ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী
আজ থেকে ঠিক তিনমাস আগে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের মহিলা চিকিৎসক অভয়া আমাদের প্রত্যেকের ঠিকানায় একটি করে নাম-না-লেখা সাদা খামে দীর্ঘ চিঠি পাঠিয়েছিল।
সেই চিঠিতে লেখা ছিল গত তেরো বছরে এরাজ্যে ঘটে চলা সীমাহীন দুর্নীতির কথা, যা একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। লেখা ছিল অবাধে নারী তথা প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনতার মানুষের উপর অত্যাচারের কাহিনি। লেখা আছে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল দশা আর কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার ঘোর অভাবের কথা। এরাজ্যের প্রশাসন কেমন অপরাধীদের বন্ধু হয়ে উঠেছে, তার কিছু প্রমাণ চিঠিতে লিখে গেছে সে। লিখেছে রাজ্যের মেডিক্যাল শিক্ষা সহ সামগ্রিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়ার ইতিবৃত্ত।
লিখতে ভোলেনি পাড়ায় পাড়ায়, প্রতিটি ক্যাম্পাসে, বাসস্থানে আর কর্মস্থলে, হাটেবাজারে সর্বত্র হুমকি আর ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা লুম্পেনদের নামগুলি। আর সবশেষে সুকান্তকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, 'আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়, দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড়; ... দু'হাতে বাজাও প্রতিশোধের উন্মত্ত দামামা, টুকরো টুকরো ক’রে ছেঁড়ো তোমার অন্যায় আর ভীরুতার কলঙ্কিত কাহিনি।' বাংলার মানুষ তাদের ঘরে ঘরে এই চিঠি পেয়ে সাদা খামের উপর নিজের নিজের নাম লিখে নিয়েই বেরিয়ে পড়েছেন রাস্তায়, দখল নিয়েছে পথের। নব্বই দিনেও তাঁরা রাজপথ ছাড়েননি; ছাড়বেন না - এই শপথ নিয়েছেন।
সরাসরি অপরাধে যুক্ত শাসক-ঘনিষ্ঠরা, সরকারি আধিকারিকরা, বিধায়ক, মন্ত্রীরা। তদন্তের নামে পুলিশ প্রহসন করছে। পুলিশ আধিকারিকরা অপরাধীদের সাহায্য করছে, এমনকি তারা নিজেরাও অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়ছে। অথচ তার দায় নেবেন না পুলিশ মন্ত্রী? প্রশাসনিক প্রশ্রয়ে স্বাস্থ্য দপ্তরে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি চলছে, যে দুর্নীতির সম্ভাব্য শিকার রাজ্যের প্রতিটি মানুষ। জাল ওষুধের কারবার, বায়ো-মেডিক্যাল বর্জ্যের ব্যবসা, লাশ পাচার, টাকার বিনিময়ে ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ-ফেল চলছে অবাধে। দপ্তরের চাকরিগুলি বিক্রী হচ্ছে। চড়া দামে কেনা হচ্ছে নিম্নমানের চিকিৎসার সরঞ্জাম ও ওষুধ। এসবের কোনও দায় নেবেন না স্বাস্থ্য মন্ত্রী?
