নিখোঁজ হয়েছেন এক বছরে ৪৩,০৫৪ জন মহিলা। তাঁদের মধ্যে পাচারের শিকার? মাত্র ৬১ জন!
রাজ্য পুলিশের এমনই দাবি। অমিত শাহ্ নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তা মেনেও নিয়েছে। অর্থাৎ নিখোঁজ মহিলাদের ৯৯.৮৬ শতাংশ হয় স্বেচ্ছায়, রাগ, অভিমান করে, বিয়ের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। পাচার হয়েছেন মাত্র ০.১৪ শতাংশ। অন্তত রাজ্য পুলিশ তাই দাবি করেছে।
হারিয়ে যাওয়া মহিলাদের বড় অংশ পাচারকারীদের কবলে পড়েন। উত্তরবঙ্গের চা বাগান এলাকা, সুন্দরবনের ব্লকগুলি এবং রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের জঙ্গলমহল নারী পাচারকারীদের প্রধান ‘টার্গেট।’ কিন্তু এর বাইরেও রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় পাচারকারী গোষ্ঠীগুলির আড়কাঠি(এজেন্ট)দের তৎপরতা আছে। রাজ্যে নিখোঁজ মহিলাদের জেলাওয়াড়ি তালিকা দেখলে বোঝা যাচ্ছে কৃষি প্রধান পূর্ব বর্ধমান, দুই মেদিনীপুর, বারুইপুর জেলা পুলিশ এলাকা, কলকাতা, কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার মতো বেশ কিছু জায়গায় মহিলাদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজের সুযোগ করে দেওয়ার অছিলায় মহিলাদের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। কৃষির সঙ্কটে বিধ্বস্ত এলাকায় বাড়ছে গৃহবধূদের ‘হারিয়ে যাওয়া’র ঘটনা। নিখোঁজ মহিলাদের বড় অংশ ২০ থেকে ৪৮-৪৯-এর মধ্যে।
কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ ‘মিসিং ডায়েরি’তেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ রাখছে। ফলে যে মহিলারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুম্বাই, রাজস্থান, নয়াদিল্লি, নেপাল, চেন্নাই সহ বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছেন পাচারকারীদের কবলে পড়ে, তাঁদের ‘হারিয়ে যাওয়া’ পাচারের ঘটনা হয়ে উঠছে না পুলিশের খাতায়। শুধু ২০২৩ –এ পশ্চিমবঙ্গের ৪৩,০৫৪জন মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি ঘটনায় রাজ্যে গড়ে প্রায় ৫জন মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন। তবে পূর্ব মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমানের মতো কয়েকটি জেলায় এই হার ৭জনের বেশি।
কিন্তু এমন রাজ্যে ‘ট্রাফিকিং’ বা পাচারের অভিযোগ দায়ের হয়েছে সারা বছরে মাত্র ৫৬টি। পাচারের শিকার বলে পুলিশ মেনেছে মাত্র ৬১জনকে। কিন্তু পুলিশ এও জানাচ্ছে যে, ওই ৬১জন পাচার হওয়া মহিলার মধ্যে নাবালিকা ৪৪জন। নাবালিকারাই পাচারের শিকার হচ্ছেন বেশি। অন্তত পুলিশ রিপোর্ট তাই বলছে। পুলিশের কারসাজি এই ক্ষেত্রেও। কাজের অছিলায় পাচারের ব্যাখ্যা ধাক্কা খাবে নাবালিকা পাচার বেশি হলে। যদিও ‘নিখোঁজ’-এর তালিকা বলছে সাবালিকা, গৃহবধূরাই সেই তালিকায় বেশি। যাঁদের বড়ো অংশ পাচারকারীদের শিকার হয়েছেন।
