PANCHAYAT WATCH IN DOMKAL

তৃণমূলের দাদন নিয়েছে পুলিশ, ঘুম নেই ডোমকলের গ্রামে

রাজ্য জেলা

CPIM west bengal panchayat election TMC BJP

অনির্বাণ দে: ডোমকল
 

মেয়ের বয়স মাত্র দশ মাস। সেই মেয়েকেই ১০দিন দেখেননি জাহাঙ্গীর মণ্ডল। বাবা হিসাবে কষ্ট তো আছেই কিন্তু তার জন্য আক্ষেপ নেই!  

একরত্তি মেয়েকে রেখে আসতে হয়েছে অন্যত্র। ডোমকলের রাইপুর পঞ্চায়েতের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর মণ্ডল। বাড়িতে যে কোনও মুহূর্তে হানা দেবে পুলিশ। তাই রাত কাটছে পাটের জমিতে। কখনও নিজের গ্রামে। কখনও অন্য গ্রামে। এই বৃষ্টির মধ্যেও পাটের জমিতে পরপর তিনরাত কাটিয়েছেন বক্সিপুরের রাকিব মণ্ডল।

ঘুম হারাম করেছে পুলিশ। সোমবার রাতে পুলিশ হানা দিয়ে তুলে নিয়ে এসেছে বক্সিপুরের মিরাজ মণ্ডল, সফিকুল ইসলাম, রাজাপুরের নুরুল ইসলামদের। চলছে থানায় তুলে এনে হেনস্তা। শেষ সাত দিনে ডোমকল থানার পুলিশ তুলে নিয়েছে ষাট জনের বেশি সিপিআই(এম) কর্মীকে।


ওরা যখন আমাদের ঘুমোতে দিচ্ছে না, আমরাই বা কীভাবে ওদের ঘুমোতে দেব? বলছেন ডোমকলের যুব নেতা আশরফ মণ্ডল। প্রতিরোধের মেজাজেই ডোমকল। শাসক তৃণমূলের রক্ষাকর্তা পুলিশ।
তাই, এখন সব চোখের ঘুম কামাই।

ভোটের অপেক্ষায় যেন ঘুম নেই ডোমকলের। অপেক্ষা কেবল সব বাধা ঠেলে ভোটের লাইনে দাঁড়ানোর। দাঁড়াসারাংপুর থেকে মধুরকুল। ভগীরথপুর থেকে ধুলাউড়ি। বিস্তীর্ণ জনপদে একই চিত্র, একই আকাঙ্ক্ষা। 

ঘুম নেই। কথার কথা নয়, বাস্তব। তৃণমূল, পুলিশের চোখে চোখ রেখে টানা লড়াই। চুরি, দুর্নীতিতে কোণঠাসা তৃণমূল, একমাত্র চ্যালেঞ্জ পুলিশ। 

মনোনয়ন জমায় এই ডোমকলেই বাধা দিয়েছিল তৃণমূল। শাসক দলের দুষ্কৃতী বাহিনীকে হটিয়েই ব্লক অফিসে মনোনয়ন জমা করেছিলেন সারাংপুরের রফিকুল ইসলাম, ঘোরামারার নার্গিস সুলতানা, ধূলাউড়ির রুনা লাইলা বিবিরা। তৃণমূল নেতার পকেট থেকে উদ্ধার হয়েছিল বন্দুক। সেদিন থেকেই তো আমাদের ঘুম নেই- কাটাকোপড়া মোড়ে দাঁড়িয়ে বলছেন বছর পঁচিশের সেই জাহাঙ্গীর মণ্ডল । 
 

রাইপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের রফিকুল ইসলাম, আমানত মণ্ডলদেরও বক্তব্যের সুর তাই-ই। গ্রামরক্ষায় জোট বেঁধেছে একই সুরে,একই ছন্দে। এই গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন আনিসুর রহমান। গর্বের সুরেই বলছেন এলাকার প্রবীণ  বাসিন্দা রফিক ইসলাম। আনিসুর রহমান পরে হয়েছেন ডোমকলের বিধায়ক, রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী। আনিসুর রহমানের হাত ধরে বদলে গিয়েছে ডোমকলের চেহারাও। 

আর এখনকার পঞ্চায়েত? যারা প্রধান মেম্বার তারা কারো খবরই রাখে না। জানাচ্ছেন রহেদ শেখ, শাকিলা বিবি। আগে যে পঞ্চায়েত ছিল, সেই পঞ্চায়েতই ফেরাতে হবে। তাই এই লড়াইয়ে কারো দুই চোখের পাতা এক করার সময় নেই। জানাচ্ছেন মনিরুল মণ্ডল, মিঠুন মণ্ডলরা।


