Post Editorial

কৃত্রিম মেধা এবং মার্কসবাদ

উত্তর সম্পাদকীয়​

 

অশোক মুখোপাধ্যায়



এক আজব দুনিয়ার বাসিন্দা এখন আমরা। এ দুনিয়া এক ত্রিভুজ চালিত। এই ত্রিভুজের একটি বাহু ফিনান্স পুঁজি, একটি বাহু ধান্দার ধনতন্ত্র এবং তৃতীয় বাহুটি হলো প্রযুক্তির ভেলকি।

  বিশেষত যে প্রযুক্তির ভেলকি নিয়ে বলতে চাইছি, তার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৯৭ এর ১১ মে তে। সেদিন তৎকালীন বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভ, যাঁকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দাবাড়ুও বলা হয়ে থাকে হেরে গিয়েছিলেন আইবিএম নির্মিত কম্পিউটার 'ডিপ ব্লু'র কাছে। দিনটি স্বভাবতই ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে মানবিক বুদ্ধির উপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ( আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, বা সংক্ষেপে এ আই) বিজয়প্রাপ্তির দিন হিসেবে। যদিও ১৯৯৭ এর ঐ দিনটির সূত্রপাত ঘটেছিল ১৯৫২ তে, যখন অ্যালান টুরিং কমপিউটারের মাধ্যমে দাবা খেলার প্রোগ্রামিং লেখার চেষ্টা করেন। এরও আগে টুরিং ১৯৫০ এ একটি গবেষণা পত্রে(Computer Machinery and Intelligence) টুরিং টেস্টের এর ধারণা দিয়েছেন। এই পেপারে টুরিং বর্ণনা করলেন কীভাবে বুদ্ধিমান যন্ত্র তৈরি করা যায় এবং কীভাবেই বা পরীক্ষা করা যায় সেইসব যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তা।অবশ্য তৎসত্ত্বেও অনেকেই এ আই এর জন্মলগ্ন হিসেবে ১৯৫৬ কেই মেনে নিয়েছেন। কেননা ঐ বছরেই 'Dartmouth  Summer Research Project on Artificial Intelligence' আয়োজিত হয়। ঐ কর্মশালার যৌথ আয়োজক ছিলেন মারভিন মিনস্কি এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থি। এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শব্দবন্ধটির প্রথম ব্যবহারের কৃতিত্বের স্বীকৃতিও দেওয়া হয় ম্যাকার্থিকেই।
সে যাইহোক, এই এআই এর হাত ধরেই আজকের দিনের সুপরিচিত সব প্রতিশব্দের( terminology) - যেমন, ChatGPT, chatbot( তবে A I বিশেষজ্ঞরা বলেন," ChatGPT  is a type of Chatbot that uses openAI's generative models to create new responses based on data it's been fed with."),machine learning, generative A I, big data, deep fake - ইত্যাদি ইত্যাদির রমরমা।

