বই — মুক্তধারা
ইলা ও গোদাবরী : একই নৌকার যাত্রী
সুবিনয় মিশ্র
৯ সেপ্টম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩
যে বইটি এখানে আলোচিত হচ্ছে তাতে ভারতের দুই প্রান্তের দু’জন নারী কমিউনিস্টের কথা আছে। যাঁদের উভয়েরই ছিল সম্ভ্রম ও বিস্ময় জাগানো সংগ্রামী জীবন। যদিও তাঁদের কাহিনি আলাদা আলাদা কিন্তু একই আদর্শের সূতোয় বাঁধা। সংগ্রামী জনস্রোতে ভাসতে ভাসতে তাঁরা উভয়েই মিশে গিয়েছিলেন জনসমুদ্রে। যাঁদের একজন মহারাষ্ট্রের গোদাবরী গোখেল। অপর জন বাংলার সংগ্রামী ইলা সেন।
গোদাবরী ছিলেন মহারাষ্ট্রের প্রথম মহিলা আইনের স্নাতক। পরে কমিউনিস্ট নেতা শামরাও পারুলেকরকে বিয়ে করে হলেন গোদাবরী পারুলেকর। যদিও সেটি একমাত্র পরিচয় নয়, তাঁর মূল পরিচয় নিহিত আছে ওয়ার্লি কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব থেকে বেগার উচ্ছেদ, বিবাহ-দাস উচ্ছেদ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারত বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেত্রী হয়ে ওঠার সংগ্রামী জীবনের মধ্যে। আন্দোলন ও লেখালেখির কাজ একসঙ্গে চালিয়ে পেয়েছিলেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার, জওহরলাল নেহরু পুরস্কার, সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার, লোকমান্য তিলক পুরস্কার এবং নারী অধিকার আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছিলেন সাবিত্রীবাঈ ফুলে পুরস্কার।
অন্যদিকে সরকারি আমলার মেয়ে ইলার নামের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে অপ্রতিরোধ্য লড়াইয়ের কথা যা আজ প্রায় মিথের পর্যায়ে পর্যবসিত। গোদাবরীর মতো তিনিও কমিউনিস্ট নেতা ও নাচোল কৃষক বিদ্রোহের সংগঠক রমেন মিত্রকে বিয়ে করে ইলা সেন থেকে ইলা মিত্র হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল যে তিনি শেষ পর্যন্ত অসামান্য কমিউনিস্ট নেত্রী হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার গৌরব অর্জন করেছিলেন। ইলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির আবেগ। কৃষক আন্দোলনে তিনি ছিলেন নেতৃত্বের ভুমিকায়। পরে পূর্ব পাকিস্তানের কারাগারে চরম অত্যাচারিত হয়েছিলেন, নাচোল থানায় তাঁর উপরে বর্বর অত্যাচার চলেছিল। চারবার কলকাতাতেও কারাবাসে কাটিয়েছিলেন, তবুও কোনও অবস্থাতেই লাল পতাকা ছাড়েননি। পরে সিপিআই-র প্রাদেশিক কমিটির সদস্য হয়েছিলেন।
অথচ একজন দৌড়বীর হবার সম্ভাবনা নিয়েই শুরু হয়েছিল তাঁর জীবন। একটা সময়ে জুনিয়ার অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়ন ছিলেন, এমনকি জাপান অলিম্পিকে ইন্ডিয়া দলে নির্বাচিত হয়েছিলেন, শেষপর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অলিম্পিক আর অনুষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু কমিউনিস্ট জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেননি।
তাপস দাসকে ধন্যবাদ, সহজ করে এবং সংক্ষেপে ইলা ও গোদাবরীর জীবনকথাকে তুলে ধরার জন্য। এতে এই দুই কিংবদন্তী কমিউনিস্ট নারীর সঙ্গে নবীন প্রজন্মের পরিচিত হবার সুযোগ হলো। প্রবীণরাও সুযোগ পেলেন তাঁদের স্মৃতিকে ঝালিয়ে নেবার। বইটি থেকে জানা যাবে পুরানো সমাজের আবর্জনা সরিয়ে নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে কিভাবে তাঁরা মানুষের জন্য, মানুষের মাঝে মিশে গিয়েছিলেন। গোদাবরীর মতো ইলাকেও আমরা লেখালেখির মধ্যে দেখতে পাই। তাঁর একটি অনুবাদ গ্রন্থ আছে ‘হিরোশিমার মেয়ে’। এর জন্য তিনি পেয়েছিলেন ‘সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার’। ভারত সরকার তাঁকে দিয়েছে তাম্রপত্র সম্মান। কিন্তু তার চেয়েও বড় যে ব্যাপারটা—দু’জনের দুই প্রান্ত থেকে একই নৌকায় ভিড়ে গিয়েছিলেন এবং সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে নিজেদের নিঃশেষ করে দেওয়ার গৌরব যা খুব কম মানুষের আছে তা ঐ দু’জনেই অর্জন করেছিলেন। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে পথ হাঁটছেন যাঁরা তাঁদের কাছে এই ধরনের জীবনকথার গুরুত্ব অসীম।
দুই মানবী এক জীবন
তাপস দাস। নবজাতক। কলকাতা: এ-৬৪, কলেজ স্ট্রিট মার্কেট। কলকাতা-৭০০০০৭। ২০০ টাকা।
মন্তব্যসমূহ :0