Post Editorial

ফ্যাসিবাদের আড়াল-অন্দর

উত্তর সম্পাদকীয়​

শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
১৪ মে ২০২৫ একাধিক সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠা খুলেই মাথায় ফৌজি টুপি পরে, চোখে কায়দার কালো চশমা লাগিয়ে ফৌজি সেলামদারির ভঙ্গিমায় আত্মগর্বস্ফীত প্রধানমন্ত্রীর সরকারি সূত্রে বহুল প্রচারিত ছবি— তাঁর পিছনেই আবার তথাকথিত ‘সুদর্শন চক্র’— দেখে লজ্জা, ঘৃণা, গ্লানিতে আমার শরীর-সত্তা বিষিয়ে উঠেছিল। লজ্জা— কারণ, নিরীহ, নিরপরাধ, পর্যটকদের অতর্কিতে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে তার দায়িত্ব নিয়ে লজ্জা ও ক্ষমা স্বীকারের ন্যূনতম মানবিকতাবোধ প্রকাশ না করে প্রতিশোধস্পৃহার ইতর জান্তব আস্ফালনে মেতে উঠে যে প্রধানমন্ত্রী আরও কিছু নিরপরাধ মানুষের হত্যা ঘটান, সেই মৃতদের সংখ্যা প্রকাশে যাঁর নির্লজ্জ অনীহা, সেই প্রধানমন্ত্রীকে তো আমরাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত করেছি, সেই লজ্জাহীনের আচার-আচরণে তাই লজ্জা আমাদেরই! সান্ত্বনা হয়তো এইটুকুই যে একশো বছর আগে ১৯২৩ সালে ফ্যাসিবাদের— ‘ফ্যাশিস্‌কো’, ইতালীয় ভাষায় একটি শব্দ, থেকেই আজও ভয়াবহভাবে আসীন সেই সংগঠিত ইতরতার অবস্থান ও ক্রমবিস্তার— অভ্যুদয় ঘটেছিল গণতান্ত্রিক পথেই। সারা ইতালি থেকে রোম মহানগরীতে সমবেত হয়ে সমবেত জনসাধারণ দেশের রাজাকে ঘেরাও করে মুসোলিনির হাতে ডিকটেটরি ক্ষমতা তুলে দিতে বাধ্য করে। ক’জন জানেন বা মনে রেখেছেন জানি না, ইতালীয় ভাষায় ‘ফাশেস’ নামে একটি পীড়নাস্ত্র তথা মারণাস্ত্রকেই তাঁর দলের প্রতীক ও নামে মুসোলিনি আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। গোটা কয়েক ছোট করে ছাঁটা বংশদণ্ড আঁট করে রজ্জুবদ্ধ এই ফাশেস আঘাতে-মারণে লাঠিসোঁটার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিমান। দলের প্রতীকে শিল্পসাহিত্য-রসিক (নরেন্দ্র মোদীর মতো নিপাট রুচিবিহীন নন) মুসোলিনি ওই ফাশেস-এর রজ্জুবন্ধনের মধ্যে একটি শাণিত কুঠার গুঁজে দিয়ে ওই ফাশেস-কে দাঁড় করে তার উপর বসিয়েছিলেন এক শিকারি ঈগল পাখি, তার মেলে-ধরা ডানা। সেই শুরু!
১৯২৩-এ ইতালিতে মুসোলিনি, ১৯৩৩-এ র্জামানিতে হিটলার, ১৯৩৬ সালে স্পেন-এ ফ্রাঙ্কো — এক এক ফ্যাসিস্ত নায়কের ক্ষমতাপ্রাপ্তি। তিন দেশেই কার্যকারণ পরম্পরায় অভিন্ন— প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঘাতে পর্যুদস্ত অর্থনীতিতে চূড়ান্ত সঙ্কট ও ঘোরতর বেকারির আবহে শিল্পপতিদের সঙ্গে আঁতাত করে তাদের দানে-সহায়-প্রশ্রয়ে রাষ্ট্রশক্তির ফ্যাসিস্তিকরণ। রাজনীতিটা মোটামুটি এইরকম: শিল্পপতিদের দাবি মতো অবাধ সুযোগ-সুবিধা দান; ফ্যাসিস্ত দলের দুর্বৃত্ত গুন্ডারা শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষায় শ্রমিকদলন, শ্রমিকপেষণ, শ্রমিকদের স্বাধিকারের দাবি দাবানোয় সদা সক্রিয় থেকে জীবিকা উপার্জনে (সরকারি ভাতা-বেতনে, নয়তো শিল্পপ‍‌তিদের বরাদ্দের প্রসাদে) তুষ্ট। রাষ্ট্র ও ফ্যাসিস্ত শক্তির এই দ্বিপক্ষীয় মদতদারিতে পুষ্ট ইতালীয় ফি‌য়্যাট