উপরে যে প্রযুক্তির ভেলকির কথা বলেছি, সেও এই এ আই -এর প্রসঙ্গ মনে রেখেই। যেমন কিছুদিন আগেই শোরগোল ফেলে দিয়েছিল কয়েকটি ছবি। আর এই ছবিগুলো তৈরি করা হয়েছিল এআই এর সাহায্যে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে পোপ একটি ফোলা জ্যাকেট পরেছেন। অন্য একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে টেনে-হিঁচড়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। সবই বানানো ছবি। 
আমাদের দেশের কথায় যদি আসি তবে কয়েকদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়েও একটি একইরকমের বানানো ছবির ঘটনা ঘটেছে। যে প্রধানমন্ত্রী নিজেই ডিজিটাল প্রযুক্তির অত্যুৎসাহী, যিনি দেশকে ডিজিটাল দেখতে চান; সেই তিনিই ঐ টেকনোলজির সহোদর এআই এর অপব্যবহারের শিকার। দেখা গিয়েছে 'AI driven deepfake technology' -এর মাধ্যমে বানানো একটি ছবিতে প্রধানমন্ত্রী 'গরবা নাচে'  অংশগ্রহণ করেছেন। যদিও বাস্তবে  নরেন্দ্র মোদীজী  ঐরকম কোনো নাচে সত্যি সত্যি অংশগ্রহণ করেননি। গারবা নাচাটা স্বভাবতই কোনো অন্যায় যদিও নয়, তবুও এই ঘটনা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয় ডিপফেকের অপব্যবহার কতোটা ব্যাপক হতে পারে। 
তবে উপরোক্ত ছবিগুলি হয়তো সামাজিক ক্ষয়ক্ষতির নিরিখে অনেকটাই নিরীহ। কিন্তু জেনারেটিভ এআই এবং মেশিন লার্নিং  এর মাধ্যমে এমন সব ভুয়ো তথ্য তৈরি করা সম্ভব, যা নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহৃত হতে পারে। ডিপ ফেকিং ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে। ফেক নিউজকে আরো বিশ্বাসযোগ্য এবং অমোঘ করে তোলা হচ্ছে।আর এইসব কৃত্রিমভাবে নির্মিত প্রচার সম্পূর্ণ মিথ্যার উপর ভর করে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে সমূহ বিপদ ডেকে আনছে। 
অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, টেসলার সিইও  এবং ধনকুবের ইলন মাস্ক, অ্যাপল- এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ওজনিয়্যাক, বিজ্ঞানী মার্কাস, নোয়া হারারি প্রমুখেরা আবেদন জানিয়েছেন, " যতদিন না আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমান যন্ত্রের থেকে মনুষ্যজাতির সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে ঠিকঠাক জানতে পারছি এবং তার সমাধানের পথ খুঁজে না পাচ্ছি, ততদিন এ নিয়ে গবেষণায় লাগাম টানা হোক। অন্তত ছমাসের জন্য হলেও কাজ বন্ধ রাখা উচিত। "
দার্শনিক এবং কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট ডেনেট বলেছেন, যন্ত্রকে মানুষের সমকক্ষ করে তোলার প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা মনুষ্যত্বের 'এক মৌলিক বিপদ ডেকে আনতে চলেছি'।

