স্বাধীন সাংবাদিকতা না থাকলে ভারতের গণতন্ত্র শূন্যগর্ভে পরিণত হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শশী কুমার। বুধবার গণশক্তির ৫৮তম প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি প্রত্যাশাও প্রকাশ করেছেন, গণশক্তির মতো পত্রিকাগুলি নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠীর জোরে ক্ষমতাসীনদের কাছে নতিস্বীকার করবে না বলেই আমি বিশ্বাস করি। গণতন্ত্রে সবসময়েই বহু স্বর ও মতামত প্রকাশ করার মতো বহু স্বাধীন মিডিয়া থাকা দরকার। কিন্তু বর্তমানের অভিজ্ঞতা হলো, মিডিয়ার বড় অংশই শাসকদের ট্রোল বাহিনীর অথবা চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ফেলে, ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছায় ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য প্রচারেই নিজেদের ভাসিয়ে দেয়। গণশক্তি সেইরকম ভঙ্গুর নয়।
তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, গণতন্ত্রের শর্ত নাগরিকদের তথ্যে সমৃদ্ধ থাকতে দেওয়া, বহু মত জানার সুযোগ দেওয়া। নইলে কেবল নির্বাচনে ভোট দিয়ে সরকার গঠনের অধিকার থাকার মানে গণতন্ত্র নয়। বাক স্বাধীনতাহীন ওরকম নির্বাচনের পথ বেয়েই তো হিটলারের মতো ফ্যাসিবাদীরা ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন।
বুধবার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনের অডিটোরিয়ামে গণশক্তির প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে ‘আক্রান্ত সংবাদমাধ্যম বিধ্বস্ত গণতন্ত্র’ বিষয়ে ভাষণ দেন শশীকুমার। দশ বছরের বিজেপি জমানায় দেশে এবং বাংলার বুকে তৃণমূল জমানায় বাক স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে এই অনুষ্ঠানেই সোচ্চার ছিলেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং গণশক্তি ট্রাস্টের সভাপতি বিমান বসু। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় গণশক্তি পত্রিকার ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেছেন তাঁরা। এই প্রসঙ্গেই শশী কুমার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হিসাবে তুলে ধরেছেন। তিনি একথাও বলেছেন, কারো কারো ধারণা আছে যে সমাজতন্ত্রেও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে না। কিন্তু কার্ল মার্কস যিনি নিজে নিউইয়র্ক ট্রিবিউয়নের ইউরোপের সংবাদদাতা হিসাবে উপার্জন করেছেন তিনিই লিখে গিয়েছেন, ‘সেনসরশিপ কখনোই বৈধ হতে পারে না, আইনসম্মত হলেও নয়।’
কিন্তু ভারতে সেই সেনসরশিপই চলছে ক্ষমতাসীনদের নানা কৌশলে। ফলি নরিম্যানের বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য উল্লেখ করে শশী কুমার বলেছেন, ‘এখনও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, তবে মত প্রকাশের পরে আর কোনও স্বাধীনতা নেই।’ দৃষ্টান্ত হিসাবে নিউজক্লিকের সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারি, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ইডি হানা ইত্যাদিও তুলে ধরেন তিনি।
ভারতের সংবিধানের ১৯(১) (ক) ধারায় সব নাগরিকদের বাক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া আছে এবং পরবর্তী ধারা ১৯(২) তে যুক্তিসম্মত বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। শশী কুমারের অভিযোগ, যুক্তি শিকেয় তুলে এখন ইউএপিএ’র মতো দানবীয় আইন প্রয়োগ করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো পূর্ববর্তী ধারাকে নস্যাৎ করতে পরবর্তী ধারার অপপ্রয়োগ হচ্ছে। তাতে বেআইনি হেনস্তা এতই দীর্ঘ যে সেটাই গুরুতর শাস্তি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা স্বল্পকালীন ছিল, এখন ভারতীয় সংবিধানে ধাপে ধাপে গণতন্ত্রের ক্ষয় ঘটানো হচ্ছে। এটা আরও বেশি বিপজ্জনক, কারণ এর পরিণতি কোথায় পৌঁছাবে আমরা জানি না।
সরকার বা ক্ষমতাসীনদের প্রতি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রাখাটা সমাজে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেছেন শশী কুমার। তিনি বলেন, গণতন্ত্রকে খাড়া রাখতে এটাই মিডিয়ার দায়িত্ব, এই জন্যই তাকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। কিন্তু মিডিয়া এখন ক্ষমতাসীনদের প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হয়ে গেছে। ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে সংবাদপত্রের ইতিহাস রয়েছে, গান্ধীজী ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’এ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ধারণা ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন। সেই ভারতে এখন বিপরীত চিত্র! নয়া উদারনীতিতে মিডিয়া যখন কেবলই মুনাফাচালিত একটি শিল্পমাত্রে পরিণত হয়েছে, সাংবাদিকতার নৈতিক ভিত্তিও তখনই ধসে গেছে। আর গত দশ বছরে এমন একটা সরকার বসেছে যারা মিডিয়ার স্বাধীনতাকেই বিপজ্জনক মনে করে। মূল ধারার বৃহৎ মিডিয়া মিথ্যার স্রোত বইয়ে দিচ্ছে। মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেছে। পুরানো মিডিয়ার পাশাপাশি নয়া প্রযুক্তির সোসাল মিডিয়াকেও এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সোসাল মিডিয়া নিঃসন্দেহে নাগরিদের বাকস্বাধীনতার একটা বিকল্প পরিসর, সাধারণ নাগরিকরা কজন আর ‘ফেক নিউজ’ রটাচ্ছে? কিন্তু ক্ষমতাসীনরাই ট্রোল ফার্মের মাধ্যমে ফেক নিউজ ছড়াচ্ছে। মিথ্যার কার্পেট বোম্বিং করছে সমস্ত ধরনের মিডিয়াকে ব্যবহার করে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই গণশক্তির মতো সত্য প্রকাশে দৃঢ় সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতি আশা প্রকাশ করে শশী কুমার বলেছেন, মিথ্যা দিয়ে সত্যকে অপসারণের সময় নীরবতাও আসলে মিথ্যা বলা। যে সব মিডিয়া চুপ করে থাকছে তারাও আসলে মানুষকে মিথ্যার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে।
এদিনের সভায় সভাপতিত্ব করেছেন গণশক্তি ট্রাস্টের সভাপতি বিমান বসু। গণআন্দোলনের সহায়ক ভূমিকায় গণশক্তিকে অপরিহার্য উল্লেখ করে সভায় মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘নবান্ন এবং ছাপ্পান্নকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সাতান্ন থেকে আটান্ন বছরে গণশক্তি পত্রিকা। বিকল্প ভাষায় মানুষের কথা বলেছে, দুর্নীতির পর্দা ফাঁস করেছে গণশক্তি। অকপটে প্রথম মানুষকে জানিয়েছে। এখন যাঁরা দুর্নীতির কথা বলছে তাঁরা পুরানো ‘গণশক্তি’ পড়লে দেখতে পাবেন।’
Comments :0