পাটকাঠির বেড়া। ত্রিপলের ছাউনি। একটি সামান্য চায়ের দোকান। স্থান, ডোমকলের কুচিয়ামোড়া পূর্বপাড়া। এই দোকানের বাইরে বসেন গ্রামের মানুষ। তাতেই দোকান খোলা রাখায় আপত্তি ছিল পুলিশের। কারণ, পাটকাটির বেড়ায় সাঁটানো তিন টুকরো কাগজ। তিনটে কাস্তে হাতুড়ির নিশান।

ফজরের নামাজের পর এই দোকানের বাইরে বসা বন্ধ। ছিল ফরমান। কেন চায়ের দোকানেও বসা যাবে না, কাস্তে হাতুড়ি তারা পোস্টার সাঁটানো যাবে না? প্রশ্ন করে বেরিয়ে এসেছেন গ্রামের মানুষ, প্রতিরোধী মেজাজেই, তৃণমূলের হয়ে ‘প্রক্সি’ দেওয়া পুলিশ পিছু হটেছে।
 

কেন এই ফরমান ? তৃণমূলের কাছে ভয়ের নাম ডোমকলের কুচিয়ামোড়া। ভয়ের কারণ এই গ্রামের মানুষের জেদ। গণতন্ত্রের জন্য অনেক লড়াইয়ের সাক্ষী এই গ্রাম। সাক্ষী আত্মত্যাগের। ভোট দেওয়া, কুচিয়ামোড়ার জেদ। তাতেই আপত্তি তৃণমূলের।

‘২০১৮ সালের ভোট দিতে পারিনি। এবার দেবোই। কোথায় ভোট পড়বে তৃণমূল জানে। তাই এই গ্রাম নিয়ে ওদের এত চিন্তা।’ বলছেন প্রবীণা কোহিনুর বিবি। তৃণমূল পিছু হটেছে আগেই। ঝামেলা করার চক্রান্ত করছে পুলিশ। গ্রামের মানুষ কেউ ঝামেলা হতে দেবেন না। ঠান্ডা মাথাতেই ভোট হবে। দোকানের মাচায় বসে বোঝাচ্ছেন সরিফুল ইসলাম।

তবে কেন এত পুলিশ নিয়ে কথা বলছেন ? গ্রামে গিয়ে তৃণমূল কী করেছে কী করেনি প্রচার করছেন না কেন ? গ্রামে কয়েকটা বাড়ি ঘোরার পর প্রশ্ন শুনে স্মিত হাসলেন রাজাপুরের আসাদুল মণ্ডল।

কোথায় তৃণমূল দেখাবেন ? গ্রামে তৃণমূল করছে এখন শুধু ওদের বুথ কমিটির লোকেরা। গোটা গ্রাম তৃণমূলের বিরুদ্ধে এককাট্টা। তাই পুলিশই ওদের ভরসা।

ডোমকলজুড়ে তৃণমূলের জায়গা নিয়েছে পুলিশ। সাফ অভিজ্ঞতা ডোমকলের মানুষের।  ২০২১ সালে তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি ছিল ঘোড়ামারা গ্রাম পঞ্চায়েত। এক বছরেই বদলেছে পরিস্থিতি। গ্রাম ঘুরেছে বামে। তাই অস্বস্তি বেড়েছে তৃণমূলের। এই পঞ্চায়েত এখন পুলিশের অন্যতম  টার্গেট।


তাই গ্রামে রাত দুটোয়, রাত তিনটেয় যাচ্ছে পুলিশের গাড়ি। তুলে নিয়ে আসা হচ্ছে নির্বাচনী কর্মীদের। একই অবস্থা মধুরকুল গ্রাম পঞ্চায়েতের বৃন্দাবনপুর, অম্বরপুরেও। যাদের বাড়ি পুলিশ যাচ্ছে, তাদের নামে নেই অপরাধের রেকর্ড। ‘সিপিআই(এম) কর্মী’ এটাই যথেষ্ট পুলিশের কাছে! 

সিপিআই(এম) ডোমকল এরিয়া কমিটির সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানের কথায়, তৃণমূল হার নিশ্চিত তাই পুলিশকে ঢাল করছে। আমরা কর্মীদের বলেছি শেষ মুহূর্তে কোন প্ররোচনায় পা দেবেন না। শান্তি বজায় রেখেই ভোট হবে ডোমকলে। ভোটের দিন তৃণমূল লুটের রাস্তায় নামলে গ্রামের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।

ভোটের আর মাত্র চারটে রাত। এই চার রাত ঘুমোবে না ডোমকল! 

Comments :0

Login to leave a comment