ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে কি ফের সংরক্ষণ প্রধান অ্যাজেন্ডা হয়ে উঠল? গত কয়েকদিনে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, জে পি নাড্ডা, আদিত্যনাথ থেকে শুরু করে বিজেপি নেতারা সবাই প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে তাঁরা সংরক্ষণের বিরোধী নয়। কিন্তু আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত যেভাবে এই বিতর্কে যেচে নেমে পড়েছেন, তাতে এই ধারণাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সংরক্ষণ নিয়ে জমিতে বিজেপি’র ভিত্তিতে নাড়া পড়েছে। তা ঝড়ে পরিণত হয়ে উপড়ে ফেলতে পারে সরকার, এই আশঙ্কায় আসরে নামতে হয়েছে এমনকি ভাগবতকেও। অন্যদিকে, সোমবারও রাহুল গান্ধী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী, বিজেপি নেতারা এবং আরএসএস সংবিধান বদল করতে চাইছে। যে সংবিধান গরিবদের সংরক্ষণ ও অধিকার দিয়েছে, তা কেড়ে নিতে চাইছে বিজেপি। সমাজবাদী পার্টি নেতা অখিলেশ যাদব বলেছেন, এবারের লোকসভা ভোট হলো ‘সংবিধান মন্থন’। গণতন্ত্র এবং সংবিধানের রক্ষাকারী এবং ধ্বংসকারীদের মধ্যে লড়াই।
রবিবার হায়দরাবাদের এক অনুষ্ঠানে বিষয়ের বাইরে গিয়ে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত সংরক্ষণ সম্পর্কে সঙ্ঘের অবস্থান নিয়ে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি দাবি করেন, যবে থেকে সংরক্ষণ এসেছে তখন থেকে সংবিধান সম্মত সমস্ত সংরক্ষণকে সঙ্ঘ পূর্ণ সমর্থন দিয়ে আসছে। যতদিন ভেদভাব আছে সংরক্ষণ থাকা উচিত! কিন্তু সংরক্ষণ প্রশ্নে সঙ্ঘের ইতিহাস ভাগবতের দাবিকে সমর্থন করে না। ভিপি সিং ১৯৯০ সালে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ মেনে সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় ২৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণের ঘোষণা করলে আরএসএস মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ লেখা হয়, ‘‘ব্রিটিশরা তাদের দেড়শো বছরের বিদেশি শাসনে যা করতে পারেনি, তা এক বছরে অর্জন করতে চাইছেন ভিপি সিং। ... সমাজের মণ্ডলীকরণ করে ভিপি সিং চাইছেন হিন্দুদের উঁচু, পিছড়ে এবং হরিজন লাইনে বিভাজন করতে।’’ বিহারে গত বছর জাতভিত্তিক গণনার রিপোর্ট প্রকাশ করার পরে ঠিক এই ভাষাতেই আক্রমণ করে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘‘বিরোধীরা জাতের নামে সমাজকে ভাগ করার চেষ্টা করছে। ...আগেও এরা জাতের নামে দেশকে ভাগ করেছে। এখনও এরা একই পাপ করছে।’’ এটাই সঙ্ঘ পরিবারের লাইন। ২০১৫ সালে এই মোহন ভাগবতই প্রধানমন্ত্রী মোদীকে সংরক্ষণ নিয়ে পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি বানানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। ভাগবতের বক্তব্য ছিল, ওই কমিটি স্থির করবে কাদের এবং কতদিনের জন্য সংরক্ষণ দেওয়া হবে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ এদিন তালিকা তুলে ধরে দেখিয়েছেন, কীভাবে আরএসএস-বিজেপি নেতারা সংরক্ষণের বিরোধিতা করেছেন। ২০১৭ সালে আরএসএস নেতা মনমোহন বৈদ্য বলেন, সংরক্ষণকে অবশ্যই বাতিল করা প্রয়োজন। ২০১৮ সালে বিজেপি নেতা সিপি ঠাকুর সরাসরি সংরক্ষণের বিরোধিতা করেন। ২০২১ সালে হিমাচল প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুর সময় এসে গেছে জাতভিত্তিক সংরক্ষণকে শেষ করার। ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, অমিত শাহের ভিডিও সত্যি না ভুয়ো সেটা বড় বিষয় নয়। সঙ্ঘ পরিবারের সংরক্ষণ নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট।
