Paddy Procurement Bengal

৬৬% পড়ে আছে রাইসমিলে বাজারে বাড়ছে চালের দাম

রাজ্য

 কৃষকের উপস্থিতি একই রেখে চলতি মরশুমে লক্ষ্যমাত্রার সর্বোচ্চ ৬৯ শতাংশ ধান কিনেছে রাজ্য সরকার!
ধান কেনার বিপুল সাফল্য দাবি করেও রাইসমিলে সেই ধান পাঠিয়ে চাল হয়ে ফেরত আসছে না। রাইসমিলে পাঠানো ধানের অন্তত ৬৬ শতাংশ এখনও ফেরত আসেনি। রাইসমিলের পাঠানো ধানের চাল হয়ে খাদ্য দপ্তরে ফেরত আসার রাজ্যওয়াড়ি গড়ের থেকে নিচে আছে উত্তর দিনাজপুর জেলা। সেখানে ধান কেনার পর ৭৫ শতাংশ ধানই চাল হয়ে রাজ্য সরকারের কাছে ফেরত আসেনি। পুরুলিয়াতে এই হার ৬৭ শতাংশ ও মুর্শিদাবাদে ৬৮ শতাংশ ধান চাল করে রাইসমিল সরকারকে ফেরত দেয়নি।
রাজ্যের খাদ্য দপ্তর সিপিসি (সেন্ট্রালাইজড পারচেস সেন্টার) সহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা মারফত কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনে। সেই ধান কেনার পর খাদ্য দপ্তরের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে রাইসমিলে পাঠানো হয়ে থাকে। ১০০ কেজি ধান থেকে ৬৪ কেজি চাল তৈরি করে সরকারকে দেওয়ার কথা। এর বাইরেও রাজ্যের রাইসমিল নিজেদের ব্যবসার জন্য খোলা বাজার থেকে ধান কেনে। 
এখন কৃষকদের থেকে কেনা ধানের ৬৬ শতাংশই পড়ে আছে রাজ্যের রাইসমিলগুলিতে। আবার খোলা বাজার থেকে কেনা ধানও এখন রাইসমিলের হাতে আছে। ফলে গোটা রাজ্যের উৎপাদনের সিংহভাগই এখন রাইসমিলের হাতে। খোলা বাজারে এখন হু হু করে বাড়ছে চালের দাম। গত এক সপ্তাহের মধ্যে মিনিকিট চালের দাম কুইন্টালে ১ হাজার টাকা বেড়ে গেছে।
এই বাড়ার কারণ কী?
আসলে এই মুহূর্তে রাজ্যের ধান ও চালের গোটা নিয়ন্ত্রণটাই চলে গেছে রাইসমিল মালিকের হাতে। যার অবধারিত পরিণতিতেই বাড়ছে চালের দাম। সারা ভারত কৃষকসভার রাজ্য সম্পাদক অমল হালদারের কথায়,‘‘কৃষকের হাতে আর ধান নেই। কৃষক আগেই ধান আড়তদারের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে সরকারের ধান আর রাইসমিল মালিকদের নিজস্ব কেনা ধান সবটাই এখন মিল মালিকদের দখলে। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে বাজারকে। সরকার আর মিল মালিকদের বোঝাপড়া করেই বাজারে চালের দাম আকাশছোঁয়া।’’ কৃষকসভা মনে করছে, এই সময় কৃষকদের হাতে ধান থাকলে তাহলে খোলা বাজার একটা প্রতিযোগিতা থাকতো। কিন্তু তার আর কোনও সম্ভাবনা নেই। 
নভেম্বর থেকে জুন— আট মাস রাজ্যের খাদ্য দপ্তর কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে নামে। চলতি ধান সংগ্রহের মরশুমে ডিসেম্বর মাস থেকে ধান কেনার কাজ শুরু করেছিল রাজ্য সরকার। ইতিমধ্যেই প্রায় ৪৭ লক্ষ টন ধান কিনেছে রাজ্য সরকার। চলতি মরশুমে ৬৮ লক্ষ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা। ৬৯ শতাংশ ধান ইতিমধ্যেই কৃষকদের কাছ থেকে কেনার দাবি করছে রাজ্যের খাদ্য দপ্তর। তার মধ্যেও হুগলীর মতো ধান উৎপাদনের জেলাও সরকারি ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা কাছাকাছি নেই। খাদ্য দপ্তরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘ রাজ্যে যেখানে লক্ষ্যমাত্রার ৬৯ শতাংশ ধান কেনা হয়েছে, সেখানে হগলী, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো চাষের এলাকা রাজ্যের লক্ষ্যমাত্রার থেকে কম ধান কেনা হয়েছে।’’
