Tripura election

বিরোধী ভোট ভাগে ত্রিপুরায় কান ঘেঁষে জয়ী বিজেপি

জাতীয়

স্বর্ণেন্দু দত্ত: আগরতলা

ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনে ভোট-আসন দুইই কমে কোনক্রমে গরিষ্ঠতা অর্জন করলো বিজেপি। ত্রিপুরা জুড়ে বিজেপি জোট সরকার বিরোধী যে প্রবণতা দেখে গিয়েছিল নির্বাচনী প্রচার পর্বে, ভোটের ফলাফলে তার স্পষ্ট প্রতিফলন রয়েছে। কিন্তু বিরোধী ভোট ভাগের সুযোগে নিয়েছে বিজেপি। ২৪টি আসনে বামফ্রন্ট-কংগ্রেস এবং তিপ্রা মথার মধ্যে ভোট ভাগাভাগির সুযোগে জয় পেয়ে গেছে বিজেপি। 
বৃহস্পতিবার ভোট গণনার শুরু থেকেই কিছু আসন বাদ দিয়ে টানাপোড়েন চলছিল। একটা সময় পর্যন্ত ত্রিশঙ্কু বিধানসভার ইঙ্গিতই ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোট বিভাজনের সুযোগেই বিজেপি আসনগুলি নিশ্চিত করতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত বিজেপি ৩২টি আসনে জয় পায়। জোট সঙ্গী আইপিএফটি ১টি। ৬০ আসনের বিধানসভায় ৩১ আসন পেলে গরিষ্ঠতার থেকে বিজেপি জোটের ২টি আসন বেশি। সিপিআই(এম) ১১টি, কংগ্রেস ৩টি আসনে জয় পায়। ভোটপূর্ব আসন সমঝোতার হিসাবে ১৪টি আসন। তিপ্রা মথা পেয়েছে ১৩টি আসন। শতাংশের হিসাবে বিজেপি জোটসঙ্গীকে নিয়ে পেয়েছে ৪০ শতাংশ ভোট। গতবার ওই জোট পেয়েছিল ৪৪টি আসন, ৫১ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে, এবার বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং তিপ্রা মথার ভোট মিলিতভাবে প্রায় ৫৫ শতাংশ। তৃণমূল কংগ্রেস ২৮টি আসনে প্রার্থী দিলেও মোট ১ শতাংশ ভোটও জোটেনি। নোটার থেকেও কম ভোট পেয়েছে তৃণমূল। 
অমরপুর, বাগবাসা, বাগমা, বিশালগড়, চণ্ডীপুর, ছামনু, ধনপুর, জোলাইবাড়ি, কাকড়াবন-শালগড়া, কল্যাণপুর-প্রমোদনগর, কমলাসাগর, কমলপুর, খয়েরপুর, কৃষ্ণপুর, মজলিশপুর, মনু, মোহনপুর, পাবিয়াছড়া, পানিসাগর, পেচারথল, রাজনগর, শান্তিরবাজার, সুরমা, তেলিয়ামুড়া আসনে ভোট ভাগাভাগির সুযোগ নিয়েছে বিজেপি। এরমধ্যে বাগবাসা, বিশালগড়, চণ্ডীপুর, ধনপুর, জোলাইবাড়ি, কাকড়াবন-শালগড়া, কমলাসাগর, মনু, রাজনগর আসনে গতবার জয়ী হয়েছিল বামফ্রন্ট। এরমধ্যে দুটি আসন উপজাতি সংরক্ষিত আসন। বাকি আসনগুলি সাধারণ কেন্দ্র হলেও সেখানে উপজাতি ভোটার আছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে, ওই সব আসনে উপজাতি ভোটের বড় অংশ মথার দিকে সমর্থন করায় বিজেপি’র জয় পেতে সুবিধা হয়েছে। 
রাজ্যের উপজাতি সংরক্ষিত ২০ আসনের ১৩টি পেয়েছে তিপ্রা মথা। বিজেপি পেয়েছে ৬ টি আসন, জোটসঙ্গী আইপিএফটি ১টি আসন। 
ভোট এবং আসন কমার ধাক্কায় উপমুখ্যমন্ত্রী যিষ্ণু দেববর্মা চড়িলাম কেন্দ্রে পরাস্ত হয়েছেন। ওই কেন্দ্রে তিপ্রা মথার প্রার্থী সুবোধ দেববর্মা তাঁকে ৮৫৮ ভোটে পরাস্ত করেছেন। আগরতলার বনমালীপুর কেন্দ্রে বিজেপি’র প্রদেশ সভাপতি রাজীব ভট্টাচার্য কংগ্রেসের গোপাল রায়ের কাছে ১৩৬৯ ভোটে পরাস্ত হয়েছেন। বিধানসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ রেবতীমোহন দাসকে প্রতাপগড় কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী রামু দাস পরাস্ত করেছেন ২ হাজারের বেশি ভোটে। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা আগরতলার টাউন বড়দোয়ালি কেন্দ্রে এক হাজারের কিছু বেশি ভোটে জয়ী হয়েছেন। এই কেন্দ্রে সকাল থেকেই টানটান লড়াই হয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী প্রতিমা ভৌমিক ধনপুর কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন। 