উপরে যেসব বিপদের আশঙ্কা উল্লিখিত হয়েছে এআই-কে ঘিরে, সেগুলির  প্রকৃতি সামাজিক,নৈতিক, রাজনৈতিক এবং মানবিক সমস্যার কোটায় পড়ে। কিন্তু যে আর্থ-সামাজিক বিপদাশঙ্কার  কথা এখনও বলা হয়নি তাহলো জীবিকার বিপন্নতা।অন্যদের কথা বাদ দেওয়া গেল, একজন এআই বিশেষজ্ঞ, চ্যাট-জিপিটির নির্মাতা সংস্থা ওপেন এআই-এর সিইও স্যাম অল্টম্যানের বক্তব্য দেখা যাক: অল্টম্যান বলেছেন,"জবস আর ডেফিনিটলি গোয়িং টু গো অ্যাওয়ে। ফুল স্টপ। "
সুতরাং অতীতেও প্রযুক্তিগত বিপ্লব যেমনভাবে জীবিকার সমস্যা সৃষ্টি করেছিল, এআই  প্রযুক্তিও সেই একই সমস্যা ইতিমধ্যেই সৃষ্টি করে ফেলেছে এবং এর ফলশ্রুতিতে যে আর্থিক বৈষম্য তৈরি হতে চলেছে তা হবে বর্তমানের তুলনায় অনেক অনেকগুণ বেশি। 
এআই প্রযুক্তির ক্রমোন্নয়নের ফলে চাকরি হারাতে চলেছেন কলসেন্টারের কর্মীরা, সাংবাদিকরা, আইনি পরামর্শদাতাগণ, শিক্ষকগণ, রেডিওলোজিস্টরা- এবং এই তালিকা আরো দীর্ঘায়িত। অর্থাৎ, ধনতন্ত্র ইতিমধ্যেই পৃথিবীর বুকে যেসব ব্যাধি সৃষ্টি করেছে, সেইসব ব্যাধি তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছে এআই টেকনোলজি। 
তবে এরই পাশাপাশি অন্য একদল মানুষও আছেন, তাঁদের মধ্যেও জ্ঞানীগুণী মানুষজনেরও অভাব নেই, যাঁরা মনে করছেন, এআই প্রযুক্তি আনীত এই পরিস্থিতির সাথে মানুষের দৃষ্টভঙ্গিকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। তাঁদের মতে সেটাই নাকি অভিযোজন ( adaptation) । আর এটাই নাকি সভ্যতা। তাঁরা বলছেন, "আসলে মানুষের কাছ থেকে মানুষের উদ্ভাবন করা যন্ত্রের মধ্যে শ্রমের স্থানান্তরই সভ্যতার ইতিহাস। শিল্পবিপ্লব তো সেই কারণেই হয়। এবং সে এক প্রবহমান সভ্যতার ইতিবৃত্ত। " ( দেশ, ১৭/১০/২০২৩) 
শিল্পবিপ্লব কেন হয়, তা নিয়ে আমরা একটু পরেই আলোচনা করবো। তবে সভ্যতার ইতিহাসে সেই শিল্পবিপ্লবের প্রভাব কি হয়েছে, তার কিছুটা ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে। আরো কিছু কথা এখনও বাকি। 
যেমন, যে শিল্পবিপ্লবের কথা বলা হচ্ছে, তার মোটামুটি এই চারটি স্তর রয়েছে:
Industry 1:
Mechanization, steam power, weaving loom. Industry 2:
Mass production, assembly line, electrical energy.Industry 3:
Automation, computers and electronics.Industry 4: Cyber physical systems, Internet of Things, networks
অর্থাৎ, আমরা এখন শিল্প বিপ্লবের চতুর্থ স্তরে আছি। 
কিন্তু তাঁরা যেটা উল্লেখ করতে ভুলে যান যে, এর ঠিক আগের স্তরেই অটোমেশন বিশেষজ্ঞররাই ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে অটোমেশনের ফলে, অর্থাৎ উৎপাদনে কম্পিউটারের বর্ধিত ব্যবহারের ফলে : ১) যন্ত্রের কাছে মানুষের দাসত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, ২) বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে, এবং ৩) মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে। 
সেসব মোটামুটি ১৯৬০ এর দিকের ইতিহাস। তখনও আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল ( আজকেও দেওয়া হচ্ছে) যে স্থানান্তরিত শ্রম অবশ্যই উপযুক্ত ভাবেই প্রতিস্থাপিত হবে অন্যত্র। 
তবে কতোটা স্থানান্তরিত হয়েছিল, আর তা কতোটাই  বা কি পরিমাণে উপযুক্ত ছিল-সে ইতিহাস তো আমাদের অজানা নয়। 
দারিদ্র্য আর বৈষম্যের বর্তমান পরিসংখ্যানেই তা স্পষ্ট।


লেনিন বলেছিলেন, মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান, কেননা ইহা সত্য। কেন সত্য? কেননা মার্কসবাদ হল একটি বিজ্ঞান। কিরকম বিজ্ঞান? না, মার্কসবাদ হলো সমাজবিজ্ঞান। যে সমাজবিজ্ঞান গড়ে উঠেছিল মার্কস-এঙ্গেলসের সময় পর্যন্ত মানুষের দ্বারা উদ্ভাবিত শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানভাণ্ডারের ভিত্তিতে। লেনিন বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন জার্মান দর্শন, ইংরেজদের রাজনৈতিক- অর্থনীতি এবং ফরাসি সমাজবাদের কথা। 
কথাগুলো লেনিন বলেছিলেন ১৯১৩ তে। আজকের তুলনায় সেই সময়টা ছিল মার্কসবাদের স্বর্ণযুগ। আর কিছুদিন পরেই বিশ্ব- ইতিহাসের প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবে। আমরা এও জানি যে সেই বিপ্লবেরও সফল রূপকার ছিলেন লেনিনই। যখন প্রধানত মার্কসবাদ-বিরোধী মানুষজন বলতে শুরু করে দিয়েছিল মার্কসবাদ ভ্রান্ত, বলছিল যে মার্কস হলেন ব্যর্থ ভবিষ্যৎ-বক্তা, কেননা মার্কসভাবিত সেই বিপ্লব হলোনা, যে বিপ্লবের আরম্ভ হবার কথা ছিল উন্নততম ধনতান্ত্রিক দেশসমূহে। ঠিক সেই সময়ে লেনিন মার্কসবাদের সময়োপযোগী সৃজনশীল বিকাশ ঘটিয়ে বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিলেন তাঁর সৃষ্ট তত্ত্বের সত্যতা। প্রমাণ করেছিলেন যে, মার্কসবাদ হলো বিজ্ঞান, কেননা মার্কসবাদ বাস্তব প্রয়োগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিবর্তিত হয়, হয় উন্নত। 
 ৪