ও অলিভেত্তি-র মতো বিপুলায়তন ব্যবসায় শিল্পসংস্থা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অপঘাতে (বোমারু বিমানের গোলায় তাদের একাধিক বিশাল কারখানা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে) বিধ্বস্ত তাদের উৎপাদন বৈভব আবার ফিরে পায়। হিটলারের জার্মানিতেও শিন্‌ড্‌লার পুঁজিপতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ফ্যাসিবাদের এই একই আঁতাতে শিন্‌ড্‌লারদের লক্ষ্মী লাভ।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে পুঁজিপতি তথা কর্পোরেট গোষ্ঠী, রাষ্ট্রশক্তি ও সংগঠিত দুর্বৃত্ত ফ্যাসিস্ত শক্তির এই যৌথ আধিপত্যের যে ‘মডেল’ বা উপমান প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক অব্যবস্থায় পুঁজিবাদকে তার শক্তিমদমত্ততায়  বলীয়ান রেখেছিল, শোষণের নির্মমতা বহতা রেখেছিল, তারই উত্তরাধিকার বর্তেছে দারিদ্র, বেকারি, অপশাসন, দুর্নীতিতে কণ্কিকিত ভারতে। এতদিনে ফ্যাসিবাদের এই শতবর্ষীয় ইতিহাসে যুক্ত হয়েছে আরেকটি পক্ষ— মিডিয়া অর্থাৎ সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র-প্রমোদ ব্যবস্থায় ও বিপুল বেতার-সম্প্রচার ব্যবস্থা, যার দখল ও খবরদারি কর্পোরেট গোষ্ঠীর অধিকারে। পাঠক যদি খেয়াল করেন, লক্ষ্য করবেন, এক একটি ‘মাধ্যম’— সে কোনও বিশেষ পত্রিকা বা বিশেষ চ্যানেল হোক, বা ফেসবুক-ই হোক— তার রসিককুলকে সযত্নে ঠাহর বা বিচার করেই তার পণ্যসম্ভার সাজায়। কোথায়ও তার লক্ষ্য বিপুল জনসাধারণ; কোথায়ও শিক্ষিত, সচেতন, মধ্যবিত্ত; কোথায়ও উচ্চবিত্ত তরুণসমাজ। একই পণ্য, কিন্তু তার মোড়কে— আর ওই মোড়কেই ঝাঁজ, তাপ, কদর, আদর— স্বতন্ত্র আকর্ষণ। কিন্তু ওই সার্বিক সংবাদ-শাসনে কত কিছু চাপা পড়ে যায়, ধরা প‍‌ড়ে না।
অনেক দৃষ্টান্তেই তুলে ধরা যায়। তিনটি মাত্র বেছে নিলাম। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পরিবেশনে-প্রচারে দুই নারী সৈনিকের রোজকার উপস্থিতি মিডিয়া-মাহাত্ম্যে নিত্য ঘটাসমারোহে দৃশ্যমান। এ‍‌ই নারী মাহাত্ম্যের রাষ্ট্রীয়-সরকারি রমরমাকালেই নারী রাষ্ট্রপতিকেও হঠাৎ তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক মানমর্যাদার নিঃসঙ্গ আচারমাত্র সর্বস্ব বিলাসী বাস থেকে টান মেরে বার করে এনে সুপ্রিম কোর্টের মুখে চ্যালেক্রুবাজিতে নামিয়ে দেওয়া হলো। যুদ্ধের মহলা-প্রস্তুতি-তাপসঞ্চারে উদ্বেল রাষ্ট্রশক্তির এই নারীভজনায় কিন্তু কূট চালে যা তুলে ধরা হয় তা হলো নারীর পাতিব্রতাচিহ্নের মহিমায়নে নারীর পাতিব্রতাকেই— কার্যত কেবলমাত্র স্বামীর আশ্রিত-পালিত-চালিত নারীকেই— দেওয়া হলো নারীস্বরূপের একমেব পরিচয়। নারীকে শক্তিস্বরূপিনী মূর্তিতে— বিশেষত ফৌজি উর্দিতে— উপস্থাপন করেই তার সত্তাকে কী সুচতুর কৌশলে অবরুদ্ধ করে দেওয়া যায়!
