Ukrain war Post Editorial

ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর: প্রভাব বিশ্বব্যাপী মৃদুল দে

সম্পাদকীয় বিভাগ

ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর। এ কি স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি, কোথায় তার শেষ কারও জানা নেই। রাশিয়া বিধ্বস্ত হয়ে পরাস্ত না হওয়া পর্যন্ত আমেরিকা যুদ্ধবিরতি বা যুদ্ধবন্ধের চুক্তি নিয়ে কোনও শব্দ উচ্চারণ করছে না, করবেও না এরকমই মনোভাব। ইউরোপের পশ্চিমী দেশগুলিও এই যুদ্ধে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু আমেরিকা ও ন্যাটোর চোখ রাঙানির সামনে তাদেরও নিজস্ব কিছু বলার অবস্থা নেই। আমেরিকার অন্যান্য যুদ্ধের চেয়ে ইউক্রেন যুদ্ধের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আমেরিকা যত দেশে যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসন চালিয়েছে বা চাপ দিয়ে নতিস্বীকার করিয়েছে তাদের সামরিক বাহিনী দুর্বল, তাদের যুদ্ধের অস্ত্রসম্ভারও সেরকম নেই, পারমাণবিক অস্ত্রের তো কথাই ওঠে না। এই প্রথম একটা যুদ্ধ এমন দেশে আমেরিকা বাধিয়েছে, যেখানে রাশিয়া সামরিক বাহিনী ও আধুনিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ। পারমাণবিক অস্ত্রে আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম। আমেরিকার কর্তৃত্বে একমেরু-পৃথিবী রাশিয়ার সামনে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে একটা অঘোষিত বোঝাপড়া পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আমেরিকা তা হতে দেবে না, তার জন্য রাশিয়াকে ধ্বংস করা প্রয়োজন। তাতে কাবু হবে ইউরোপও। অন্যদিকে চীনকে করতে হবে দুর্বল।


একটার পর একটা বিরোধ বা সংঘর্ষের আগুনে আমেরিকা ঘৃতাহুতি দিয়েছে ২০২২ সালে। ইউক্রেন, কোভিড-১৯-এর ওমিক্রনের নতুন নতুন বৈচিত্র, খাদ্যসঙ্কট, মুদ্রাস্ফীতির লাগাতার বৃদ্ধি, জ্বালানি নিয়ে নিরাপত্তা, ছেদহীন আর্থিক মন্দা, আর্থিক আরোগ্যের বন্ধ রাস্তা, উদ্বেগজনক জলবায়ু পরিস্থিতি, জলবায়ুর চলমান বিপদের মোকাবিলা নিয়ে আলোচনার বালাই নেই আমেরিকার। চীনকেও চাই যুদ্ধাতঙ্কে তটস্থ রাখা। ২০২২-র ফেব্রুয়ারি মার্কিন নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমী সব রাষ্ট্র ইউক্রেনের ফ্যাসিস্ত শক্তিগু‍‌লির পরিচালিত ইউক্রেনকে আর্থিক সামরিক সবকিছু দিয়ে চ‍‌লেছে রাশিয়াকে জব্দ করতে। এত আক্রমণ, অবরোধ সত্ত্বেও রাশিয়ার অর্থনীতিকে তারা ভাঙতে সফল হয়নি। আলোচনায় সাময়িকভাবে যুদ্ধ বন্ধ রাখারও তারা সম্পূর্ণ বিরোধী।
২০২৩ সাল যুদ্ধের এই বিভীষিকার মধ্যে চলবে, বিশেষজ্ঞদের অনুমান। আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য পুঁজিবাদী রাশিয়া সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ, সুদূর আমেরিকার সব ষড়যন্ত্রকে ঘায়েল করার জন্য। ২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটের ধাক্কা আমেরিকা এখনও সামলে উঠতে পারেনি, পারছেও না। এর মধ্যে চীন আর্থিক শক্তিতে আমেরিকার প্রায় সমকক্ষ হয়ে উঠেছে, এটাও আমেরিকার অসহ্য, চীনকে তারা প্রধান এক শত্রু হিসাবে গণ্য করে তার সমৃদ্ধিকে পর্যুদস্ত করার জন্য সামরিক দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে। ট্রাম্প জমানার পর ২০২১-২২ সালে আমেরিকার চীন-বিরোধী অভিযান ও তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সাল এই পরিস্থিতি কোথায় দাঁড় করাবে তা কারও জানা নেই। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে না গিয়ে আমেরিকা অর্থনৈতিক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে রাশিয়া, চীন ও অন্যান্য কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের মানুষ এই আর্থিক যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে। আমেরিকাও তাতে ক্ষতিগ্রস্ত, ইউরোপও নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন। এই আর্থিক অবরোধে কমবেশি সব দেশ সমস্যায় ভুগছে— প্রযুক্তি, খাদ্য, সার, জ্বালানি ও শিল্পোন্নয়নে।