কিন্তু এও ইতিহাস যে লেনিন প্রতিষ্ঠিত সেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, এবং অবশেষে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র অবলুপ্ত হয় (অধ্যাপক শোভনলাল  দত্তগুপ্তের ভাষায়,'সোভিয়েত ব্যবস্থার মহাপতন') । 
আর তখন আবারও বিশ্বজোড়া সমাজবাদ-বিরোধী, মার্কসবাদ-বিরোধী লোকজন বলতে শুরু করলেন, এইতো মার্কসবাদের শক্তি! এই তো তার বিজ্ঞানের দুরবস্থা! কেননা এটাও তো ঠিক যে তখন কেবলমাত্র সোভিয়েত সমাজতন্ত্রই  নয়, সমগ্র পুর্ব ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রেরই পতন হয়েছিল। 
আর ঠিক তখনই সবার অলক্ষ্যে লেনিন কিন্তু হাসছিলেন। হাসছিলেন মার্কস এবং এঙ্গেলসও।

হাসছিলেন, কেননা বিজ্ঞানীরা জানেন সত্য আপেক্ষিকতার স্তর থেকে ক্রমশ পূর্ণতার স্তরে পৌঁছতে থাকে। দ্বিতীয়ত, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বর বাস্তব প্রমাণ অনেকসময়েই সময়সাপেক্ষ। অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, তবে এখানে আমরা একটাই উদাহরণ দেবো-হিগস্ বোসন ( So called God Particles) । হিগস্ বোসনের তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা থেকে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে (LHC) তার দেখা পাওয়ার মধ্যে ব্যবধান প্রায় সত্তর বছরের।

আর যেহেতু মার্কস-এঙ্গেলস এবং লেনিন, সকলেই বিজ্ঞানী, তাই তাঁরা জানেন যে বৈজ্ঞানিক সত্যের আপেক্ষিকতা এবং বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রস্তাবনা বা অনুমানের সাথে সেই তত্ত্বের বাস্তবায়নের মাধ্যমে তত্ত্বটির প্রমাণিত হবার মধ্যেকার সময়ান্তর( সময় ব্যবধান, বা time lag) - এই দুটিই বিশেষত সোভিয়েত সমাজতন্ত্র এবং সাধারণভাবে সমাজতন্ত্রের সাথে ভীষণভাবেই প্রাসঙ্গিক।
প্রসঙ্গত আমরা মাও সে তুঙকে স্মরণ করতে পারি।
ক) তিনি বলেছিলেন, " বাস্তব জগতে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া যেমন অনন্ত, কর্মপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে মানুষের জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়াও তেমনি অন্তহীন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কোনভাবেই (সমগ্র) সত্যকে যেমন নিঃশেষে বলেনি, তেমনই প্রতিনিয়ত কর্মপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে মানুষের সত্য জ্ঞানার্জনের পথ সে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। "(সত্যের আপেক্ষিকতা সংক্রান্ত) 
 খ) আরো বলেছিলেন, " সাধারণভাবে বলা যায় যে, প্রকৃতিকে পরিবর্তনের জন্য কর্মপ্রয়োগই হোক, অথবা সমাজকে পরিবর্তনের জন্য কর্মপ্রয়োগই হোক, মানুষের মূল ধারণা তত্ত্ব, পরিকল্পনা বা কর্মসূচি-সমূহ কখনো কোন পরিবর্তন ব্যতীত রূপায়িত করা যায় না। কারণ, বাস্তবের পরিবর্তন সাধনে যাঁরা ব্যাপৃত হন, সাধারণত তাঁদের নানাধরণের সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত করতে হয়;... "। মাও সে তুং এরপর যেসব সীমাবদ্ধতার কথা বলবেন সেগুলি হলো: ১) তৎকালীনকার  বৈজ্ঞানিক এবং  প্রযুক্তিবিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, ২) বহির্বাস্তব সম্পর্কে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, এবং মাও সে তুং সেখানে একথাও বলেন যে, এহেন পরিস্থিতিতে" ধারণা, তত্ত্ব পরিকল্পনা ও কর্মসূচিসমূহের সাধারণত আংশিক পরিবর্তন ক'রে নিতে হয় ,কোনো কোনো সময়ে সম্পূর্ণ পরিবর্তন  ক'রে নিতে হয় কারণ প্রয়োগের মধ্যে এমন সব অবস্থার উদ্ভব হয় যার ধারণা আগে একেবারেই করা যায়নি। " (তত্ত্বের অনুমান বা প্রস্তাবনার সাথে তত্ত্বের বাস্তবায়নের সময়ান্তর সংক্রান্ত। ) 
গ) তাছাড়া মার্কসবাদ এবিষয়েও সচেতন যে, "যা প্রত্যক্ষ করা যায় তা তৎক্ষণাৎ  আত্মস্থ (comprehend)  করা যায় না এবং যা আত্মস্থ করা গেল তা প্রত্যক্ষও হয়ে গেল। চরিত্র-চিহ্নের দিক নির্ণয় ক'রে দিতে পারে ইন্দ্রয়ানুভূতি, কিন্তু সমস্যাটির মর্মবিষয়ের( essence) সমাধান ক'রে দেবে তত্ত্ব। " (মাও সে তুং) (তত্ত্বের গুরুত্ব এবং তত্ত্বের প্রস্তাবনার সাথে তার বাস্তবায়নের সময়ান্তর সংক্রান্ত।)


