তিনি মনে করতেন উগ্র জাতীয়তাবাদ মানবতার আশীর্বাদ নয়, সভ্যতার সঙ্কট। তিনি দেশপ্রেমিক। তাঁর লেখা গান দু’টি দেশের জাতীয় সঙ্গীত। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ মানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম চিন্তকও। ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থে নিজের রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন কবি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
ফ্যাসিবাদ যখনই ক্ষমতা দখল করেছে তখনই উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তা ভাবনাকে হাতিয়ার করেছে। যে জাতীয়তাবাদের মধ্যে নেই সহিষ্ণুতা। আর তাই জাতীয়তাবাদের নাম করে অনায়াসে গরুর মাংস রাখার অপরাধে একজনকে পিটিয়ে মারা যায়। লাভ জিহাদের নাম করে উন্মত্তের মতো তান্ডব চালাতে পারে বজরঙ দল। রবীন্দ্রনাথের দেশ আজ দঙ্গাবাজদের কবলে। আক্রান্ত সংবিধান।
‘বিভেদের মাঝে দেখো মিলনও মহান’-র চিন্তা আজ লুন্ঠিত। বহুত্ববাদের ধারণাকে খতম করতে গোটা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভেদের বিষ।
ফরাসী বিপ্লবের পর ইউরোপে যে জাতীয়তাবাদের চিন্তা ভাবনা ছড়িয়ে পড়েছিল তার সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদের বহু ফারাক। রাজতন্ত্রকে সরাতে জাতীয়তাবাদের ভাবধারায় ইউরোপের মানুষ নিজেদের দেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করতে থাকেন। চার্চের সঙ্গে রাষ্ট্র এবং ধর্মের সঙ্গে শাসনকে পৃথক করার ধারণা এই সময়ের। কিন্তু পরবর্তী সময় এই জাতীয়তাবাদকে বিকৃত করে হাতিয়ার করে ফ্যাসিবাদী শক্তি। উগ্র জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করে ক্ষমতা দখল করে হিটলার, মুসোলিনির মতো ফ্যাসিবাদের ধারক বাহকরা। উগ্র জাতীয়তাবাদ সর্বত্র শত্রু নির্মাণ করে। ইউরোপে উগ্র দক্ষিণপন্থা শত্রু করছে অভিবাসীদের, ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের।
ভারতে আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক মঞ্চ বিজেপি এমন অসহিষ্ণু, হিংস্র জাতীয়তাবাদের প্রচারক।
ন্যাশনালিজম গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ এই জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর বিরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। ইউরোপের ধাঁচে যেই জাতীয়তাবাদী চিন্তা ভাবনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে তা রবীন্দ্রনাথকে ক্ষুব্ধ এবং ব্যথিত করে। কবি ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদকে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং প্রাধান্যকামী সভ্যতা বলে চিহ্নিত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যে, এমন জাতীয়তাবাদ অশুভের নিষ্ঠুর মহামারী। বিশ্বমানবকে যা আচ্ছন্ন করে রাখছে।
রবীন্দ্রনাথের কাছে কোনও জাতির থেকে মানুষ ছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয়তাবাদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের বীজ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি জাতীবতাবাদকে ‘নেশা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই নেশায় মানুষ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মানুষ বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়। জাতীয়তাবাদের প্রভাবে মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাব সৃষ্টি হয়।
হিন্দি, হিন্দু এবং হিন্দুস্তান- এমন জিগির এই অসহিষ্ণু জাতীয়তাবাদের ফসল।
আরএসএস-বিজেপি ভিন্ন ধর্মের দুই মানুষের ভালোবাসাকে বলে ‘লাভ জিহাদ’। জাতীয়তাবাদের নাম করে পিটিয়ে মারা হয় অহিন্দুকে। রামনবমীর নাম করে দাঙ্গা হয় দেশে। রাম জন্মভূমির কথা বলে ভাঙা হয় মসজিদ। প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন ‘অবতার’। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন নতুন মন্দির উদ্বোধনে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উল্লেখ আছে মানুষ বা জনগন ছাড়া কোনও রাষ্ট্র তৈরি হতে পারেনা। বর্তমান ভারতে সেই জনগণ আজ উপেক্ষিত। ক্ষুধার সূচকে দেশ পিছিয়ে যাচ্ছে। বেকারত্ব বাড়ছে। বিজেপি আরএসএস জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে একদল মানুষকে ভুলিয়ে রাখতে চাইছে।
কবি বার বার এই জাতীয়তাবাদকে ‘দানব’ বলে চিহ্নিত করেছেন। জাতীয়তাবাদের স্লোগান তুলে ইহুদিদের যেমন মারা হয়েছিল হিটলারের সময়ে, আজকের ভারতে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে এনআরসির নাম করে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখার মতলবে সেই মনোভাবই কাজ করছে।
‘সভ্যতার সঙ্কট’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছেন যে উগ্রজাতীয়তাবাদ অবধারিতভাবে সাম্রাজ্যবাদে পরিণতি লাভ করে। উনিশ শতকে ইংরেজরা যে ভাবে বিভিন্ন দেশের ক্ষমতা দখল করেছিল বর্তমান সময় সেই ভাবে ক্ষমতা দখল না হলেও বিভিন্ন চুক্তি, ব্যবসা, অর্থনীতির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের ক্ষমতা বিস্তার করছে। আর এর ফলে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘পৃথিবীতে নেশন গড়ে উঠল সত্যের জোরে, কিন্তু ন্যাশনালিজিম সত্য নয়, অথচ সেই জাতীয় গণ্ডি- দেবতার পূজার অনুষ্ঠান চারদিক থেকে নরবলির জোগান চলতে লাগল। যতদিন বিদেশী বলি জুটত ততদিন কোন কথা ছিল না; হঠাৎ ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দে পরস্পরকে বলি দেবার জন্য স্বয়ং যজমানদের মধ্যে টানাটানি পড়ে গেল। যুদ্ধ যখন পুরোদমে চলছিল তখন সকলেই ভাবছিল, যুদ্ধ মিটলেই অকল্যাণ মিটবে। যখন মিটল দেখা গেল, ঘুরে ফিরে সেই যুদ্ধটাই এসছে সন্ধিপত্রের মুখোশ পরে।’
সন্ধিপত্র বর্তমান বিশ্ব এই সন্ধিপত্র হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রধান হাতিয়ার। সময় বদলেছে যুগ বদলেছে। চরিত্র বদল করেছে সাম্রাজ্যবাদ।
রবীন্দ্রনাথ যখন এই লেখা লিখছেন তখন সমসাময়িক ফ্যাসিবাদী রাজনীতির নেতারা জাতীয় চেতনাকে ঘৃণ্য রাজনৈতিক চক্রান্তের হাতিয়ার হিসাবে পরিণত করেছে। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেমন সরব থেকেছেন ঠিক তেমন ভাবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বার বার সরব হয়েছে কবির কলম।
নাৎসি বাহিনীকে যখন রাশিয়ার মাটিতে আটকে দেওয়া হয় তখন সেই সোভিয়েতের প্রতি নিজের বিশ্বাস ব্যক্ত করতে দ্বিধা বোধ করেননি কবি।
রক্তকরবী আজও ফোটে। কৃষক আন্দোলন হোক বা জেএনইউ’র ছাত্র সংসদ নির্বাচন। ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে পঞ্চকদের লড়াই চলছে।
Comments :0