উত্তর প্রদেশে ছোট ছোট জাত ভিত্তিক দলগুলিকে পকেটে পুরে নেওয়া এবং বিএসপি নেত্রী মায়াবতীর কার্যত অনুপস্থিতিতে বিজেপি নিশ্চিত ছিল। বিহারে তেজস্বী যাদব সরকারের থাকার সময়ে জাতভিত্তিক গণনা করিয়ে নেওয়ায় সংরক্ষণ প্রশ্নে বিজেপি খানিকটা বেকায়দায় ছিলই। বাকি হিন্দি বলয় সহ দেশের অন্য অংশে এই নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা ছিল না মোদী-শাহদের। কিন্তু বিজেপি’র একের পর এক নেতা বলতে শুরু করেন, মোদী চারশো আসনের দাবি করছেন সংরক্ষণ বাতিলের জন্য। সেই সব ভিডিও সোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের গতিতে। বিরোধীরা এই সেই বক্তব্য তুলে ধরে মোদীকে আক্রমণ শুরু করেন। তাঁরা বলেন, চারশো আসন নিয়ে সরকার গড়তে চাওয়ার আসল লক্ষ্য আম্বেদকরের তৈরি সংবিধানের বদল করা এবং তার ফলে তফসিলি জাতি, আদিবাসী, ওবিসিদের যে সব অধিকার আছে তা কেড়ে নেওয়া হবে। প্রথম দিকে বিশেষ পাত্তা না দিলেও ক্রমশ নিচ থেকে বিজেপি’র কাছে খবর আসতে থাকে সংবিধান এবং সংরক্ষণ নীরবে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনছে বিজেপি’র জন্য। বিশেষ করে এসসি বা দলিত ভোট পুরোটাই সরে যেতে পারে বিজেপি’র থেকে। ওবিসি অংশ তো আছেই। প্রথম দফার ভোট কম পড়া এবং বিজেপি বা মোদীকে ঘিরে জনতার উদ্দীপনাও অনেকাংশে স্তিমিত। এই সব ইঙ্গিতে মরিয়া হয়ে মোদী ভোটকে ‘হিন্দু-মুসলিম’ ভাষ্যে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সেই কাজে রাম, কৃষ্ণ, সম্পত্তি, মঙ্গলসূত্র থেকে রাজা-মহারাজা কিছুই বাদ দিচ্ছেন না। কিন্তু যে প্রচারটায় সবথেকে বেপরোয়া ভাব প্রকাশ পাচ্ছে, সেটা হলো সংরক্ষণের প্রশ্ন। সংবিধান ও সংরক্ষণ নিয়ে পুরোপুরি বেকায়দায় পড়া মোদী পালটা দাবি করছেন, কংগ্রেস এবং তার জোটের সরকার আসলে ওবিসিদের সংরক্ষণ কেটে মুসলিমদের দিয়ে দেবে। যদিও সংবিধানে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণের কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু মোদী সহ বিজেপি’র সমস্ত শীর্ষ নেতা এখন সমস্বরে এই ভয়টাই দেখাতে চাইছেন। এমনকি তিনিই সংবিধানের রক্ষাকর্তা এমনই দাবি করছেন।
উলটোদিকে বিরোধীদের দিক থেকে প্রবল আক্রমণ শুরু হয়েছে সংবিধান বদলের প্রশ্নে। সমাজবাদী পার্টি নেতা অখিলেশ যাদব সোমবার বলেছেন, সংবিধান এবং গণতন্ত্র রক্ষা পাবে যদি ইন্ডিয়া ব্লক ভোটে জয় পায়। এবারের ভোট সংবিধান মন্থন। সংবিধানের রক্ষাকারী এবং ধ্বংসকারীদের লড়াই। এদিন এটা’র নির্বাচনী সমাবেশ থেকে তিনি বলেন, বিজেপি ফের ক্ষমতায় আসলে শুধু সংবিধান বদল করে সংরক্ষণ বাতিল করবে তাই নয়, ভোটের অধিকারও কেড়ে নেবে। পরিবারবাদ নিয়ে বিজেপি’র আক্রমণকেই হাতিয়ার করে অখিলেশ এদিন বলেছেন, দুনিয়ার সবথেকে ভয়ঙ্কর পরিবার হচ্ছে সঙ্ঘ পরিবার যারা সংরক্ষণকে শেষ করতে চাইছে। কিন্তু এখন ভোট পাওয়ার জন্য বলছে সংরক্ষণ বাতিল করা হবে না। বিহারের পরিস্থিতিও বিজেপি’র হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে রিপোর্ট পেয়েছেন মোদী-শাহরা। এমনকি যেসব আসনে বিজেপি প্রার্থী আছে, সেখানে জোট সঙ্গী জেডি (ইউ)’র জাতভিত্তিক সমর্থনের ভিত্তিও সরে যাচ্ছে অন্যত্র, এমনই খবর এসেছে। মোদী গত বছর চার রাজ্যের বিধানসভা ভোটেও জাতগণনার দাবি উড়িয়ে জোরের সঙ্গে বলে আসছিলেন, ভারতে একটাই জাত সেটা গরিব। চারশো পার স্লোগান দেওয়া থেকে যেমন সরে এসেছেন, তেমনই এইসব কথাও আর বলছেন না। উলটে দলিত, আদিবাসী রাষ্ট্রপতি বানিয়েছেন বলে কৃতিত্ব চাইছেন। নানা জাতের লোককে মিথ্যা বলে ভয় দেখাচ্ছেন।
ভিপি সিং পরবর্তীকালে বলেছিলেন, কেউ কেউ সরকার চালায়। আমি ইতিহাসকে চালিয়েছি। মণ্ডলের রাজনীতি আগামী দিনেও দেশের সরকার স্থির করবে। তিন দশক পরেও সেই কথাই কি সমান সত্য? মোদী-ভাগবতদের আচরণ তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
Comments :0