সিবিআই যথারীতি খাঁচায় পোরা তোতা পাখীর ভূমিকা নিচ্ছে। তারা কলকাতা পুলিশের সাজানো তদন্তের বাইরে কতটা বেরোতে পারবে তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ। ক্রাইম সিন বদলে ফেলা হয়েছে, তথ্য-প্রমাণ লোপাট হয়েছে এইটুকু বলেই তারা চুপ করে গেল। কারা, কোন স্বার্থে তা বদলে ফেলল, কোন কোন তথ্য-প্রমাণ কিভাবে, কারা লোপাট করল, সেসব প্রশ্নের উত্তর আদৌ তারা খুঁজেছে কিনা, খুঁজে পেলে তা আদালতে পেশ করবে কিনা, কেউ জানে না। দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রী এবিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্ট থেকে মামলাটি নিজেদের হেপাজতে নিয়ে তারিখের পর তারিখ দিয়ে বিষয়টিকে লঘু করে দিচ্ছে। শিয়ালদা কোর্টে মূল শুনানি শুরু হতে চলেছে। সেই শুনানিরও লাইভস্ট্রিমিং কেন হবে না, সেই প্রশ্নও উঠছে। সব অভিযোগ উঠে আসছে জনতার চার্জশিটে, সব সওয়াল পেশ হবে মানুষের আদালতে।
সওয়ালগুলির জবাব পেতে সাধারণ মানুষ পথকেই একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এই তিনটে মাস রাজপথের দখল নিজেদের হাতেই রেখেছেন প্রতিবাদী জনতা। কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার, পাহাড় থেকে সাগর, কে পথে নামেননি! চিকিৎসক, অধ্যাপক, প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষক, নাট্যকর্মী থেকে শুরু করে ডুয়ার্সের চা বাগানের শ্রমিক, বালুরঘাটের ব্যবসায়ী, বর্ধমানের কৃষকরমণী, পুরুলিয়ার ছৌ-শিল্পী, সুন্দরবনের দিনমজুর, হাড়-কাটা-গলির যৌনকর্মী, সেক্টর ফাইভের আইটি কর্মী, বালিগঞ্জের গৃহপরিচারিকা, বাগবাজারের গৃহবধূ, গিগ ওয়ার্কার, ক্যাবচালক, চাকরি হারানো প্রৌঢ়, বেকার যুবক-যুবতী, ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক সকলে পথে নেমেছেন। ১৪- আগস্ট রাতে বোধ হয় কোনও মহিলাই ঘরে বসে ছিলেন না, সবাই সেই রাতে রাস্তায় ছিলেন।
মহিলা এবং প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষের উপর নির্যাতন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেড়েছে। এরাজ্যেও পাল্লা দিয়ে অত্যাচার বেড়েই চলেছে। চার বছরের শিশুকন্যা থেকে বৃদ্ধা কেউ এই বাংলায় নিরাপদ নয়। সবচেয়ে বিপদে আছেন এঁদের মধ্যে যাঁরা প্রতিবন্ধী, তাঁরা। অপরাধীরা তাদের বন্ধু-প্রশাসন পেয়ে উৎসাহিত হয়েছে। অবাধে উপর্যুপরি ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি চলছে। প্রতিবাদীদের ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে শাসক। তারা বলছে, 'আরজিকর করে দেব'। অর্থাৎ তারা খুন-ধর্ষণ করে প্রশাসনের সহায়তায় তথ্য-প্রমাণ এমনভাবে লোপাট করে দেবে যাতে আসল অপরাধীদের কেউ ধরতে না পারে। সরকার ধর্ষণকে কখনো 'ছোট ঘটনা', 'সাজানো ঘটনা' বলছে, কখনো ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, নির্যাতিতাকেই কাঠগড়ায় তুলছে। গরীব মহিলারা তাদের হকের প্রাপ্য কোনও অনুদান, কোনও ভাতার বিনিময়ে এই নির্যাতনের সঙ্গে, এই নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে, এই অবিচারের সঙ্গে আপোষ করতে রাজি নন।
