রাজ্য সরকারের হাতে থাকা বিপুল জমি বিক্রি করার খোলা ছাড়পত্র দিতে চলেছে মমতা ব্যানার্জির মন্ত্রীসভা।
রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তরের হাতে বিপুল জমি আছে। সেই জমিকে এবার ‘লিজ হোল্ড-এর নীতি থেকে সরে এসে খোলাখুলি বিক্রি করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে রাজ্য সরকার। চলতি মাসেই রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠকে সরকারি জমি বিক্রির ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ঘটনা হলো, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের হাতে বিপুল পরিমাণ জমি আছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে বিভিন্ন দপ্তরের কাজের জন্য জমি অধিগ্রহণ করেছিল রাজ্য সরকার। এখন সেই জমিকেই উদ্বৃত্ত ঘোষণা করে দেদার বিক্রির পথে যাওয়ার ছক করেছে রাজ্য সরকার।
এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে সরকারি জমি বিক্রি করেছে রাজ্য সরকার। ক্ষমতায় আসার পরই কলকাতায় পরিবহণ নিগমের জমি বিক্রি করে কোষাগারে টাকা ঢুকিয়েছিল রাজ্য সরকার। বিচ্ছিন্নভাবে জমি বিক্রির পথ থেকে এবার সরে নীতিগতভাবে সরকারের হাতে থাকা বিপুল জমি দেদার বিক্রির দিকে এগচ্ছে নবান্ন। জমি বিক্রির প্রসঙ্গে নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, ‘‘লিজ হোল্ড জমি থেকে সেলামি বাবদ আয়ের সংস্থান ছিল। কিন্তু তার থেকে জমি বিক্রি করলে টাকার পরিমাণ বেশি। তাই সরকারি জমি সরাসরি বিক্রি করে দেওয়া হবে।’’
ইতিমধ্যেই রাজ্যের অধীনস্ত সংস্থা, বিশেষত বিভিন্ন কর্পোরেশন, উন্নয়ন সংস্থা সহ পৌরসভা-কর্পোরেশনের হাতে থাকা জমিকে বিক্রির ছাড়পত্র দিয়ে রাখা হয়েছে। গত আগস্টেই এর জন্য রাজ্যের ভূমি সংস্কার দপ্তর আইন পরিবর্তন করে নিয়েছে। এমনকী রাজ্য মন্ত্রীসভার অনুমোদনের ব্যবস্থাও করে ফেলা হয়েছে। জমি বরাদ্দ নীতিতে পরিবর্তন এনে বিপুল পরিমাণ সরকারি জমি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করে ফেলা হয়েছে। সরকারি খাস জমিকে আপাতত বিক্রির বাইরে রাখা হয়েছে। তবে খাস জমির বাইরে সরকার অধিগৃহীত বিপুল জমি বিক্রি করে আয় বাড়ানোর কাজে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে সরকারের অধীনস্ত সংস্থাগুলিকে। পৌর ও নগরোন্নয়ন দপ্তর সূ্ত্রে জানা গিয়েছে, কেএমডিএ’র তরফে তাদের হাতে থাকা জমি বিক্রি করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। কলকাতায় কেএমডিএ’র কসবা ও গলফ গ্রিন এলাকার জমি ই-অকশনে তোলার বন্দোবস্ত প্রায় পাকা। দপ্তরের এক আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘জমি বেআইনি দখলে চলে যাচ্ছে। দখলদারদের উচ্ছেদ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই জমিকে বিক্রি করে দিতে পারলে সরকারি কোষাগারে টাকা ঢুকবে।’’ আসলে দখলদারের হাতে চলে যাওয়ার হাত থেকে সরকারি জমিকে রক্ষার পরিবর্তে জমি বিক্রি করে দেওয়াকেই এখন উপযুক্ত মনে করছে তৃণমূল সরকার।
রাজ্য সরকার অধিগৃহীত সংস্থার হাতে থাকা জমি বিক্রির নীতিতে পরিবর্তন এনে এখন জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সংস্থা চাইলেই তাদের জমি যে কোনও ব্যাক্তি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে বিক্রি করতে পারে। রাজ্যের ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক চাহিদা ও আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলা করার জন্যই জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।
কলকাতা মহানগরে আলিপুর ও প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের জমি বেহাত হয়ে গিয়েছে। সরকারি ছাপাখানা বিজি প্রেসের সব কর্মচারীকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে গোপলনগরে প্রেসের জমি। একই কায়দায় জোর করে বদলি করে দেওয়া হয়েছে দুর্গাপুরের ডিপিএল কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের। জমি বিক্রির কাজ মসৃণ করতে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েই চলেছে রাজ্য সরকার।
গত সেপ্টেম্বর মাসে নবান্নে সব দপ্তরের সচিবদের সঙ্গে প্রশাসনিক পর্যালোচনা বৈঠকে বসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ওই বৈঠকেই রাজ্যের আয় বাড়াতে সরকারি জমি বিক্রি করে আয় কীভাবে বাড়ানো যায়, তার জন্য জেলা শাসক সহ সব দপ্তরের সচিবদের মুখ্যমন্ত্রী পরিকল্পনা তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই বৈঠকেই ঠিক হয়েছিল, ৩০ থেকে ৩৫টি সরকারি জমির প্লট দীর্ঘ দিন ধরে পড়ে আছে। কেন তা পড়ে আছে, তা নিয়ে ওই বৈঠকেই মুখ্যমন্ত্রীর তোপের মুখে পড়তে হয় ভূমি সংস্কার দপ্তরের আধিকারিকদের। ওই জমি বিক্রি করতে পারলে সরকারের কোষাগারে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার সংস্থান হতো। সূত্রের খবর, ওই বৈঠক থেকে রাজ্যের হাতে পড়ে থাকা বিপুল সরকারি জমিকে কীভাবে ব্যবহার করে সরকার আয় বাড়াতে পারে, মুখ্যমন্ত্রী তার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে জমি বিক্রির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার দায়িত্ব ছিল রাজ্যের প্রাক্তন অর্থ মন্ত্রী ও বর্তমান আর্থিক পরামর্শদাতা অমিত মিত্রর। এরপরেই বন্ধ কারখানা সহ সরকারি জমি কোথায় কী আছে, তার তালিকা তৈরি করে পাঠানো হয়েছে রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীর কাছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, আর্থিক পরামর্শদাতা অমিত মিত্র, মুখ্যসচিব ও অর্থ সচিব— চারজন মিলে নিয়েছেন সরকারি জমিকে নিলামে চড়ানোর সিদ্ধান্ত।
এবার সেই সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত রূপ দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজ্য সরকার। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের হাতে পড়ে থাকা বিপুল জমিকে বিক্রি করার ভাবনায় সিলমোহর দিতে চলেছে নবান্ন।
Comments :0