পুজোর হই হট্টগোল বাইপাস করে বেড়াতে যাওয়া বাঙালির কাছে পাহাড় বরাবরই আকর্ষণের। ভারতের উত্তর পূর্বাংশে ছোট্ট পাহাড়ি অঞ্চল সান্দাকফু-ফালুট ভ্রমণ পিপাসু বাঙালির অন্যতম আকর্ষণকেন্দ্র। অন্যতম কারণ বোধহয় একই সঙ্গে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। ফালুট থেকে দেখা যায় মাউন্ট এভারেস্ট, সান্দাকফু থেকে দেখা যায় কে-টু।
ভাইফোঁটা কাটিয়ে পয়লা নভেম্বর শুরু হল আমাদের সান্দাকফু যাত্রা। এর আগেও যদিও বহুবার মানেভঞ্জন থেকে টংলু হয়ে সান্দাকফু অবধি ট্রেকের অভিজ্ঞতা রয়েছে ঝুলিতে। তবুও এবার একবার ফের পুরোনো স্মৃতির ঝুলিতে নতুন মাধুর্য যোগ করতে চললাম সান্দাকফু-ফালুট।
শিয়ালদহ থেকে রাত ১০.০৫ মিনিটের দার্জিলিং মেইলে চেপে পরেরদিন সকাল ৮টা নাগাদ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে সটান মানেভঞ্জন। এনজিপি থেকে মানেভঞ্জনের দূরত্ব প্রায় ৮৪ কিমি। পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘন্টা। মানেভঞ্জন থেকেই শুরু হয় মূল যাত্রা। এনজেপি থেকে সব গাড়ি এই পর্যন্তই আসে। তারপর নতুন গাড়ি ভাড়া করে সান্দাকফু ওঠার অনুমতি মেলে। মূলত ব্রিটিশ আমলের ল্যান্ড রোভারেই যেতে হয়। এই ঐতিহ্যশালী গাড়িগুলি আজও পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। গাড়ি পিছু ছয়জনের বেশি চড়ার অনুমতি নেই। এখান থেকে সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান অতিক্রম করে সান্দাকফু যাওয়ার অনুমতিপত্র নিতে হয়। ক্যামেরা থাকলে তার চার্জ দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। গাড়ি পিছু ১২ হাজার টাকা ভাড়া। ৩ রাত ৪ দিনের জন্য। দুপুর ২টোর মধ্যে এই অফিস বন্ধ হয়ে যাবে।
টুমলিং
আমরা ১৮ জন ছিলাম। আমাদের জন্য তিনটি ল্যান্ড রোভার বরাদ্দ হল। মানেভঞ্জন থেকে মূল যাত্রা শুরু হল সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে। তিন কিমি প্রচন্ড চড়াই পথ পেরিয়ে চিত্রেতে খানিক চায়ের বিরতি। ফের পথ চলা শুরু, গন্তব্য টুমলিং। চলতেই দেখা মিলল চোখ জুড়ানো ম্যাগনোলিয়াম ফুলের। গ্রীষ্মে এই দুধ সাদা ম্যাগনিলিয়ামের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দেয় আগুন রঙা রডোডেন্ড্রন।
টুমলিং পৌঁছাতে লাগলো প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা। এখানে উল্লেখ করা ভাল, অনেকেই টুমলিং এবং টোংলুকে এক ভেবে ফেলেন। দু’টি গ্রামই কাছাকাছি কিন্তু টোংলুতে রয়েছে জিটিএ ট্রেকার্স হাট, যা মূলত ট্রেকারদের রাত্রিবাসের জন্য।
টোংলু দার্জিলিংয়ে, টুমলিং নেপালে। পূর্ব নেপালের ইলাম জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে ছোট্ট গ্রাম টুমলিং। বলা যেতে পারে ভারত ও নেপাল সীমান্তের এক গ্রাম। টোংলুর ট্রেকার্স হাট অনেকটাই সস্তা। একবেলা থাকা খাওয়া মিলিয়ে মোটামুটি হাজার টাকার মধ্যে। বুক করতে হয় অনলাইনে (গিয়েও বুক করা যায় যদি রুম ফাঁকা থাকে)। ট্রেকার্স হাট কিন্তু হোটেল নয়। এখানে বাথরুম একটিই, একই ঘরেই সকলকে থাকতে হয়।
টুমলিংয়ের হোমস্টেগুলির চার্জ অনেকটাই বেশি, এখানে পরিষেবাও অনেকটাই ভাল। যদিও টোংলু থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেক বেশি মনোরম। মেঘ না থাকলে পরিষ্কার দেখা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘাও। এখানকার সুর্যাস্ত এবং সূর্যোদয় যেন অপার সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অপেক্ষায় প্রকৃতি। পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে টুমলিংকে গড়ে তোলার মূল কান্ডারি এই গ্রামেরই এক ষাটোর্ধ্ব নেপালী মহিলা- নীলা গুরুং। তাঁর উদ্যোগেই টুমলিং ক্রমশ হয়ে উঠেছে এক আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। এই ছোট্ট পাহাড়ি এলাকার মানুষের জীবন জীবিকার পথ খুলে গেছে। তাঁরই উদ্যোগে ওই এলাকায় গড়ে উঠেছে হোমস্টে; শুরু হয়েছে বিদ্যুৎহীন এলাকায় সৌর শক্তির ব্যবহার।
টুমলিংয়ে আমরা ছিলাম ‘শিকারা লজ’-এ। চব্বিশ ঘন্টায় মাথা পিছু প্যাকেজ ১৭০০ টাকার।
(*পরের অংশ কাল*)
Comments :0