দিল্লি যাওয়ার কর্মসূচিকে অনিশ্চিত রেখে বিজেপি’র বাংলা ভাগের চক্রান্ত নিয়ে দিনভর মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেন মমতা ব্যানার্জি!
বৃহস্পতিবার দিনভর বাড়িতেই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সন্ধ্যায় প্রাক্তন বিচারপতি সুশান্ত চ্যাটার্জির মৃত্যুর খবরে পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন। কিন্তু নীতি আয়োগ থেকে রাজ্যভাগ, সব কিছুতেই নীরব ছিলেন মমতা ব্যানার্জি।
বৃহস্পতিবার দুপুরেও মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লি যাওয়ার কর্মসূচি নিশ্চিত ছিল। বিমানবন্দরে প্রস্তুত ছিল চাটার্ড বিমানও। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দিল্লি যাওয়ার কর্মসূচি স্থগিত করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিন দিল্লি পৌঁছে সন্ধ্যায় তৃণমূলের সংসদীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে তাঁর থাকার কথা ছিল। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল শনিবার নীতি আয়োগের বৈঠকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর যোগদান। একইসঙ্গে তাঁর দিল্লি সফর পর্বে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ করতে চেয়ে নবান্নের মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল।
আগামী শনিবার নীতি আয়োগের বৈঠকে আদৌ মমতা ব্যানার্জি যোগ দিতে যাবেন কিনা, সেটাও স্পষ্ট নয়। এদিন দিল্লি যাত্রা স্থগিত করলেও মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে আসেননি। এমনকি, এরাজ্যে ভাগ করার জন্য যখন বিজেপি’র সাংসদ নিশিকান্ত দুবে সংসদে দাঁড়িয়ে এরাজ্যের জনবিন্যাসের পরিবর্তনের প্রসঙ্গ তুলে বাংলার দুই জেলা মুর্শিদাবাদ ও মালদহকে আলাদা করে বিহারের একাংশের সঙ্গে যুক্ত করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার হুমকি দিচ্ছেন, সেটা জানার পরেও মুখ্যমন্ত্রী একটি কথা বলেননি। আসলে গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ থেকে বিজেপি’র নেতারা রাজ্যে এসে মুসলমানদের ‘ঘুষপেটিয়া’বলে আক্রমণ করে গিয়েছেন। এমনকি মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির কল্পিত তথ্য সামনে এনে রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকার জনবিন্যাসের পরিবর্তন ঘটার উসকানি দিয়ে গিয়েছিলেন। তখনও তার প্রতিবাদ করে ভোট প্রচারে একটি কথাও বলেননি মমতা ব্যানার্জি। ধর্মীয় মেরুকরণকে নিজের দলের রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে ব্যবহার করেছে তৃণমূল।
মুখ্যমন্ত্রীর নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত ও বিজেপি’র প্রকাশ্যে রাজ্যভাগের চক্রান্ত প্রসঙ্গে মমতার ব্যানার্জির নীরবতাকে তীব্র আক্রমণ করেছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ ইন্ডিয়া ব্লক নিয়ে মমতা ব্যানার্জি কখনই নীতিগত অবস্থান নিতে পারেননি। সবসময় ফায়দা তোলার চেষ্টা করে গেছেন। বিজেপি সাংসদ অনন্ত রায় কোচবিহারকে আলাদা রাজ্যের দাবি তুলেছেন। ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সাংসদ রাজ্য ভাগের দাবি সংসদে তুলছেন। তখন মমতা ব্যানার্জি চুপ। অথচ বাংলাদেশ নিয়ে রাজনৈতিক জনসভাতে সোচ্চার হচ্ছেন। বিদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক সভাতে বক্তব্য রাখা কূটনীতি বিরোধী। বিশেষ করে সাংবিধানিক পদে থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। মুখ্যমন্ত্রীর তো অনেক প্রাক্তন আমলাদের উপদেষ্টা করেছেন। তাঁরা কী উপদেশ দিতে পারছেন না!’’
