মেয়াদ প্রায় শেষ ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের, রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন সামনেই। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যবাসী দেখেছিল ভোট লুট ও প্রহসনের চিত্র। রাজ্যের তৃণমূল সরকার গ্রামে গ্রামে সন্ত্রাস চালায় পঞ্চায়েতগুলো নিজেদের দখলে রাখার জন্য। আক্রমণের শিকার করা হয়েছিল বেছে বেছে মহিলাদের। বামপন্থী মহিলা কর্মী, যাঁরা পরার্থী হয়েছিলেন, এমনকি সামাজিক নিপীড়নের মুখেও পড়তে হয়েছে তাঁদের।
কেনিজ রেজিউল ফতিমা, মিতা লেট বা রেণুকা নাইয়ার সেই অভিজ্ঞতা আছে। মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে শ্বশুরবাড়ি থেকে, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী মহিলা কর্মীর জীবনে রয়েছে এমন বাস্তবতাও। তবু এবারও লড়াইয়ের রাস্তা ছাড়ছেন না কেউ। জানিয়ে দিচ্ছেন, মুখ বুঁজে মানবো না অত্যাচার।
২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে প্রহসনে পরিণত করেছিল তৃণমূল এবং যেভাবে মহিলা প্রার্থীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল তা এবার কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। এখন গ্রামের মানুষ ও মেয়েরা প্রতিরোধ করতে শিখে গেছে বলে মন্তব্য করেন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা কনীনিকা ঘোষ বোস। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল বোমা, গুলি, বন্দুক নিয়ে আসতে পারে কিন্তু গ্রামের মহিলারা এবার তাদের হাতা, খুন্তি, ঝাঁটা, লাঠি, আঁশ বটি পর্যন্ত নিয়ে প্রতিরোধ করবে। এভাবে অত্যাচার করে মুখ বন্ধ করা যাবে না।’’
বিরোধী দলের বিশেষ করে বামপন্থী প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দিতে দেয়নি। আবার কোথাও মনোনয়ন জমা দিলে তা তুলে নিতে চাপ দেয়। মারধর, অপহরণ, জোর করে তৃণমূলে যোগ দেওয়ানো এমনকি প্রার্থীদের বাড়িতে আগুন লাগানো বোমাবাজির মতো ঘটনাও ঘটানো হয়। অধিকাংশ জায়গাতেই ভোট হতে দেয়নি মমতা ব্যানার্জির সরকার। আর যে পঞ্চায়েত গুলোতে ভোটের দিন পর্যন্ত গড়িয়েছিল সেই দিনগুলি টানা সন্ত্রাস চালিয়েছে তৃণমূল।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতো সন্ত্রাস আগে কখনও দেখেনি গ্রাম। এমন কথা শোনা যায় গ্রামের সাধারণ মানুষের মুখেই। সেই সব দিন ভুলতে পারেন না সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির বীরভূম জেলা সম্পাদিকা কেনিজ রবিউল ফতিমা। তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনের দিন ঘোষণা হতেই জেলার সর্বত্র সন্ত্রাস আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করে তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে এমনকি চাষের খেতে, পাড়ার দোকানে, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষকে হুমকি দিতে থাকে তৃণমূল, যাতে ভোট দিতে না পারেন। বাড়ির মা-বোনদের ভয় দেখায়, এমনকি ভোট দিতে গেলে খুনের হুমকিও দেয়।’’
ফতিমা বলছেন, ‘‘সিপিআই(এম) প্রার্থীরা যাতে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে না পারে সেই চেষ্টায় প্রার্থীদের বাড়িতে হামলা, প্রার্থীদের মারধর, বোমাবাজি, তুলে নিয়ে যাওয়া বা পরিবারের অন্য কোনও সদস্যকে মারধর করেছে তৃণমূল।’’