এখন এই যে প্রযুক্তির অগ্রগতি বা শিল্পবিপ্লবের অপরিহার্যতা এবং অবশ্যম্ভাবীতার কথা বলা হয় এবং হচ্ছে তা নিয়ে মার্কসবাদের কোনো সমস্যা তো নেই। মার্কসবাদ স্বীকার করে শিল্পবিপ্লবের অপরিহার্যতা এবং অবশ্যম্ভাবীতা। 
কেননা মার্কসবাদ জানে মানুষের আছে অনন্ত সম্ভাবনা। মার্কসবাদ বলে, "... একটি মানুষের অন্তর্নিহিত সীমাহীন জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা, এবং বাহ্যিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে ও সীমিত প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অধিকারী বহুর মধ্যে ( in men) মাত্র তার বাস্তব অস্তিত্ব- এই দুইয়ের মধ্যের দ্বন্দ্বের সমাধান, অন্তত আমাদের পক্ষে কার্যকরীভাবে, ঘটছে অন্তহীন বংশপরম্পরায়, ঘটছে সীমাহীন প্রগতির মধ্যে। " (এঙ্গেলস, হের ড্যুরিঙের বিরুদ্ধে)

 সুতরাং এহেন  অসীম সম্ভাবনাময় মানুষ যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শন, সাহিত্য সহ জ্ঞানের সব ক্ষেত্রেই নব নব উদ্ভাবনের মধ্য দিয়েই নিজেকে প্রকাশিত করবে এবং নিজেকে খুঁজে পাবে, একথা তো মার্কসবাদের স্বীকৃত সত্য।আর এর মধ্যেই তো শিল্পবিপ্লবের উৎস।সুতরাং বিষ্ময়কর বিজ্ঞানের অগ্রগতি আর তারই সহযাত্রী হয়ে প্রযুক্তির আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ দেখে মার্কসবাদ এতটুকুও অবাক হয় না।

তাছাড়া মার্কসবাদ তো  জানে, " আধিপত্যের এক শতাব্দী পূর্ণ হতে না হতে, বুর্জোয়াশ্রেণী যে উৎপাদনশক্তির সৃষ্টি করেছে, তা অতীতের সকল যুগের সমষ্টিগত উৎপাদনশক্তির চেয়েও বিশাল ও অতিকায়।... সামাজিক শ্রমের ক্রোড়ে যে এতখানি উৎপাদনশক্তি সুপ্ত ছিল, আগেকার কোনও শতক তার কল্পনাটুকুও করতে পেরেছিল? "( মার্কস-এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট ইশতেহার) (অর্থাৎ, বুর্জোয়ারা নিজ স্বার্থেই প্রযুক্তির অবিরাম উন্নতি ঘটিয়ে চলে।)