অন্যদিকে, বিরোধীদের মধ্যে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরি সাব্রুম থেকে, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বীরজিৎ সিনহা কৈলাসহর থেকে, কংগ্রেস নেতা সুদীপ রায় বর্মণ আগরতলা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন। এই দুটি কেন্দ্র ছাড়াও কংগ্রেস বনমালীপুর কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে। সিপিআই(এম) সাব্রুম, বামুটিয়া, বড়জলা, প্রতাপগড়, বিলোনিয়া— এই পাঁচটি আসন এবার নতুন করে জয় পেয়েছে। 
২০১৮ সালে রাজ্যে বিপুল জয়ের পরে বিজেপি বামপন্থীদের উপরে বিশেষত সিপিআই (এম)’র উপর ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস নামিয়ে আনে। শত শত অফিস ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। পার্টির রাজ্য দপ্তর দশরথ দেব ভবনও সেই আক্রমণের থেকে বাদ যায়নি। দেশের কথা পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পত্রিকা অফিসেও হামলা হয়। পার্টিনেতা, কর্মী থেকে সাধারণ সমর্থকরা গত পাঁচ বছরে দুর্বিষহ আক্রমণের মুখে পড়েছেন। শারীরিক আক্রমণের পাশাপাশি তাদের রুটি-রুজির সংস্থানগুলিও ধ্বংস করা হয়। পঞ্চায়েত, পৌরসভা এমনকি লোকসভা ভোটেও তীব্র সন্ত্রাস, ভোট লুট করা হয়। ক্রমশ আক্রমণ প্রসারিত হয় কংগ্রেস সহ অন্যান্য দলের উপরেও। নির্বাচনের তিন মাস আগে পর্যন্ত রাজ্যের বিস্তীর্ণ অংশে কোনোরকম রাজনৈতিক কাজ করার সুযোগই ছিল না। 
এইরকম পরিস্থিতিতে শুরু থেকেই সিপিআই(এম) ত্রিপুরায় বিজেপি বিরোধী ভোটকে একজোট করার চেষ্টা করেছে। সেই লক্ষ্যেই কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা হয়। পাশাপাশি তিপ্রা মথাকেও বারে বারে আসন সমঝোতায় আসার জন্য আবেদন জানিয়েছিল পার্টি। উল্লেখ্য, ত্রিপুরার পূর্বতন রাজপরিবারের বর্তমান উত্তরাধিকারী প্রদ্যোৎ মানিক্য দেববর্মণ উপজাতিদের পরিচিতি ভিত্তিক দল তিপ্রা মথা গঠন করেন বছর দুয়েক আগে এডিসি নির্বাচনের সময়ে। উপজাতিদের জন্য স্বশাসিত জেলা পরিষদের এই আসনগুলিতে ভালো ফল করে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল মথা। এডিসি নির্বাচনে মথার জয়ের পরে বিজেপি’র সঙ্গে সঙ্ঘাত তীব্র হয়। এডিসি পরিচালনায় বাধা দিতে থাকে যাতে তারা কাজ করতে না পারে। এই পরিস্থিতি বিধানসভা ভোটে সিপিআই(এম) মথাকেও আহ্বান জানিয়েছিল বিজেপি বিরোধী আসন সমঝোতায় আসার জন্য। একই সঙ্গে পার্টির পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে দেওয়া হয় রাজ্যভাগের কোনও দাবি সমর্থন করা হবে না। সেই দাবি বাদ দিয়ে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে উপজাতিদের আরও স্বায়ত্তশাসন এবং উন্নয়নের জন্য সমস্ত বিষয়ে সহমতির কথা জানানো হয়। কিন্তু মথা সেই সমঝোতায় আসেনি। 
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, মথা প্রধান চাইছিলেন ত্রিশঙ্কু বিধানসভা। সেই ক্ষেত্রে তাঁর দর কষাকষির সুযোগ থাকত। নির্বাচন প্রচার পর্বেও মথা কর্মীরা এই কথাটাই বারে বারে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তারাই নির্ণায়ক শক্তি হতে চাইছেন। সেই কারণেই মথা বিজেপি বিরোধী আসন সমঝোতায় আসতে চায়নি। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক জীতন্দ্র চৌধুরি সাংবাদিক সম্মেলনেই প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ভোট ভাগাভাগিতে বিজেপি যাতে জয়ে সুযোগ না পায় সেটা নিশ্চিত করতে। শেষ পর্যন্ত সেটাই সত্য হলো। বিজেপি গরিষ্ঠতা পেয়ে যাওয়ায় দরকষাকষি বা সরকার নিয়ন্ত্রণের কোনও সুযোগ আর রইল না তিপ্রা মথা প্রধানের হাতে। আখেরে লাভ হলো বিজেপি’র। কিন্তু ত্রিপুরার যে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিজেপি বিরোধী মনোভাব থেকে ভোট দিলেন, তাদের আশা অপূর্ণ থেকে গেল।

Comments :0

Login to leave a comment