সাজানো ঝগড়া চালিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে তৃণমূল ও বিজেপি। রবিবার এই মন্তব্য করেছেন সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র। এদিন জলপাইগুড়িতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওরা যে ঝগড়া দেখাচ্ছে তা একেবারেই সাজানো ঝগড়া। দু’দলের নেতাদের গোপন আঁতাত থাকলেও রাজ্যের মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় এই ঝগড়া দেখাচ্ছে।
অথচ মানুষের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যেসব দায়িত্ব পালন করার ছিল তা কিছুই করেনি, শুধু মানুষের দুর্দশাই বাড়িয়েছে। ফলে দুর্দশা থেকে মানুষের নজর ঘোরানোর জন্য রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই শাসকদল এখন সামনে ঝগড়া চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এরাজ্যের মানুষকে এই কায়দায় ভোলানো যাবে না।
একই দিনে একই সময়ে কাঁথিতে তৃণমূল নেতা অভিষেক ব্যানার্জি এবং ডায়মন্ডহারবারে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর তরজা-ভাষণ সংবাদমাধ্যমে ঢালাও প্রচারিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে রবিবার কলকাতায় সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, বিজেপি আর তৃণমূল একই গোয়ালের দু’টি গোরু। অথচ মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেদের ব্যাপক ঝগড়া প্রচার করিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে।
কিন্তু বাস্তবতা কী? বাস্তব হলো, মানুষ রোষে ফুঁসছে। কাঁথিতে গিয়ে অভিষেক ব্যানার্জি সেই রোষ দেখতে পেয়েছেন, সাঁইথিয়ায় গিয়ে শতাব্দী রায়ও টের পেয়েছেন। গ্রামের মানুষের অপ্রাপ্তির ক্ষোভ দেখে অভিষেক ব্যানার্জি নাকি পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রধানকে ইস্তফা দিতে বলেছেন! অভিষেক ব্যানার্জির উচিত ছিল এসব নাটক না করে কান ধরে সর্বসমক্ষে ওঠবোস করা। লুটের রাজত্বের জন্য ওঁরাই তো দায়ী। তা থেকে নজর ঘোরাতে এখন বিজেপি এবং তৃণমূল ঝগড়ার নাটক করছে।
জলপাইগুড়িতে এদিন সাংবাদিকদের কাছে সূর্য মিশ্র বলেন, বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে তৈরি পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ভেঙে দিচ্ছে রাজ্যের শাসকদল। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে মানুষের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের ব্যবস্থা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। তৃণমূল সরকার তার বদলে প্রশাসনকে ব্যবহার করে শাসকদলের স্বার্থরক্ষার কাজ করাচ্ছে। বিডিও’দের দিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির কাজকর্ম পরিচালনা করা হচ্ছে। মানুষের অংশগ্রহণ না থাকায় স্বচ্ছতাও নেই, দেদার দুর্নীতিও হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের কর্তাদের দিয়ে তৃণমূলের অনৈতিক দলীয় কাজকর্ম করানো হচ্ছে।
এতে অনেক সৎ অফিসারই ক্ষুব্ধ, কিন্তু তাঁরা ভয়ে প্রকাশ্যে বলতে পারছেন না। কিন্তু গণআন্দোলনের চাপ যেভাবে বাড়ছে তাতে এভাবে বেশিদিন তাঁদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করানো যাবে না। তাঁরাও বুঝছেন, আত্মসম্মান থাকলে এই সরকারের অধীনে কাজ করা কঠিন।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামপন্থীদের লড়াই প্রসঙ্গে সূর্য মিশ্র বলেছেন, নির্বাচনের সময় নির্বাচনী সংগ্রাম হবে। কিন্তু তার আগেই গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন বুথে পদযাত্রা করে বামপন্থী কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। বৈঠকিসভা থেকে জেলা ও ব্লক স্তরে সমাবেশ সহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি করছেন। সেই কর্মসূচিগুলিতে তৃণমূল-বিজেপি’র বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মানুষের মানুষের ভিড় বাড়ছে। মানুষকে এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে আরও বেশি করে সংগঠিত করাই আমাদের লক্ষ্য। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট লুটের চেষ্টা হলে মানুষকে সঙ্গে নিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গরিব মানুষের প্রাপ্য অধিকার আদায় করতে হবে। এবারের নির্বাচনে ফের মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে তুলতে হবে।
কেন্দ্রীয় সরকার উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি এবং বিহার ও আসামের অংশ নিয়ে আলাদা রাজ্যের পরিকল্পনা করছে বলে উত্তরবঙ্গে যে প্রচার চলছে সেসম্পর্কে সূর্য মিশ্র বলেন, রাজ্যগুলিকে ভেঙে ছোট ছোট রাজ্যে পরিণত করা আরএসএস-বিজেপি’র অ্যাজেন্ডা। পূর্বাঞ্চলে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ছোট ছোট রাজ্য তৈরি সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থপূরণের লক্ষ্যে পরিকল্পনা। এর জন্যই উত্তরবঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলিকে মদত দেওয়া হচ্ছে, তৃণমূলও এই কাজ করছে। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে যদি কোনও রাজনৈতিক দল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতিরোধ করে থাকে তবে সেই দলের নাম সিপিআই(এম)। এর জন্য আমাদের অনেক রক্ত ও প্রাণ দিতে হয়েছে। ধূপগুড়িতে একই দিনে পার্টি অফিসে ঢুকে কেএলও সন্ত্রাসবাদীরা আমাদের পার্টির পাঁচজন কমরেডকে খুন করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে জলপাইগুড়ি জেলায় বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি কেএলও’র হাতে খুন হতে হয়েছে বহু সিপিআই(এম) নেতা ও কর্মীকে। বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে জনবিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন ফের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত দিচ্ছে তৃণমূল এবং বিজেপি।
রবিবার দুপুরে ময়নাগুড়িতে সিপিআই(এম) অফিসে পার্টির এরিয়া কমিটির সদস্যদের নিয়ে এক সভায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে মোদী সরকারের নতজানু হওয়ার বিপদ ব্যাখ্যা করেছেন সূর্য মিশ্র। তিনি বলেছেন, ভারতের দীর্ঘদিনের জোট নিরপেক্ষ নীতি থেকে সরে গিয়ে মোদী সরকার আমেরিকার তোষামোদী করছে, দেশের সব রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ জলের দরে বিক্রি করে দিচ্ছে। তৃণমূলকে শরিক রেখে বাজপেয়ী সরকার যে কাজ শুরু করেছিল, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদী এখন আরও দ্রুত গতিতে সেই কাজ করছেন। তৃণমূল আর বিজেপি যতই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা খেলুক, আসলে দুই দলই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের টানা সুতোয় নাচছে।
Comments :0