২০২২-২৩ সালে ইউক্রেনকে কামানের খোরাক হিসাবে ঠেলে দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ন্যাটো যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তার সূত্রপাত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই। মৌখিক আশ্বাস বা লিখিত চুক্তির এক কানাকড়িও মূল্য নেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কে, বিশেষত আগ্রাসী আমেরিকার কাছে। আমেরিকার সামরিক জোট ন্যাটো, পূর্বদিকে কিংবা রাশিয়া ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে থাকা দেশগুলির দিকে সম্প্রসারিত হবে না এবং গর্বাচ্যভের ‘কমন ইউরোপীয়ান হোম’ সামরিক জোটের বাইরে আত্মপ্রকাশের স্বপ্নে আমেরিকা মর্যাদা দেবে, অনেক আশ্বাসবাণী ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার আগেই আমেরিকার প্রতি অগাধ বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল গর্বাচ্যভ ও তার অনুগামী সোভিয়েত নেতৃত্বের। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর এই গদগদ সম্পর্কের ফানুস ফেটে যায়।
আজকের ইউক্রেন যুদ্ধের আমেরিকার প্রস্তুতি সেই ৯০’র দশক থেকে। ১৯৯৪ সালেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনকে আশ্বাস দেন, ন্যাটো পূর্বদিকে সম্প্রসারিত হবে না, কোনও ভয় নেই। আবার দেশে ফিরে সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলি থেকে আশ্রয় নেওয়া জাতিগত সংখ্যালঘুদের আশ্বাস দেন, কোনও ভয় নেই, সবকটি দেশকে ন্যাটো’র মধ্যে নিয়ে আসা হবে। ১৯৯৬ সালের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইয়েলৎসিনের ভরাডুবি অবস্থা, পরাজয় সুনিশ্চিত। এই নির্বাচনে ইয়েলৎসিনকে যে কোনোভাবে জেতানোর জন্য ক্লিন্টনের নেতৃত্বে আমেরিকার প্রশাসন সবরকম সাহায্য করে। তার মধ্যে অন্যতম অর্থ, প্রচার, মাফিয়া এবং রিগিঙ। রাশিয়ার মানুষ এ ধরনের নির্বাচনে অভ্যস্ত ছিল না, জানতো না রিগিঙ কী! জেতার পর আমেরিকার সব প্রস্তাবে সায় দিয়ে চলে ইয়েলৎসিন। ইয়েলৎসিনের পর প্রেসিডেন্ট পুতিনও প্রথম দিকে আমেরিকার সব কথায় সায় দিয়ে চলে। ক্লিন্টনের সময়েই শুরু হয় হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া এবং এর পর লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়াকে ন্যাটো সামরিক জোটের অভ্যন্তরে টেনে আনা। রাশিয়ার নেতারা বিপদ বুঝেও কিছু করে উঠতে পারার সামর্থ্য তাদের ছিল না। এই কাহিল অবস্থা দেখে ২০০৮সালে প্রেসিডেন্ট বুশ জর্জিয়া ও ইউক্রেনকে ন্যাটোর মধ্যে নিয়ে আসতে উদ্যোগ-আয়োজন শুরু করলে রাশিয়া তার সীমান্তে নিজের বিপদ বুঝে ১৭ বছর পর রুখে দাঁড়ায়।


