Tea Workers Strike

চা শ্রমিকদের ১২ঘন্টা বন্‌ধে ব্যাপক প্রভাব

রাজ্য জেলা

রোহিনীতে বনধ সমর্থকদের রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ। ছবি- রাজু ভট্টাচার্য।

অনিন্দিতা দত্ত- শিলিগুড়ি

মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে থাকাকালীন সময়ে সোমবার ১২ঘন্টা বন্‌ধে পুরোপুরি স্তব্ধ হয়েছে পার্বত্য অঞ্চল। দফায় দফায় বৈঠকের পরেও মেটেনি বোনাস সংক্রান্ত সমস্যা। যার জেরে একদিনের বন্‌ধে অচল হয়ে পড়ে দার্জিলিঙ পার্বত্য অঞ্চল। এদিনের ধর্মঘটের প্রভাব দার্জিলিঙ পার্বত্য এলাকার মানুষকে নতুন করে অনেক কিছুই ভাবতে শিখিয়েছে। জাতপাতের লড়াইকে পেছনে ফেলে পাহাড়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা বলেছেন ধর্মঘটে সামিল শ্রমজীবি মানুষ। সপ্তাহের প্রথম দিন সোমবারের ধর্মঘটের ব্যাপকতা ছিলো। প্রশাসনের হুমকী ছিলো সঙ্গে ছিল চোখ রাঙানিও। কিন্তু সমস্ত ভয়ভীতিকে উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্তে দঢ় অবস্থান রেখে ধর্মঘটে সামিল হয়েছেন বাগিচা শ্রমিকেরা। এদিনের ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে মালিকের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে দ্রুত সম্মানজনক বোনাস ফয়সলা না হলে আগামী দিনে পার্বত্য অঞ্চলে শ্রমজীবি মানুষের আন্দোলনের ছবিটা পুরোপুরিভাবে বদলে যাবে। 
২০১৭ সালের পর ২০২৪ সাল দীর্ঘ প্রায় সাত বছর পর পাহাড়বাসী বন্‌ধে পুরপুরিভাবে অংশগ্রহণ করে চা বাগানের শ্রমিকদের দাবির প্রতি সম্মতি জানিয়েছেন। পাহাড়ের ৮৭টি চা বাগানের লক্ষাধিক বাগিচা শ্রমিকদের একটিই দাবি ১৩ শতাংশ নয়, ২০শতাংশ হারে এক কিস্তিতে বোনাস চাই। যদিও এই সময়ে ৮৭টি চা বাগানের মধ্যে ১০টি চা বাগান বন্ধ রয়েছে। একই সাথে পূজোর মুখে বন্ধ চা বাগানগুলির অচলাবস্থা কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনারও দাবি রয়েছে তাদের। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক ত্রিপাক্ষিক মিলিয়ে মোট পাঁচটি নিষ্ফলা বৈঠক হয়েছে পাহাড়ের চা বলয়ের শ্রমিকদের বোনাস সমস্যা নিয়ে। আর আলোচনা বৈঠক নয়, ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। দাবি আদায়ে কাজকর্ম বন্ধ রেখে আন্দোলন ছাড়া কোন উপায় নেই একথা উপলব্ধিতে আনতে পেরেই চিয়াকামান মজদুর ইউনিয়ন সহ আটটি শ্রমিক সংগঠন একযোগে সরকার ও মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ধর্মঘটের রাস্তায় পা বাড়ায় শ্রমিক সংগঠনগুলি। এদিনের বন্‌ধে ৮টি শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বরা দিনভর রাস্তায় থেকে শ্রমিকদের আন্দোলনকে আরো উজ্জীবিত করে তুলেছেন। বন্‌ধকে সমর্থন জানিয়েছে বিজিএম সহ পাহাড়ের সমস্ত দলগুলি। চা শ্রমিকদের উৎসবকালীন ভাতার সমর্থন জানিয়েছে অনীত থাপার দল ভারতীয় গোর্খা গণতান্ত্রিক মোর্চা। 