বীরভূমের বাউটিয়া দেশনবগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রার্থী হয়েছিলেন মিতা লেট। মনোনয়ন জমা দিতে যাওয়ার দিনের কথা বললেন তিনি। মিছিল করে মিতা লেট সঙ্গে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে গিয়েছিলেন। সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য রামচন্দ্র ডোম ছিলেন মিছিলে। প্রাক্তন সাংসদের সামনেই আক্রমণ চালায় তৃণমূল। লাঠি, ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে দাড়িয়ে প্রার্থী মিতা লেট ও তাঁর সঙ্গীদের আটকানোর চেষ্টা করে তৃণমূল। সঙ্গে চলে প্রবল গালাগাল ও হুমকি। সেই হুমকির বাধা পেরিয়ে মনোনয়ন জমা দিতে গেলে বোমাবাজি শুরু হয়। ব্যাপক বোমাবাজি, চারিদিক ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। মিতার সহযোদ্ধারা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। তারপরও নিজেদের সামলে মিতারা সামনে এগোতে গেলে টায়ার জ্বালিয়ে প্রার্থীর সঙ্গে থাকা সঙ্গীদের তুমুল মারধর করে তৃণমূল। বাধ্য হয়ে সেদিন মনোনয়ন না দিয়ে চলে আসে মিতারা।
আজ তাঁর কথায়, ‘সেদিন আমরা বাধ্য হয়েছিলাম, কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান ছাড়িনি। তৃণমূলের সন্ত্রাস, লুঠ, চুরির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাই। আজ তা অনেকাংশেই প্রমাণিত। বীরভূমে তৃণমূলের আমলে দেখেছে বগটুয়ের ঘটনা। বালি পাচার, গরুপাচার, কাণ্ডের মূল নায়ক বীরভূমে সন্ত্রাসের মাস্টারমাইন্ড অনুব্রত মন্ডলও রয়েছেন জেলে। মানুষ এখন অনেক সচেতন এবার আর দাদাগিরি করতে পারবে না তৃণমূল’।
শুধু মিতা লেট নয় সারা পশ্চিবঙ্গে খুঁজলে এরকম আরও উদাহরণ পাওয়া যাবে। মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে সিপিআই(এম) বা বামফ্রন্ট প্রার্থীদের অপর অত্যাচার চালায় তৃণমূল।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মথুরাপুর-২’র রাধাকান্তপুর অঞ্চলের পঞ্চায়েতে সিপিআই(এম) প্রার্থী রেনুকা নাইয়ার অভিজ্ঞতা আরও মারাত্মক। মনোনয়ন জমা দেওয়ায় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে দেড়দিন আটকে রাখে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। সেখানেও চলে মানসিক নির্যাতন। ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার পরও লাগাতার চলত প্রাণনাশের হুমকি। তৃণমূলকে সঙ্গত দিয়েছে পুলিশও। রেনুকার অভিযোগ তো নেয়ইনি পুলিশ, উলটে তৃণমূল নেতাদের পক্ষ নিয়ে কাজ করতে দেখা গিয়েছে। রেনুকা নাইয়া বললেন, ‘‘নির্বাচনে তো লড়তেই দেয়নি এমনকি হুমকি শাসানি দিয়ে গেছে সিপিআই(এম) ছাড়ার জন্য। পারিবারিকভাবে প্রবল চাপ দিয়েছে তৃণমূল। কিন্তু আজ অবধি তৃণমূলে যোগ দেওয়াতে পারেনি দুষ্কৃতীরা।’’ রেনুকা বলেন, ‘‘আমি সিপিআই(এম) করা ছাড়িনি বলে আমার বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন ওর ওপর অত্যাচার করেছে। আমি তৃণমূল করলে ওকে বাড়ি ফিরিয়ে নেবে বলেছে। মেয়ে এক নাতি নিয়ে আমার বাড়িতেই থাকে। কিন্তু কোনও চাপের মুখে আমি মাথা নোয়াইনি। মহিলা সমিতির দিদিরা আমার পাশে সবসময় আছে।’’
Comments :0