নারীমহিমা প্রচারের তঞ্চকতায় এ‍‌ই চাতুরির সঙ্গে এবার মিলিয়ে নিন আরো একটা নীরবে ক্রমাগত ঘটমান ঘটনাপ্রবাহ— আইনের ফাঁক-ফোকরের সুযোগ নিয়ে বিজেপি’র তিন মেয়াদি এই শাসনপর্বে খুন-ধর্ষণের প্রমাণিত অপরাধে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের বিজেপি রাজ্য সরকার তথা রাষ্ট্রশক্তি বারবার তুচ্ছতম অছিলায় প্যারোলে কারান্তরাল থেকে মুক্তি দান করে চলেছেন, এমনকি দণ্ডকাল লাঘব করে সম্পূর্ণ মুক্তি দান করে যাচ্ছেন। পহেলগাম কাণ্ডের দিন পনেরো আগেই এই পরম্পরার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলীয় জনসেবাব্রতী নিষ্ঠাবান পাদ্রি গ্রাহাম স্টেনস ও তাঁর দুই পুত্র দশ বছর বয়সি ফিলিপ ও ছয় বছর বয়সি টি মথি-কে তাঁদের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার অপরাধে অপরাধী মহেন্দ্র হেমব্রমের আজীবন কারাদণ্ড মকুব করে মুক্তিদান; কেওনঝাড় কারাগারের সম্মুখে মুক্তিপ্রাপ্ত খুনীর সোচ্ছ্বাস সংবর্ধনায় জমজমাট হিন্দুত্ববাদী জনসমাবেশ। তিন বছর আগে একই ঘটনা ও দৃশ্য দেখা গেছে গুজরাটে। ২০০২ সালে গুজরাটের গণহত্যায় বিলকিস বানোর ধর্ষণেও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ডে, মায়ের চোখের সামনে তাঁর শিশুসন্তানকে হত্যার অপরাধে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত এগারোজন ধর্ষক খুনিকে একইভাবে দণ্ড মকুব করে রাজ্য সরকার মুক্তি দেয়; একইভাবে মুক্তিক্ষণে পুষ্পমাল্যে তাঁদের সংবর্ধিত করা হয়। এই কর্মক্রম রাষ্ট্র-ফ্যাসিস্তচক্র-কর্পোরেট গোষ্ঠী-মিডিয়া যূথের সুপরিকল্পিত এক অভিযান যাতে নারী ধর্ষণ-পীড়ন-হত্যায় পৌরুষের মহিমা প্রতিষ্ঠা ও সোচ্চার আত্মঘোষণা—  যারই উত্তরণ তথা সম্প্রসারণ ঘটে বারংবার প্রতিশোধ-প্রতিহিংসা-যুধ্যমানতা-র চিৎকৃত — বেতারে-মুদ্রণ মিডিয়ায়-সমাজমাধ্যমে— ক্রমাগত আবাহনে। পৌরুষের নারীদ্বেষী অনাচারকে আইনি রক্ষাকবচ তথা রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ী অনুমোদন জুগিয়ে এক সর্বব্যাপী মারণশক্তিকে দেশময় ছ‍‌ড়িয়ে দেওয়ার বাতাবরণে— রবীন্দ্রধিক্কৃত ‘জাতিপ্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায়ে’র প্রচারজলুসে, সৈন্য-সেনাবাহিনীর অহরহ যশোকীর্তনে জনসাধারণের প্রাত্যহিক জীবনাপণ তথা জীবনযন্ত্রণার যাবতীয় প্রতিকার প্রয়াসকে রাষ্ট্রীয় ত্রাসের দাপটে রুদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ১৯৩৬ সালে এই দানব-দানবীয়তার বিরুদ্ধে ‘সংগ্রামের তরে যারা প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে’ তাদেরই কাছে রবীন্দ্রনাথ যে প্রতিরোধী সংহতির আহ্বান জানিয়েছিলেন, তারই পুনরুচ্চারণের সময় হয়েছে। আমরা ভরসা রাখি রবীন্দ্রনাথের অমোঘ আশ্বাসবাণীতে :
স্বার্থের সমাপ্তি অপঘাতে। অকস্মাৎ
পরিপূর্ণস্ফী‍‌তি-মাঝে দারুণ আঘাত
বিদীর্ণ বিকীর্ণ করি চূর্ণ করে তারে
কালঝঞ্ঝা ঝংকারিত দুর্যোগ-আঁধারে।
একের স্পর্ধারে কভু নাহি দেয় স্থান
দীর্ঘকাল নিখিলের বিরাট বিধান।...
ছুটিয়াছে জাতিপ্রেম মৃত্যুর সন্ধানে
বাহি স্বার্থতরী, গুপ্ত পর্বতের পানে।
স্বার্থান্ধ জাতিপ্রেমেরই বিষবীজে উপ্ত হয় জাতিবিদ্বেষ। 
রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যদ্‌বাণী, তখন 
বীভৎস আহ্বান
বীভৎস ক্ষুধারে করে নির্দয় নিলাজ,
তখন গর্জিয়া নামে তব রুদ্র বাজ।

Comments :0

Login to leave a comment