ত থাকে। রাস্তা ক্রস করার আগে এদিন-ওদিক ভাল করে দেখতে থাকে তাই ওরা।
আর, তখনই, দুই বোনেরই চোখে পড়ল একসঙ্গে দৃশ্যটা।
রিনি-ঝিনি বাস-রাস্তাটার যে পাশে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তার বিপরীত দিক থেকে এক বৃদ্ধা রাস্তা পার হয়ে এইদিকে আসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু, কোনো না কোনো যানবাহন এসে যাওয়ায় পারছেন না তিনি রাস্তাটা ক্রস করে এদিকে আসতে কোনো মতেই। কয়েক পা এগিয়ে ফের তিনি পিছিয়ে যাচ্ছেন। উঠে পড়ছেন ফুটপাথে।
"দেখছিস বোন, দিদাটা কিছুতেই রাস্তা ক্রস করতে পারছেনা।" রিনিকে বলে ঝিনি।
"হ্যাঁ রে। তাই তো দেখছি।"
"চল্ না, আমরা ওঁকে হেল্প করি গিয়ে।"
"আমিও সেটাই ভাবছিলাম রে।"
"তাহলে চল্।"
"চল্।"
রিনি আর ঝিনি সাবধানে রাস্তা পার হতে থাকে। এবং, কয়েকক্ষণে পারও হয়ে যায় রাস্তাখানা। পায়ে-পায়ে ওরা গিয়ে দাঁড়ায় সেই বৃদ্ধার পাশটায়। তারপর বৃদ্ধাকে রিনি বলে, "দিদা, রাস্তা পার হবে তো?"
বৃদ্ধা তাকান রিনির দিকে। বলেন, "হ্যাঁগো দিদিভাই। দ্যাখো না, তখন থেকে চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই পারছিনা।"
"কোনো চিন্তা কোরো না দিদা। আমরা তোমায় পার করে দিচ্ছি।" এবার বলে ঝিনি। "আমাদের হাত ধর তুমি। তারপর ধীরে-ধীরে আমাদের সাথে-সাথে চলো।"
বৃদ্ধার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় দুই বোন। বৃদ্ধাও তাঁর দু'হাত এগিয়ে দেন। বৃদ্ধার ডান হাতটা ধরে রিনি। বাঁ হাতটা ঝিনি। তারপর, দুই বোন বৃদ্ধার দু'হাত ধরে ওনাকে মাঝখানে নিয়ে রাস্তা পার হতে থাকে অতি সাবধানে। এক সময় পারও হয়ে যায় রাস্তাটা ওরা।
ফুটপাথে উঠে রিনি, ঝিনির দিকে তাকান ঐ বৃদ্ধা। তারপর, সস্নেহে দু'জনের গালে হাত বুলিয়ে আদর করে দেন।
"তাহলে দিদা, আমরা এবার যাই।" বলে রিনি।
"একটুখানি দাঁড়াও তোমরা।" সাথে-সাথেই বলে ওঠেন বৃদ্ধা। আর বলতে বলতেই তাঁর কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগটা থেকে একটা প্লাস্টিকের ছোটো চ্যাপ্টা টিফিন বাক্স বের করেন তিনি। তারপর, সেটার ঢাকনা খোলেন তিনি কাঁপা-কাঁপা হাতে। আর, ঢাকনাটা খুলতেই রিনি আর ঝিনি দেখতে পেল, আটটা নারকেল নাড়ু পরপর বাক্সটায় রাখা।
"হাত পাতো তো তোমরা।" বলেন বৃদ্ধা।
রিনি-ঝিনি হাত পাতে।
বৃদ্ধা রিনিকে চারটে নাড়ু দেন। ঝিনিকে চারটে।
"আমার কাছে তো তোমাদের দেওয়ার মতো আর কিছু নেই। দেখে তো মনে হচ্ছে, তোমরা স্কুল থেকে ফিরছো। নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। এটা খেতে-খেতে বাড়ি যাও, কেমন।"
"থ্যাংক ইউ দিদা।" প্রায় সমস্বরে বলে রিনি আর ঝিনি।
"ও আবার কি কথা! দিদাকে থ্যাংক ইউ আবার বলে নাকি কোনো নাতনি! তোমরা এবার আসো। তোমাদের তো আবার রাস্তা ক্রস হতে হবে। সাবধানে, কিন্তু। আমিও যাই।" খালি টিফিন বাক্সটা ব্যাগে ফের রাখতে-রাখতে বলেন বৃদ্ধা।
মাথা নাড়ে রিনি, ঝিনি দু'জনই।
বৃদ্ধা রিনি, ঝিনির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে একটু হেসে বিদায় নেন দুই বোনের কাছ থেকে।
রিনি আর ঝিনি দেখতে থাকে বৃদ্ধা ধীর পায়ে ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলেছেন। ঐ দৃশ্য দেখতে-দেখতে দুই বোনই একটি করে নারকেল নাড়ু তাদের মুখে পোড়ে। আর একটু খেতেই, রিনি বলে ওঠে, "নাড়ুটা কি দারুণ খেতে না রে?"
"হ্যাঁ রে, সত্যিই দারুণ।"
বৃদ্ধা ততক্ষণে ফুটপাথে মানুষের ভিড়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছেন। রিনি আর ঝিনি দেখতে পাচ্ছে না ওনাকে আর। দুই বোন নারকেল নাড়ুগুলো খেতে-খেতে পা বাড়ায় ওদের বাড়ির দিকে।
Comments :0