গত তিনমাসে সাধারণ মানুষ যে তীব্র থেকে তীব্রতর আন্দোলন গড়ে তুলছেন, তা আপাদমস্তক রাজনৈতিক। এই আন্দোলনের স্পষ্ট অভিমুখ স্বৈরাচারী শাসকের দিকে। দলীয় রাজনীতির ছোঁয়াচ বাঁচিয়েই শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ। এই অভূতপূর্ব অ-দলীয় রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলন তার কিছু অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষ ভয় কাটিয়ে পথে নেমেছেন, বিচারের দাবিতে গলা মিলিয়েছেন। একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনায় মানুষ সোচ্চারে সরব হচ্ছেন, নেতাদের তাড়া করছেন, আবাস যোজনায় কারচুপির প্রতিবাদে দুর্নীতিগ্রস্তদের ঘেরাও করছেন। মানুষ জেগে উঠছেন, এ বড় কম কথা নয়। ভয়ের আবহে দিন গুজরান থেকে জনগণের সাহসী প্রতিবাদে উত্তরণ, শাসকের আকন্ঠ দুর্নীতি গা-সওয়া হয়ে যাওয়া মানুষের গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে প্রতিরোধে উত্তরণ, প্রতিবাদ থেকে অহরহ প্রতিস্পর্ধায় উত্তরণ দেখছে রাজ্য।
রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন আর এই জেগে ওঠা গণশক্তিকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। পুলিশ দু'জন চিকিৎসককে সমন পাঠালে পথে নামছেন দু'হাজার চিকিৎসক, সঙ্গে কাতারে কাতারে সাধারণ মানুষ। উত্তরে মন্ত্রী দাঁড়িয়ে থেকে চারটে মোমবাতি জল ঢেলে নিভিয়ে দিলে দক্ষিণে চল্লিশ কিলোমিটার পথজুড়ে সারারাত মশাল মিছিল করছে প্রতিবাদীরা। ন'জন প্রতিবাদীকে গ্রেপ্তার করলে নব্বই হাজার মানুষ দ্রোহ ঘোষণা করে কার্নিভাল করছেন। অন্যায়ের আঁধার কাটাতে দ্রোহের আলো জ্বালছে পাড়ায় পাড়ায়। সিবিআই সেটিং করে লঘু চার্জশিট জমা দিয়েছে বলে আজ বিকালে লাখো জনতার আদালতে পেশ হতে চলেছে তাদের নিজেদের চার্জশিট। জয়নগর থেকে জয়গাঁ, ফরাক্কা থেকে ফালাকাটা প্রতিবাদী জনতার জাঠা নিয়ে লং মার্চ হতে চলেছে। গঞ্জে-নগরে অভয়া বাহিনী, তিলোত্তমা বাহিনী গড়ে উঠছে। আরও বড় ময়দানে আরও বড় লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জোটবদ্ধ মানুষ। লক্ষ্য রাজ্য থেকে দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলা, আইনের শাসন ফিরিয়ে আনা, ন্যায়বিচার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা।
সংস্কৃতির জগত, নাট্য, সঙ্গীত, কলা ও শিল্পের জগত আনুগত্যের গতানুগতিকতা ঝেড়ে ফেলে প্রতিবাদে মুখর হচ্ছে। সৃজনে, সৃষ্টিতে, কৃষ্টিতেও লেগেছে দ্রোহের ছোঁয়া। প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে ভাদুগানে, কবিগানে। আদিবাসীরা নতুন প্রতিবাদী টুসুগান বাঁধছেন মকরসংক্রান্তিতে গাইবেন বলে। খেলার মাঠে একস্বরে জাস্টিস চাইছে লাল-হলুদ আর সবুজ-মেরুন জার্সি। সুবিচারের দাবীতে গোষ্ঠ পালের মুর্তির সামনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহামেডান স্পোর্টিং সমর্থকরা একসাথে জড়ো হবেন আগামী মঙ্গলবার।
অত্যাচারিত মানুষের এই ঘুরে দাঁড়ানো রুখতে পারবে না কেউ। আগের ১৪৪ ধারা বা বর্তমানের ১৬৩ ধারাকে ঢাল করে তা রোখার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে শাসক। 'এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ, দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ'। আর এই অবাধ্য জনগণ আজ দিনসন্ধিক্ষণে ধর্মতলায় দাঁড়িয়ে সমস্বরে চিৎকার করবেন, 'অনেক নিয়েছো রক্ত, দিয়েছো অনেক অত্যাচার, আজ হোক তোমার বিচার।'
Comments :0