মমতা ব্যানার্জি যে নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিচ্ছেন, নিজেই গত মঙ্গলবার বিধানসভায় স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় বিধানসভায় নিজের ঘরে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ‘‘ বৈঠকের আগে আমাদের কাছ থেকে লিখিত বক্তব্য চেয়ে পাঠানো হয়েছিল। আমাদের যা বকেয়া আছে তা আমরা লিখে পাঠিয়েও দিয়েছি। এরপর বৈঠকে আমার বলার সময় রাজ্যের বিষয় নিয়ে বলবো।’’ অর্থাৎ গত মঙ্গলবারই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে ছিলেন তিনি নয়াদিল্লিতে নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিতে যাচ্ছেন। এমনকি, দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে প্রশ্ন শুনে ক্ষোভ প্রকাশ করে তার জবাবও এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
সংসদে বাজেট পেশের পরই গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইন্ডিয়া ব্লকের দলের নেতারা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে কেন্দ্রীয় বাজেটকে ‘চরম বৈষম্যমূলক’ ও ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিরোধী’বলে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে কংগ্রেস শাসিত তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা নীতি আয়োগের বৈঠক বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়। একইসঙ্গে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্টালিন, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনও জানিয়ে দেন, তাঁরাও কেন্দ্রের বৈষম্যমূলক বাজেট পেশের প্রতিবাদ জানিয়ে নীতি আয়োগের বৈঠক বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপরে পাঞ্জাবের আপ দলের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত সিং মানও বৈঠক বয়কট করার কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু ইন্ডিয়া ব্লকের বৈঠকে উপস্থিত থেকে তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও ব্রায়েন জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘‘ কেন্দ্রের বাজেট নিয়ে তাঁদের বিরোধিতা থাকলেও বাংলার বঞ্চনার কথা জানাতে মমতা ব্যানার্জি নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দেবেন।’’ লোকসভা নির্বাচন পর্বে ইন্ডিয়া ব্লকের সিদ্ধান্ত তিনি জানতে পারেন না, বলে অভিযোগ করতে অভ্যস্ত ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু নীতি আয়োগের বৈঠক যখন বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া ব্লকের সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একযোগে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিলেও তৃণমূল অনড় ছিল। মমতা ব্যানার্জির এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় বিজেপি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও রাজ্য বিজেপি’র সভাপতি সুকান্ত মজুমদার মমতা ব্যানার্জির নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে জানান, ‘‘ এতদিন তো উনি (মমতা ব্যানার্জি) আসছিলেন না। ওঁর শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে।’’
কংগ্রেস সহ বিজেপি বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীদের সাত জনের নীতি আয়োগের বৈঠকে প্রকাশ্যে অনুপস্থিত থাকার ঘোষণায় কার্যত চাপে পড়ে গিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। ফলে দিল্লি গিয়ে বৈঠকে যোগ দেওয়া বা না দেওয়া নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত না নিতে পারায়, মুখ্যমন্ত্রীর রাজধানী সফর নিয়ে দলের তরফে কোনও উচ্চবাচ্য করা হচ্ছে না। আবার দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সময় চেয়েও বিপাকে মুখ্যমন্ত্রী। মহম্মদ সেলিম জানিয়েছেন, ‘‘ কোর্টের রক্ষাকবচ এখন আর নেই। ফলে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে রক্ষাকবচের জন্য দেখা করা জরুরি।’’এরইসঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যেভাবে গত ২১ জুলাই দলের সমাবেশে মমতা ব্যানার্জি বক্তব্য রেখেছেন, তা ভালোভাবে নেয়নি ঢাকা। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকও মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে অখুশি। সব দিক ভেবে আপাতত নীরব থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
Mamata banerjee
আচমকাই দিল্লি যাত্রা স্থগিত মমতার
×
Comments :0