বিরোধের সূত্রপাত এখান থেকে। আমেরিকান প্রশাসন এবার ইউক্রেনের সামরিক ও সরকারি ক্ষমতা নিজেদের অনুগত করে সামরিক ষড়যন্ত্রে অবতীর্ণ হয়। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও সরকারকে হটাতে আমেরিকা ফ্যাসিস্ত বাহিনী গড়ে তুলে হিংসাত্মক অভ্যুত্থান ঘটায়। তখন থেকে এই ফ্যাসিস্ত বাহিনী ও সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে কয়েক হাজার প্রশিক্ষক পাঠায় আমেরিকা, বিপুল অস্ত্র ও অর্থেরও জোগান দেয় পুতুল সরকারকে। ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষী এলাকাগুলিকে আমেরিকার ছক অনুসারে আক্রমণের পর আক্রমণে বিধ্বস্ত করা হয়, যাতে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত রুশ ভাষাভাষী অধ্যুষিত ডনবাস এলাকায় যুদ্ধে মোট ১৪ হাজার মানুষ নিহত হন। ২০১৪ সালে সংঘর্ষ থামাতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ, ইউক্রেন, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির উপস্থিতিতে চুক্তি হয় যে ডনবাস এলাকার দনেৎস্ক এবং লুহাস্ক সাধারণতন্ত্রকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে ইউক্রেনের মধ্যে, ইউক্রেন তাদের ক্ষমতা ও অধিকারের ওপর কোনও হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু চুক্তির কালি শুকোতে না শুকোতেই মার্কিন প্রশিক্ষিত ইউক্রেনের ফ্যাসিস্ত আঝভ বাহিনী ডনবাসে সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে দেয়। রাশিয়াও হস্তক্ষেপ করে, দখলও নেয় ক্রিমিয়ার।
ইউক্রেনকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করার যাবতীয় মার্কিন প্রস্তুতি যখন চলছে, তখনই পুতিনের রাশিয়া অপ্রস্তুত অবস্থায় ইউক্রেনে সামরিক  হস্তক্ষেপ করে। এ পর্যন্ত আমেরিকা আধুনিক অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য ছাড়াও ৫০ হাজার কোটি ডলার সাহায্য দেয় ইউক্রেনকে। দুনিয়া জুড়ে পশ্চিমীদের পক্ষে প্রচার করা হচ্ছে, ভারতীয় মিডিয়ায়ও একই প্রচার যে, রাশিয়া যুদ্ধ করছে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে, বিপন্ন ইউক্রেন-কে সাহায্য করতেই আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়া বিরোধী ভূমিকা পালন করছে। রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটোর মাধ্যমে আমেরিকার অস্ত্রসম্ভার গড়ে তোলা এবং ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘাঁটি বানানো আটকাতে প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনে সামরিক যুদ্ধ শুরুর আগে ন্যাটো’র কাছে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করা হবে না, এই নিরাপত্তা আশ্বাস চেয়ে কয়েকবার প্রস্তাব দেন। স্বভাবতই তাতে আমল দেয়নি আমেরিকা ও ন্যাটো, যারা যুদ্ধের আগেই প্রচার করে যায় রাশিয়া আক্রমণ করবে ইউক্রেন, যে যুদ্ধের মঞ্চ সাজিয়েছে আমেরিকাই। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে মীমাংসার উদ্যোগও নেয়নি পুতিন। যুদ্ধ এড়ানোর সব চেষ্টাও করেনি। কূটনৈতিক আলোচনার মধ্যে সমাধান, যুদ্ধ আটকাতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে সভার মাধ্যমে চুক্তি ইত্যাদি কোনও কিছুতেই আমেরিকা যুদ্ধ শুরুর পর ১০মাসে এক মুহূর্তের জন্য সায় দেয়নি; আর্থিক ক্ষতি যতই হোক, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াই যেহেতু আমেরিকার একমাত্র নীতি। আমেরিকা তার অবক্ষয়ী ক্ষমতার জন্যই এত যুদ্ধোন্মাদী। ‘স্বল্পমেয়াদি যন্ত্রণা, দীর্ঘমেয়াদি লাভ’ এই নীতি ইরাক যুদ্ধের সময়ও ছিল আমেরিকার নীতি, ইউক্রেন যুদ্ধেও তা-ই। আফগানিস্তান যুদ্ধে আমেরিকার এত যুদ্ধাপরাধের পর পরাজয়ের শেষে ইউক্রেনে এই যুদ্ধ। পারমাণবিক যুদ্ধেও তা পরিণত হতে পারে, এমন আশঙ্কাও উচ্চারিত হচ্ছে। চল‍‌তি সময়ে বিশ্বপরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেবে, তার অনেকটাই নির্ভর করে ন্যাটো রাশিয়ার চলতি ইউক্রেন যুদ্ধে। চীন রাশিয়া এক জায়গায় এলে আমেরিকার সমূহ বিপদ হতে পারে, এই রাজনৈতিক অনুমান অমূলক নয়। চীনের বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধ, তাইওয়ানকে ঘিরে, তাইওয়ানকে ইউক্রেনীকরণ করে চীন-বিরোধী উসকানিতেও আমেরিকার তৎপরতা বৃদ্ধি লক্ষণীয়। চীনকে আটকাতে না পারলে এশিয়া-ইউরোপের সংহতিও আটকানো যাবে না, রাশিয়াকেও না, এটাও আমেরিকার ছকের অংশ। যুদ্ধ বন্ধ হলেও রাশিয়া-আমেরিকা ঠান্ডা যুদ্ধ চলবে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে।


