অন্যকথা | মুক্তধারা
খুকুর ছড়ার ইতিহাস
গৌতম রায়
দেশভাগের ঘনঘটা তখন গোটা ভারতের আকাশকেই আচ্ছন্ন করে ফেলতে শুরু করেছিল। বাংলার আকাশ ও তখন বাংলাভাগের আসন্ন বিমর্ষতায় মুখ কালো করেছিল। এই সময়ে অবিভক্ত বাংলার, অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলায় কর্মরত রয়েছেন অন্নদাশঙ্কর রায়।
যুদ্ধের বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হলেও জিনিসপত্রের দাম তখনো আগুন। অন্নদাশঙ্করের একমাত্র বিলাসিতা ছিল জবাকুসুম তেল ব্যবহার ঘিরে ।বড় ভালবাসতেন মাথায় জবাকুসুম তেল মেখে স্নান করতে।
একদিন তাঁর আদালতে খুব জরুরি একটি মামলা রয়েছে ।সে মামলার বিচার ঘিরে মানসিকভাবে একটু চিন্তিত অন্নদাশঙ্কর ।এমন অবস্থায় হঠাৎ দেখেন , খেলার ছলে জবাকুসুম তেলের কাঁচের শিশিটা ভেঙে ফেলেছে ছোট মেয়ে ।
পিতৃত্বের অনুভূতিতে আর পকেটের চিন্তায় একদম প্রথমে এই ঘটনাটা দেখে একটু বিরক্ত হলেন তিনি। ঘরে আর মজুত নেই জবাকুসুমের শিশি। এখন স্নান করতে যাওয়ার আগে মাথায় কি তেল মাখবেন? সেটাও যেমন চিন্তার , আবার একই মাসে একটা অতিরিক্ত জবাকুসুম তেল কিনলে খরচার জায়গাটা কোথায় চলে যাবে , সেটাও তাঁর একটা চিন্তা।
কিন্তু হঠাৎ অন্নদাশঙ্করের মনে হলো ,একি ভাবছি আমি? আমার ছোট্ট মেয়েটা খেলার ছলে, না বুঝে জবাকুসুম তেলের কাঁচের শিশিটা ভেঙে ফেলেছে ।আর তার জন্য আমি মনে মনে তার উপরে বিরক্ত হচ্ছি?
আবার নতুন করে তেলে শিশি কিনতে গেলে টাকা পয়সা খরচ নিয়ে ভাবছি?
কিন্তু আমরা, বুড়োরা, আমরা কি করছি? দেশকে তো এভাবেই তেলের শিশির মত ভেঙে ফেলতে শুরু করেছি!
মাথায় উঠলো স্নান করা। মাথায় উঠলো জরুরি মামলায় জজিয়তি করতে অফিস যাওয়া ।
তখনই লেখার টেবিলে বসে পড়লেন অন্নদাশঙ্কর।
লিখে ফেললেন; তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো , তোমরা যেসব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো তার বেলা। শেষ লাইনে লিখলেন ; তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো ,তোমরা যেসব ধেরে খোকা বাংলা ভেঙে ভাগ করো, তার বেলা--
দেশভাগ, বাংলাভাগের জন্য একটা টেস্টামেন্ট হয়ে এই ছড়াটা ।বাংলার প্রায় প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল অন্নদাশঙ্করের এই ছড়া অনুমতি নিয়ে গানটির অনবদ্য সুর দিলেন সলিল চৌধুরী ।গাইলেন বাণী ঘোষাল। তৈরি হয়ে গেল এক অসামান্য ইতিহাস।
Comments :0