মার্কস আরো বলেছেন, " উৎপাদনের উপকরণে অবিরাম বৈপ্লবিক বদল না এনে, এবং তাতে করে উৎপাদন-সম্পর্ক ও সেই সঙ্গে সমগ্র সমাজ-সম্পর্কে বৈপ্লবিক বদল না ঘটিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি বাঁচতে পারে না।...। 
নিজেদের প্রস্তুত মালের জন্য অবিরত বর্ধমান এক বাজারের তাগিদ বুর্জোয়াশ্রেণিকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়। সর্বত্র তাদের ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, যোগসূত্র স্থাপন করতে হয় সর্বত্র। "( মার্কস-এঙ্গেলস, ঐ) 
উপরে উদ্ধৃত দুটি অনুচ্ছেদে আজকের পৃথিবীর কি নিঁখুত চিত্র আঁকা রয়েছে তা দেখে বিস্মিত হতে হয়। কেবলমাত্র এইটুকু বদল আনতে হবে যে, বুর্জোয়ারা আজ শুধুমাত্র মালের জন্য নয়, তারা আজ পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ায় ফিনান্স পুঁজির ফাটকাবাজির( speculation) বাণিজ্যের জন্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদের লুটের জন্য।

সুতরাং শিল্পবিপ্লবের অপরিহার্যতা এবং অবশ্যম্ভাবীতা নিয়ে মার্কসবাদের কোনও মতান্তর নেই। 
তবে যাঁরা মনে করছেন এবং তাঁদের মনগড়া সেই চিন্তাকে এইরকমের তাত্ত্বিক আকার দিচ্ছেন যে, শিল্পবিপ্লব কেবলমাত্র অপরিহার্যই নয়, অপ্রতিরোধ্যও বটে, তাদের সাথে মার্কসবাদের অনতিক্রমণীয় দূরত্ব রয়েছে। মার্কসবাদ মনে করেনা যে প্রযুক্তির ব্যবহার অপ্রতিরোধ্য, আর সেইজন্যই যথেচ্ছ হতে বাধ্য।এবং এইখানেই মার্কসবাদের বিশেষত্ব। মার্কসবাদ প্রযুক্তির অবিরাম অগ্রগতিতে বিশ্বাসী, কিন্তু প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহারের বিপক্ষে। আজ এআই কে ঘিরে যেসব ভয়াবহ সঙ্কটের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞরা করছেন, তার প্রধানতম কারণ তো এআই- এর অনিয়ন্ত্রিত, লাগামছাড়া এবং যথেচ্ছ অপব্যবহার।

কিন্তু উপরে গ) চিহ্নিত উদ্ধৃতিতে যেমন বলা হয়েছে, তেমনই এইসব জ্ঞানীগুণী বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতগণ  আজকের দুনিয়াকে দেখে  শুনে  এআই এর  প্রয়োগজনিত  নানা ধরনের সঙ্কট আর সমস্যার ইঙ্গিত তো দিয়েছেন, সমস্যাসমূহের কোনও কোনও ক্ষেত্রের চরিত্র নির্ধারণও হয়তো করতে সক্ষম হয়েছেন ; কিন্তু তাঁদের বিশেষ জ্ঞানের সাহায্যে তাঁরা কিন্তু আসন্ন সঙ্কটের মর্মবস্তুকে নির্ণয় করতে পারেননি। সেটা পারে একমাত্র মার্কসবাদ। 
মার্কসবাদ জানে যে, আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে  মার্কসীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ জানে যে, উৎপাদিত শক্তির সাথে উৎপাদন সম্পর্কের ( সহজকথায়, মালিকানা সম্পর্কের) রয়েছে অবিরাম দ্বন্দ্ব। শ্রেণি বিভাজিত সমাজের এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের তত্ত্বটি মার্কসবাদের অন্যতম মূল্যবান সত্য। উৎপাদিকা শক্তির রয়েছে সামাজিক চরিত্র। অথচ উৎপাদন সম্পর্ক ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পন্ন।আর দ্বন্দ্বটা এখানেই। 
লেনিন বলেছিলেন, " বিকাশের কোনও এক স্তরে, সমাজের বস্তুগত উৎপাদিকা শক্তি, তৎকালীন উৎপাদন সম্পর্কের সাথে সংঘর্ষে আসে।... উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের গতি তখন উৎপাদন সম্পর্কের দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হয় (From forms of development of the productive forces  these relations turn into their fetters) । তখনই শুরু হয় একটি সমাজবিপ্লবের যুগ"। ( লেনিন, On Marxism)
এবং এটাও সোচ্চারে বলা আবশ্যক যে, " উৎপাদিকা শক্তি আর উৎপাদন-সম্পর্ক- এ দুয়ের ক্রমাগত পরিবর্তনই মানবসমাজের ইতিহাস- এইভাবে মানবসমাজকে দেখার ধরনটি একেবারেই অভিনব। " মার্কসবাদের অন্যতম অভিনবত্ব এটাই। 

