Bengal Agriculture

সার, বীজ, বিদ্যুতের দাম বাড়ে, রাজ্যে চাষের খরচ বাড়ে না

রাজ্য

—  সারের দাম বাড়ে। রাসায়নিকের দাম বাড়ে। দাম বাড়ে সেচের প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের। তবু রাজ্যের বেশিরভাগ জেলায় চাষের খরচ এক টাকাও বাড়ে না বলে মনে করে মমতা ব্যানার্জির সরকার।
প্রমাণ? সামনে বরো চাষের মরশুম। তার জন্য ফসল বীমার নির্দেশিকা জারি হয়েছে। সেই নির্দেশিকায় স্বভাবতই চাষের খরচ নির্দিষ্ট করেছে রাজ্যের কৃষি দপ্তর। আর সেই নির্দেশিকা বলছে, রাজ্যের ১১টি জেলায় বরো ধান চাষ করার খরচ গত বছরের তুলনায় একটি টাকাও বাড়েনি। তার মধ্যে হাওড়া, ঝাড়গ্রাম, মালদহ, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা—  এই পাঁচটি জেলায় গত বছর শুধু নয়, তার আগের বছর (২০২২-’২৩ আর্থিক বছর)-র মতোই এবারও বরো ধান চাষে খরচ হবে। যা কৃষকদের কথায় ‘অসম্ভব।’ 
ওই পাঁচটি জেলা ছাড়া রাজ্যের কৃষি দপ্তরের সেই নির্দেশিকা অনুসারে বীরভূম, দক্ষিণ দিনাজপুর, হুগলী, উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর এবং উত্তর দিনাপুর—  এই ৬টি জেলায় বরো চাষের খরচ গতবছরের থেকে বাড়বে না বলে রাজ্য সরকার মনে করছে। যেমন, পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে এক হেক্টর জমিতে বরো চাষের খরচ ধরা হয়েছিল ১,২৫,৯৭০টাকা। এবারও, অর্থাৎ ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরেও সেই টাকাই খরচ হবে বলে রাজ্য সরকার মনে করছে। পূর্ব মেদিনীপুরের পাশের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর। সেই জেলায় দু’বছর আগে বরো চাষের খরচ সরকার নির্দ্ধারণ করেছিল ১,১৮,৫৬০ টাকা। গতবছরও তাই ছিল। এবারও তাই আছে। হুগলীতে অনেক কৃষক বরো চাষ করেন। সেখানে এবার সেই চাষে কৃষকের হেক্টর পিছু ৭৯,০৪০টাকা খরচ হবে বলে রাজ্য সরকার মনে করছে। গতবছরও ওই জেলার ক্ষেত্রে বরো ধানের ‘স্কেল অব ফিনান্স’ তাই ধরেছিল রাজ্য সরকার। 
শুধু ধানেই নয়, আলুর ক্ষেত্রেও আশ্চর্যনক দাম ‘স্কেল অব ফিনান্স’ ঠিক করেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। সরকার মনে করেছে চলতি আর্থিক বছরে(২০২৪-২৫)-এ হুগলিতে এক হেক্টর জমিতে আলু চাষ করতে কৃষকের খরচ হবে ১,৭২,৯০০ টাকা। ২০২২-২৩-এ, অর্থাৎ দু’ বছর আগে কত ছিল? সরকারই ঠিক করেছিল সে বছর হুগলীতে হেক্টর পিছু আলু চাষ করতে খরচ হবে ১,৯০,১৯০ টাকা। অর্থাৎ হুগলীতে আলু চাষে কৃষকের খরচ দু’ বছর আগের থেকে হেক্টর পিছু ১৭হাজারের কিছু কম টাকা হ্রাস পেয়েছে। সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ি এলাকার এক কৃষক, তৃণমূল কর্মীর কথায়,‘‘কালোবাজারে বীজ কিনতে হয়। সারের দাম কখনও কমে না। জলের ব্যবস্থা করতে খরচ বেড়েছে। এই অবস্থায় সরকার কী করে মনে করতে পারে যে, কৃষকের আলু চাষের খরচ কমে গেছে?’’
পূর্ব বর্ধমান রাজ্যের আলু চাষের অন্যতম কেন্দ্র। সেখানে গতবছর হেক্টর পিছু আলু চাষের খরচ সরকার ঠিক করেছিল ১,৮৪,০১৫ টাকা। তার আগের বছরও তাই ছিল। এই বছরও রাজ্য সরকার ঠিক করেছে পূর্ব বর্ধমানে হেক্টর পিছু আলু চাষের খরচ একটি টাকাও বাড়েনি। দার্জিলিঙ, হাওড়া, জলপাইগুড়ি, ঝাড়গ্রাম, কালিম্পঙ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, কোচবিহারেও এক ছবি।  