কিন্তু ঘটনা হলো, গত মরশুমে (২০২৩-২৪) সালে রাজ্য সরকার ৬৮ লক্ষ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা রাখলেও শেষ পর্যন্ত ৫১ লক্ষ টন ধান কিনেছিল। লক্ষ্যমাত্রার ২৬ শতাংশ কম ধান কেনার জন্য ১৪ লক্ষ ২৮ হাজার ৭৮৪ জন কৃষক উপকৃত হয়েছিল। যার অর্থ সরকার ১৪ লক্ষ ২৮ হাজার কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনে। কিন্তু এবার রাজ্য সরকার শুরু থেকেই বিপুল সংখ্যায় কৃষকদের উপস্থিতিতে ধান কেনার পর উপকৃত কৃষকের সংখ্যা কত?
এখনও পর্যন্ত ৪৭ লক্ষ টন ধান কেনার পর রাজ্যের খাদ্য দপ্তর দাবি করেছে ১৪ লক্ষ ২৮ হাজার ২৮৬ জন কৃষক উপকৃত হয়েছে। যার অর্থ, গত বছরের থেকে ৪ লক্ষ টন ধান কম কেনার পরও মাত্র ৩৯৮জন কৃষকের থেকে পিছিয়ে আছে। সারা মরশুমজুড়ে গত বছর যে সংখ্যায় কৃষক সরকারকে ধান বিক্রি করছে, চলতি মরশুমে সর্বোচ্চ ধান কেনার পরও কীভাবে উপকৃত কৃষকের সংখ্যা প্রায় একই থেকে যায়। খাদ্য দপ্তরের এক শীর্ষ আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘ ধান কেনা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সিবিআই তদন্ত চলছে। ইডি’ও তদন্ত চালাচ্ছে। প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী সহ রেশন ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। ফলে বছর দুয়েক সহায়ক মূল্যে ধান কেনাবেচা নিয়ে সরকারের একটা নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু এবার আবার সেই পুরানো পথেই চলে যাচ্ছে। ভুয়ো কৃষক সাজিয়ে ধান কেনা শুরু হয়েছে।’’
কৃষকদের অভিজ্ঞতাও একই। এবার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের থেকে কুইন্টালে ১০০ থেকে ২০০ টাকা খোলা বাজারে ধানের কম দাম ছিল। কিন্তু সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে গিয়ে নানান হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছে কৃষকদের। বিশেষ করে ধানের আদ্রতাজনিত সমস্যা তৈরি করে বস্তায় (৬০ কেজি) ৫ থেকে ৬ কেজি ধান কমিয়ে বিক্রি করতে বাধ্য করানো হয়েছিল কৃষকদের। গত জানুয়ারি মাসে সরকারের ধান কেনা সেন্টারে এই নিয়ে কর্মচারীদের কৃষকদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল। ফলে কৃষকরা সরকারকে ধান বিক্রি না করে হয়রানি এড়াতে ১০০ টাকা কম দর দিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। সেই ধানই আবার রাইসমিল হয়ে সরকারের কাছে ভুয়ো কৃষক মারফত বিক্রি হয়ে ফিরে এসেছে রাইসমিলেই। 
ফলে রাজ্যের কৃষকদের উৎপাদিত ধানের পুরটাই নিয়ন্ত্রক এখন রাইসমিল।   
 

Comments :0

Login to leave a comment