‘‘টুসু হামার সাধের বিটি/ চুল বাঁধেছে পরিপাটি।/ বিহা দিব টুসুমনির/ কুটুম দেখে মানুষ খাঁটি।/ টুসু মাকে বিদায় দিতে/ বুক ফ্যাটে যায় দরদে।।/ অকর মকর চকর পরবে /তরা পিঠা খা ল গরবে।’’
পুরুলিয়া জেলার প্রাণের উৎসব হচ্ছে টুসু পরব। এক মাসের দীর্ঘ প্রস্তুতির পর পৌষ সংক্রান্তির দিন শেষ হয় সেই টুসু পরব। কৃষি কেন্দ্রিক সারা বছরের সমস্ত উৎসব যেন টুসু পরবে এসে পূর্ণতা লাভ করে। পুরুলিয়া জেলার শ্রেষ্ঠ উৎসব তাই টুসু। এই সময় কাজের সন্ধানে যারা বাইরে চলে গেছেন তারাও সাধ্যমত পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে আসেন। উৎসবের কয়েকটা দিন কাটিয়ে ফের তারা ফিরে যান নিজের নিজের কর্ম ক্ষেত্রে। সকাল থেকেই গোটা পুরুলিয়া জেলা জুড়েই যেন অঘোষিত বনধ। সমস্ত ভিড় কেন্দ্রীভূত হয় জেলার বিভিন্ন নদী এবং জলাশয় গুলিতে। কান পাতলে শোনা যায় টুসু সঙ্গীত। মানুষের আনন্দ, দুঃখ, সুখ, ব্যথা-বেদনা, অভিজ্ঞতা, দৈনন্দিন জীবনের রোজ নামচা এই গান গুলির মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। এই উৎসব মূলত মহিলাদের উৎসব। সকাল থেকেই তারা নতুন পোশাক পড়ে মাথায় চতুর্দলা বসিয়ে টুসু গান গাইতে গাইতে জলাশয়ের ধারে যায়। জলাশয়ের জলে টুসুকে বিসর্জন করেন। এদিন জেলার নানা প্রান্তে ছোট বড় বহু মেলা বসে। অনেক জায়গায় আবার টুসুর প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয়।
টুসু কোনো দেবতা নয়। অঘ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিন থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত একমাস ধরে চলে টুসুর উৎসব। সাধারণত অঘ্রহায়ন মাসে নতুন ধান ঘরে তোলা হয়। সেই ধানের তুষ তুলে রাখেন মেয়েরা। পৌষের শুরুতেই সেই তুষ নিয়ে মাটির সরাতে রাখা হয়। সেটি আরেকটি সরার ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। রাখা হয় কোন বিশেষ জায়গায়। এটিই হলো টুসু। মহিলারাই প্রত্যেকদিন সন্ধ্যেবেলায় সেই সরাতে আরাধনা করে গান বাজনা করেন। টুসু যখন তখন হয়ে ওঠে তাদের সমবয়সী। টুসু এক ঘরের মেয়ে। তাই সমস্ত মহিলারাই তখন টুসু হয়ে ওঠেন। এক মাসের নানা ব্যস্ততার পর এই উৎসবের পরিসমাপ্তি হয় পৌষ সংক্রান্তির দিন। রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো চতুর্দলায় সেই সরা বসিয়ে গান গাইতে গাইতে টুসু ভাসানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় টুসু পরব। এই পরবের রেশ চলে বেশ কয়েকদিন ধরেই।
Comments :0