গরুবাথানের রাস্তায় অবরোধ ও বিক্ষোভ।

সোমবারের ১২ঘন্টার বন্‌ধে দার্জিলিঙ পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। প্রায় গোটা দার্জিলিঙেই সমস্ত কিছু বন্ধ ছিলো। জোরবাংলো, সোনাদা, ঘুম, দার্জিলিঙ শহর, মিরিক, তিনধারিয়া সহ সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত বন্‌ধ হয়েছে। চা বাগান ছেড়ে রাস্তায় নেমে এদিন ন্যায্য দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন বাগিচা শ্রমিকেরা। বোনাস ইস্যুতে বন্‌ধকে ঘিরে এদিন সকাল থেকেই দার্জিলিঙ স্তব্ধ ছিলো। দার্জিলিঙের রাস্তাঘাট ছিলো একেবারেই ফাঁকা। বিক্ষোভে সামিল শ্রমিকদের স্লোগানের আওয়াজে মুখর হয়ে ছিলো শ্রমিক মহল্লাগুলি। কোন চা বাগানের গেট সামান্যও খোলেনি। দার্জিলিঙ শহরের অত্যন্ত জনবহুল জায়গাগুলিও ছিলো কার্যত জনমানবশূন্য। দার্জিলিঙ ম্যাল ছিলো একেবারে শুনশান। দার্জিলিঙের সোনাদা—টুংয়ে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ চলে। কালিম্পঙ জেলার গোরুবাথান, জলঢাকা প্রভৃতি এলাকাতেও বনধের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। কালিম্পঙের বিভিন্ন চা বাগানে বিক্ষোভ হয়েছে। গরুবাথান ব্লকের লোয়ার ও আপার ফাগু, অম্বিয়ক, মিশন হিল, কুমাই সহ বেশ কয়েকটি চা বাগানে কাজকর্ম হয়নি। কালিম্পঙ জেলার গরুবাথানে জেলা সর্ববৃহৎ হাট বসে। সোমবার ছিলো হাটবার। কিন্তু বন্‌ধের সমর্থন জানিয়ে এদিন হাট বসেনি। ২০ শতাংশ হারে বোনাসের দাবিতে এদিন ডামডিমে গরুবাথান যাবার রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান হয়। গরুবাথানের পান্ডারা মোড়ে অবরোধ হয়েছে। সর্বত্রই বাজারঘাট, অফিস, দোকানপাট, সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সহ সব কিছুই বন্ধ ছিল। সুকনা, রোহিনী ও কার্শিয়াঙেও একই ছবি। 
এদিন দুপুরে উত্তরকন্যা থেকে কলকাতায় ফিরে যাবার আগে পাহাড়ের বন্‌ধ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি’র মন্তব্য, ‘‘পাহাড়ে কোন বন্‌ধ হয়নি, রাজনীতির চেষ্টা করা হচ্ছে। বোনাসের বিষয়টি দেখছেন লেবার কমিশন। ত্রিপাক্ষিক বৈঠক চলছে। যা সিদ্ধান্ত নেবার ওরাই নেবে। এবিষয়ে আমরা কোন হস্তক্ষেপ করব না।’’ মুখ্যমন্ত্রী আরো বলেছেন,‘‘‘কোথাও কোন বন্‌ধ হচ্ছে না। আমি বন্‌ধ সমর্থন করি না। তরাই—ডুয়ার্সের কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে পাহাড়কে অশান্ত করার চেষ্টা করছে।’’ 
মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য প্রসঙ্গে সমন পাঠক তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘‘যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চা সুন্দরী প্রকল্প ঘোষণা করতে পারেন, চা বাগানের জমি ইসু ও পাট্টা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারেন, সেই মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সরকার কেন বোনাস নিয়ে হস্তক্ষেপ করবেন না। মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে থাকাকালীন সময়ে এক কিস্তিতে ২০ শতাংশ হারে বোনাসের দাবিতে পাহাড়ে ১২ঘন্টার স্বতস্ফূর্ত বন্‌ধ হয়েছে। রাজ্য সরকারের সমর্থনের নিয়ে বন্‌ধ সফল হবে সেই রকম কোন বিষয় নেই শ্রমিক শ্রেণির এই আন্দোলনে। শ্রমজীবি মানুষের স্বার্থে সমস্ত শ্রমিক শ্রেণির সংগঠনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে ডাকা এই বন্‌ধে পাহাড়ে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। এই বন্‌ধের সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই।’’

Comments :0

Login to leave a comment