পাচার, নিখোঁজের এই ফারাকের মধ্যে লক্ষণীয় হলো বিচারের হাল। রাজ্য পুলিশের দাবি মতো ৫৬টি মানব পাচারের অভিযোগ দায়ের হয়েছে এক বছরে। গ্রেপ্তার হয়েছে ১৯৬জন। দোষী সাব্যস্ত করা গেছে মাত্র ১৪জনকে। আদালতে বিচার শেষ হয়েছে মাত্র ১৪টি কেসের। পুলিশের ঠিকমতো মামলা সাজাতে না পারা পাচারের ঘটনায় বিচার দ্রুত সম্পন্ন না হওয়ার একটি বড় কারণ।
হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয়। হারিয়ে যাওয়া মহিলার বিচারে? পশ্চিমবঙ্গ প্রথম।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো(এনসিআরবি)-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, রাজ্যের প্রায় এক লক্ষ ২৫ হাজার মানুষের খোঁজ নেই। ২০২২ এবং ২০২৩-এ রাজ্যে এত মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মহিলা আছেন ৮১,৯০২জন। রাজ্য পুলিশের তথ্য অনুসারে নিখোঁজদের মধ্যে ট্র্যান্সজেন্ডার নেই। পুরুষ আছেন ৩৮,৩৪৩জন। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা ১,২০,২৪৫। রাজ্যের মোট নিখোঁজের ৬৮ শতাংশের বেশি মহিলা।
দেশে নিখোঁজদের হিসাবে শীর্ষে মহারাষ্ট্র। সেখানে প্রায় ১লক্ষ ২২হাজার মানুষের সন্ধান নেই। তবে নিখোঁজ মহিলাদের বিচারে মহারাষ্ট্র তৃতীয়। দ্বিতীয় মধ্য প্রদেশ। সেখানে নিখোঁজ ৭৪,১০২জন মহিলা। নিখোঁজদের মধ্যে মধ্য প্রদেশে মহিলারা গ্রায় ৭১ শতাংশ।
রাজ্য পুলিশের ৩৯টি ক্ষেত্র আছে। তার মধ্যে কলকাতা পুলিশের এলাকা আছে, হাওড়া, খড়গপুর এবং শিলিগুড়ি জিআরপি আছে। বাকিগুলি বিভিন্ন পুলিশ জেলা। রাজ্য পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ২০২৩-এ মহিলা নিখোঁজে সবার আগে পূর্ব মেদিনীপুর। সেখানে ওই বছর ২৬৫৭জন মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন। দ্বিতীয় স্থানে আছে পূর্ব বর্ধমান। সেখানে এক বছরে নিখোঁজ হয়েছেন ২৫০২জন মহিলা। তৃতীয় স্থানে আছে পশ্চিম মেদিনীপুর। সেখানে নিখোঁজ হয়েছেন ২৪৫৭জন মহিলা। চতুর্থ স্থানে আছে কলকাতা। মহানগরে এক বছরে নিখোঁজ হয়েছেন ২২৭৫জন মহিলা। পঞ্চম স্থানে আছে কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলা। সেখানে নিখোঁজ হয়েছেন ২১৪৯জন। তারপর আছে বারুইপুর পুলিশ জেলা। সেখানে এক বছরে নিখোঁজ মহিলার সংখ্যা ২১৪৬ জন। আবার রায়গঞ্জের মতো ছোট পুলিশ জেলায় এক বছরে নিখোঁজ হয়ে গেছেন ৯১৪ জন মহিলা। কালিম্পঙের মতো ছোট জেলায় সেই সংখ্যা ১৩০ জন।
তবে এই সবই কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে পাঠানো রাজ্যের স্বরাষ্ট্র(পুলিশ) দপ্তরের তথ্য। অনেক ক্ষেত্রে মহিলারা নিখোঁজ হলে পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয় না। বিশেষত গরিব পরিবারগুলির ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশি। মমতা ব্যানার্জি ভিলেজ পুলিশ পদ তৈরি করেছিলেন। তা আছেও। তবে তারা মূলত স্থানীয় পুলিশের এজেন্ট হিসাবে কাজ করে বলেই অভিযোগ। গ্রামের কোনও বাড়ির কোনও মহিলাকে পাওয়া যাচ্ছে না, তার হদিশ তারা বিশেষ রাখে না।
women trafficking
প্রতি ঘণ্টায় পাঁচজন মহিলা হারিয়ে যাচ্ছেন এরাজ্যে
×
Comments :0