আমেরিকার বিশ্ব কর্তৃত্বের কিংবা আমেরিকা নির্ভরতার পালটা ২০০৯ সালে চীন পাঁচটি দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফিকাকে নিয়ে ‘ব্রিকস’ গঠন করে। ২০১৩ সালে এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের সংযোগকারী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভ’ নিয়ে চীন বৃহৎ কাজ শুরু করে। রাশিয়ার প্রচুর খনিজ সম্পদ এবং পেট্রোলিয়াম-গ্যাস, চীনের উন্নত শিল্প ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতায় অনেক দেশ উৎসাহিত; ইতালি, জার্মানি সহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ।
চীনের সঙ্গে বৃহৎ ব্যবসার শরিক, আমেরিকার উভয় দলই চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে একজোট। বৃহৎ কর্পোরেট ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা উভয় দলের প্রতিনিধিদের কার্যত নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯৫০-এর দশকে আমেরিকায় ম্যাকার্থী প্রচার চলে একতরফা, বিচার বলে কিছু ছিল না, মানবাধিকারও বিসর্জিত হয়। সো‍‌‍‌ভিয়েত বিপদ সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ততা কিংবা কাউকে সোভিয়েত বা কমিউনিস্ট অনুগামী সন্দেহ হলেই কঠোরতম শাস্তি, চাকরিচ্ছেদ, জেল, মৃত্যুদণ্ড ছিল তখন অবধারিত।
এখন রাশিয়া ও চীন আমেরিকার একমুখী প্রচারে প্রধান বিপদ, কোনও ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেই আমেরিকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ম্যাকার্থী আমলের গুন্ডামি জোরজবরদস্তি অবিরাম চলছে। যে কর্পোরেটরা চীনের ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞার সমালোচক ছিল, চাপের মধ্যে তাদেরও ভূমিকা পালটাতে হয়েছে। এমনকি বিশ্বের সেরা কনসালটেন্সি ম্যাককিনসে যখন বলে‍‌ যে, চীনের সঙ্গে ব্যবসায় আমেরিকাই বেশি লাভবান হবে, তখন এই সংস্থাকেও কোণঠাসা করা হয়।
১৯৭২ সালে নিক্সনের চীন সফরে উভয় দেশের মধ্যে প্রথম সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে আমেরিকা তার নীতি হিসাবে স্বীকার করে নেয়। চীনের অভাবনীয় সমৃদ্ধি এবং আমেরিকার আর্থিক সমস্যা, এক মেরুত্বের ভাঙন, বিশ্ব আধিপত্যের ওপর সমস্যার জন্য মার্কিন প্রশাসন চীনকে প্রধান শত্রু হিসাবে ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরের পর তাইওয়ানকে আমেরিকা অস্ত্রসজ্জিত করে চলেছে। যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষায় আমেরিকা বাড়িয়ে চলেছে বরাদ্দ, অথচ আমেরিকার নিরাপত্তার সামনে কোনও বিপদ নেই, কোনোদিন ছিলও না। আমেরিকার ১৪ কোটি শ্রমিককে সে দেশের সংজ্ঞায় গরিব বলা যায়, ২ লক্ষ শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, পরিকাঠামো ইত্যাদির বরাদ্দ ছাঁটাই করে যুদ্ধ বাজেট বাড়ানো হচ্ছে। কেন আমেরিকা দেশের ও জনগণের আর্থিক সমস্যা ও অসুবিধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে না! এসব প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে, যদিও যুদ্ধ-বিরোধী কোনও বড় আন্দোলনকে মাথা তুলতে দেওয়া হচ্ছে না। তাইওয়ান নিয়ে চীন-বিরোধী সামরিক তৎপরতা হলে চীন উপযুক্ত জবাব যে দেবে, তার প্রস্তুতিও দেখা যাচ্ছে অস্ত্র মোতায়েনে। রাশিয়ার মোকাবিলায় ন্যাটো ও আমেরিকা এবং চীনকে কোণঠাসা ও বিপন্ন করতে আমেরিকার হুমকি কতটা কার্যকর হবে! ২০২৩ সালে দুনিয়ায় আর্থিক অধোগতি ও মন্দার প্রাবল্যের আশঙ্কা আইএমএফ-ও উচ্চারণ করছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, আমেরিকারও দাবিদাওয়া নিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন-ধর্মঘট চলছে, দুনিয়ার কোনও শ্রমজীবীই যুদ্ধ চায় না, আর্থিক অবরোধ চায় না, চায় তাদের ক্রমবর্ধমান আর্থিক সমস্যার সমাধান— বেকারিত্ব, মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, মজুরি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দ বৃদ্ধি।
আন্তর্জা‍‌তিক পণ্য চলাচল অতিমারীতে বিপর্যস্ত। এই সময়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বে আর্থিক অবরোধ বা আর্থিক যুদ্ধ এই পণ্য ও অন্যান্য চলাচল আরও ভয়ঙ্কর অবস্থা তৈ‍‌রি করে। জ্বালানি ও খাদ্যের প্রচণ্ড দামবৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতিকে আরও তীব্রতায় বাড়িয়ে তো‍‌লে, যা গত অর্ধশতকে আমেরিকা ও বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ দেখেনি।