তাই বলছিলাম, লেনিন হাসছিলেন। হাসছিলেন মার্কস এবং এঙ্গেলস।১৯৯১ এর সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর মার্কসবাদ-বিরোধীরা যখন সোল্লাসে মার্কসবাদ বিরোধিতায় নেমে পড়েছিলেন, যখন তাঁরা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে মার্কসবাদ বিজ্ঞান কোনোভাবেই নয়, সত্যও নয়; তখনই ঐ তিনজন হাসছিলেন। কেননা তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন যে, আবারও ঘটনাবলি বিকশিত হবে, আবারও প্রমাণিত হবে যে মার্কসবাদ বিজ্ঞান। আর সেইজন্যই তা সত্য। 
আজকের যে সঙ্কটের সামনে মানবজাতি এসে দাঁড়িয়েছে এ আই এর হাত ধরে- তা প্রমাণ করে মার্কসবাদের সত্যতা। বিশেষ করে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ঐ সত্যটি: উৎপাদিকা শক্তির সামাজিক চরিত্রের সাথে উৎপাদন সম্পর্কের ব্যক্তিগত চরিত্রের অনতিক্রমণীয় দ্বন্দ্বের সত্য। 
ধনতান্ত্রিক মুনাফার তাড়নায় ইতিমধ্যেই পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সব প্রজাতিরই অস্তিত্ব সঙ্কটগ্রস্ত।  আর্থিক বৈষম্য আকাশছোঁয়া (৯৯℅ বনাম ১℅)। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিকতম সঙ্কট, এআই টেকনোলজি আনীত সঙ্কট। এই সঙ্কটের অন্য কোনো সমাধান নেই। একমাত্র সমাধান উৎপাদন শক্তির সাথে উৎপাদন সম্পর্কের যে দ্বন্দ্ব- তার সমাধান। 
নতুবা এআই  এর অপব্যবহার, এআই কে কেন্দ্র করে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলা,সীমাহীন বৈষম্য সহ পুর্বে উল্লেখিত মানবজাতির নৈতিক, রাজনৈতিক সহ একাধিক মানবিক সমস্যার সমাধান অধরা থেকে যাবে।
এই তো সময়, যখন রোজা লুক্সেমবুর্গের সেই বিখ্যাত ঐতিহাসিক উক্তির মর্মোদ্ধার সম্ভব। তিনি বলেছিলেন, " হয় সমাজতন্ত্র, নতুবা বর্বরতা। "(শোভনলাল দত্তগুপ্তের প্রবন্ধ, শারদীয়া পরিচয়, ২০২৩) 
সে আপনি পছন্দ না হলে সমাজতন্ত্রের অন্য কোনও পছন্দসই নাম রাখুন। কিন্তু উৎপাদিকা শক্তির সামাজিক প্রকৃতির সত্য আপনাকে স্বীকার করতেই হবে। স্বীকার করতে হবে এমন এক সমাজব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি যেখানে সামাজিক চরিত্রসম্পন্ন উৎপাদিকা শক্তি তার বিরোধী উৎপাদন সম্পর্কের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়।
নতুবা আধুনিক সভ্যতা ক্রমবর্ধমান বর্বরতার গ্রাস থেকে মুক্তি পাবে না।

 

Comments :0

Login to leave a comment