কিসের ভিত্তিতে সরকার এই ‘স্কেল অব ফিনান্স’ ঠিক করে? রাজ্যের কৃষি দপ্তরের এক আধিকারিকের বক্তব্য,‘‘প্রতি বছর দু’বার স্কেল অব ফিনান্স ঠিক করা হয়। খরিফ এবং বোরো চাষের আগে। প্রতিটি জেলাতে একটি করে কমিটি আছে এই সংক্রান্ত। জেলাশাসক সেই কমিটির প্রধান। কমিটিতে কৃষি বিভাগের অফিসাররা থাকেন। প্রতিটি জেলার কমিটি চাষে হেক্টর পিছু কৃষকের কত টাকা খরচ হবে, তা নির্দ্ধারণ করে। জেলাগুলি তা প্রস্তাব আকারে রাজ্য সরকারের কাছে পাঠায়। রাজ্য সরকার তা চূড়ান্ত করে। তারপর তা নির্দেশিকা আকারে প্রকাশিত হয়।’’ প্রসঙ্গত, এক হেক্টর মানে প্রায় আড়াই একর জমি। রাজ্যে আড়াই একর জমি থাকা কৃষক বেশি নন। রাজ্যের বেশিরভাগ কৃষকই ছোট, গরিব কৃষক। তাঁদের জমি এক একর কিংবা তার কম। সম্প্রতি নাবার্ড একটি রিপোর্টে জানিয়েছে, বড় জোতের মালিক কৃষকের তুলনায় কম জমির অধিকারী কৃষকের ব্যয় বেড়েছে দেশে। পশ্চিমবঙ্গে ছোট কৃষক বেশি হওয়ায় সঙ্কটের মাত্রা বেশি। এমন অবস্থায় রাজ্য সরকারই মনে করছে কৃষকদের চাষের খরচ বাড়ছে না। যে জেলাগুলিতে সরকার খরচ বেড়েছে মনে করে স্কেল অব ফিনান্স গতবছরের তুলনায় বাড়িয়েছে, সেখানেও বৃদ্ধির পরিমাণ সামান্য। যেমন মুর্শিদাবাদ। সেখানে গতবছর বরো ধানের খরচ হেক্টর পিছু ধরা হয়েছিল ১,০২,৯৯৯ টাকা। এবার তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১,০৬,২১০টাকা। অর্থাৎ সরকার মনে করছে মুর্শিদাবাদে হেক্টর পিছু বরো চাষের খরচ বেড়েছে ৩২১১টাকা মাত্র। একর পিছু তা হয় ১২৯৯টাকা!
মুর্শিদাবাদের রানিনগরের সেখ জামালউদ্দিন বললেন,‘‘কোথা থেকে সরকার এসব হিসাব পায়? আমাদের সঙ্গে তো কখনও কেউ কথা বলেনি। কেউ জানতে চায়নি। গত একবছরে সার, বীজ, রাসায়ণিক, বিদ্যুৎ সবেরই দাম বেড়েছে। এখন আমাকে সরকারের থেকে জানতে হবে যে আমার একর প্রতি খরচ বেড়েছে ১৩০০টাকা?’’ 
তৃণমূল সরকারের এই সিদ্ধান্তে আনন্দিত দুটি পক্ষ। প্রথম দল সুদখোর মহাজনরা। কারণ রাজ্যের সরকার চাষের খরচ যত কম দেখাবে, তত ব্যাঙ্ক থেকে কৃষি ঋণের পরিমাণ কম হবে কৃষকদের। কিন্তু বাস্তবে চাষের খরচ কমে না। বেড়েই চলে। যেহেতু চাষের উপকরণ—  সার, বীজ, কীটনাশক, সেচের জলের মতো উপাদানগুলির দাম নরেন্দ্র মোদীর শাসনে বেড়েই চলছে। আবার রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে চাষের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে কৃষকের বেশি ঋণ পাওয়ার রাস্তাও বন্ধ হচ্ছে। ফলে কৃষক মহাজনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে বাধ্য। দ্বিতীয়ত, চাষের পরেই কৃষক মহাজনের ধার, সুদ মেটানোর তাগিদে চেষ্টা করবেন দ্রুত ফসল বিক্রি করতে। তখন হাজির হবে ফড়েরা। তারা সরকার নির্দ্ধারিত দামের চেয়ে কমে সেই ফসল কিনতে শুরু করবে।
কৃষক দু’দিক থেকেই মার খাবেন। 
এই কৃষিনীতি প্রয়োগ শুরু হয় নয়া আর্থিক নীতি দেশে প্রয়োগ শুরুর পরে। বিজেপি’র শাসনে এই নীতির প্রয়োগ প্রবলতর হয়েছে। রাজ্যে মমতা ব্যানার্জি নরেন্দ্র মোদীর সেই নীতি মেনেই তথাকথিত ‘মা মাটি মানুষের’ সরকার চালাচ্ছেন।
 

Comments :0

Login to leave a comment