আমেরিকার একতরফা ও একচ্ছত্র হস্তক্ষেপে এশীয়া প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় বিভিন্ন মাত্রায় অনেক দেশকে আঞ্চলিক উত্তেজনা ও বিদ্বেষের মু‍খোমুখি হতে হচ্ছে। আমেরিকার চাপে দক্ষিণ কোরিয়ার শাসকগোষ্ঠী ঘনঘন বৃহদাকার যৌথ সামরিক মহড়া দিচ্ছে প্রতিবেশীদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়াতে। বাধ্য হয়ে গণতান্ত্রিক কোরিয়া পালটা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করছে। আমেরিকার পূর্ণ মদতে জাপান আগামী পাঁচ বছরে সামরিক খাতে ব্যয়বরাদ্দ যথেষ্ট পরিমাণে বাড়াবে, যা গত সাত দশকে হয়নি; নতুন প্রতিরক্ষা নীতিতে তথাকথিত পালটা আক্রমণের সামর্থ্য বহুগুণ বৃদ্ধি এবং আগাম আক্রমণের ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছে। ২০২৩ সাল উত্তেজনা ও অশান্তির মধ্যেই থাকবে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা। ২০২৩ ‘বিশ্ব ঝুঁকি রিপোর্টে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে জীবনমানের খরচ উচ্চহারে বৃদ্ধি এবং এখন থেকে আগামী দশ বছর জলবায়ু পরিবর্তন অনেক বিপর্যয় ডেকে আনবে। কিন্তু আমেরিকা এবং পশ্চিমীরা আর্থিক আরোগ্য লাভের সামান্যতম পথ দেখাতে যেমন ব্যর্থ, ঝুঁকি মোকাবিলায়ও অনাগ্রহী। বাড়বে আরও অসাম্য।
ভারতকে যে বৃহৎ কর্পোরেট এবং হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র চালাচ্ছে, আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত তাদের হাতে; আদানির সাম্রাজ্যের আস্ফালন ফাঁস হয়ে পড়ায় মোদী-আদানি, হিন্দুত্ব-কর্পোরেট চক্রের শাসনের আসল রূপও বেরিয়ে পড়েছে।


প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে ঘোষণা করেছিলেন, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হবে। ছ’বছরে বারবার প্রধানমন্ত্রী তা পুনরুচ্চারণ করেছেন, বিশেষত সব নির্বাচনে। ২০২২ সাল গত। কী জবাব প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের! বছরে ২ কোটি কর্মসংস্থান, সকলের শিক্ষা ও কালো টাকা উদ্ধার, দেশের প্রত্যেককে উদ্ধারকৃত কালো টাকা থেকে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া— অসংখ্য জুমলার মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করাও নতুন সংযোজন। মুষ্টিমেয় কর্পোরেটদের আয় স্ফীততর করা, শাসকদলের কাজে তাদের আর্থিক ক্ষমতার ব্যবহার প্রতি পদে। আর্থিক সঙ্কটে জেরবার সরকার, মুখে স্বীকার করছে না। কর্মসংস্থান, মূল্যবৃদ্ধি, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রসার, চিকিৎসা ও শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি, কৃষকদের দাবিপূরণ, শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষা সব ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার শিখরে সরকার। হিন্দুত্বের ও ধর্মীয় মেরুকরণের প্রচারের স্রোতে ২০২৪ নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালে এই ব্যর্থতা ভাসিয়ে দেবার চেষ্টা বাড়ছে। আমেরিকার কাছে বাঁধা বিজেপি। বিরোধীদের সামনে এই বিপদ প্রতিহত করা সম্ভব গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষতার শক্তির কার্যকরী ঐক্যসাধনের মাধ্যমে, সাধারণতন্ত্রের সামনে বিপদের মোকাবিলায় জনগণকে সচেতন করার ব্যাপক অভিযানের মাধ্যমে। স্বাধীন ভারতে ২০২৩- এই কারণে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। 
 

Comments :0

Login to leave a comment