Post Editorial Central Vista

ভবন তো হলো, সংসদ কোথায়?

উত্তর সম্পাদকীয়​

Post editorial Central Vista


দেবাশিস চক্রবর্তী 


নতুন সংসদ ভবন তৈরি হলো প্রধানমন্ত্রীর সাধের সেন্ট্রাল ভিস্তার প্রথম ধাপ হিসাবে। মোট প্রকল্প ২০ হাজার কোটি টাকার। সংসদ ভবনের জন্য প্রথমে অনুমিত ব্যয় জানানো হয়েছিল ৮৬২ কোটি টাকার। ওই টাকাতেই টেন্ডার পায় টাটা গোষ্ঠী। লোকসভায় ২০২১-এ এক প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৯৭১ কোটি টাকা। এ বছরের জানুয়ারিতেই তা আবার বেড়ে হয়েছে ১২৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আরও বেড়েছে কিনা, স্পষ্ট নয়। টেন্ডারের থেকে ৪০০ কোটি টাকা বেড়ে গেল তিন বছরেই। এর বাইরেও সাজসজ্জার খরচ রয়েছে। 


উদ্বোধন ঘিরে বিতর্ক অনেক দিক থেকে। 
প্রথম কথা, বিষ্ণু দামোদর সাভারকারের জন্মদিনকে বেছে নেওয়া হয়েছে উদ্বোধনের জন্য। সমাপতন নয়, সচেতন সিদ্ধান্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের ঘোষিত পুনর্লিখন। শীত এলে বসন্ত আসতে আর কত দেরি? সাভারকার এলে গডসে আসবে। হিন্দুত্ববাদের আধুনিক জনক সাভারকারকে সামনে রেখে রাষ্ট্রবাদের নতুন পাঠ দেওয়া হচ্ছে। যা স্কুলে পড়ানো হচ্ছে, বা পড়ানোর চেষ্টা চলছে, তাকে রাষ্ট্রীয় মান্যতা দেওয়া হচ্ছে। 
দ্বিতীয়ত, ‘সেঙ্গোল’ বলে এক স্বর্ণময় দণ্ডকে অকস্মাৎ আবিষ্কার করা হয়েছে। এটি তামিল চোল রাজাদের রাজদণ্ড। যে দণ্ডটির কথা বলা হচ্ছে সেখানে লেখা রয়েছে: প্রভুর আদেশপ্রাপ্ত রাজা ভুবনে শাসন করবেন, যেমন স্বর্গে প্রভু নিজেই করে থাকেন। সাধারণতন্ত্রে যে এই আদর্শ চলে না, তা জেনেবুঝেই এই দণ্ডটিকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসা হয়েছে। এমনকি কেন্দ্রের শাসক দল ও শাসকের পোষিত মিডিয়া একেই ‘ভারতের স্বাধীনতার প্রতীক’ বলে সম্মানিত করেছে। লর্ড মাউন্টব্যাটন নেহরুকে এই রাজদণ্ড দিয়েই শাসন হস্তান্তর করেছিলেন, বলা হচ্ছে এমনই। এখন সেই কাহিনি যে অসত্য তা ফাঁস হয়েছে। সঠিকভাবেই তা জাদুঘরে ছিল। এখন প্রভুত্বের দর্শন কায়েমের জন্য তো বটেই হিন্দুত্বের জন্যও এক নতুন প্রতীক সামনে আনা হয়েছে। এই রাজদণ্ড স্থাপন করা হবে সম্পূর্ণ হিন্দু শৈব রীতি মেনে। তার মধ্যে ‘পবিত্র জল’ ছেটানো থেকে মন্ত্রপাঠ সবই থাকবে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে থোড়াই কেয়ার। 


তৃতীয়ত, এবং এযাবৎ সবচেয়ে বেশি আলোচিত হলো রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ না জানানো। নরেন্দ্র মোদীর ঊর্ধ্বে কেউ নন, এমনকি তাঁর পাশেও কেউ নন। তিনি একার একত্বে গর্বিত। একনায়করা যেমন হয়ে থাকেন। তিনি ফুয়েরার। দ্রৌপদী মুর্মু ততক্ষণ আদিবাসী হিসাবে বিজ্ঞাপিত ছিলেন যতক্ষণ তাঁকে মোদীর কাজে লাগানো গিয়েছিল। রামনাথ কোবিন্দও ছিলেন তেমনই ‘দলিত’ যিনি মোদীর সমর্থন জোগাড়ে কিছুদূর পর্যন্ত সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু তাঁদের বেছেই নেওয়া হয়েছিল এমনভাবে যে কোথাও কোনও অবস্থাতেই তাঁরা মোদীর সঙ্গে সমান মঞ্চে দাঁড়াতে পারবেন না। 
ভবনের উদ্বোধন না হয় হলো, কিন্তু সংসদ কোথায়? আসল প্রশ্ন সেখানেই। বিরোধী ১৯ দল যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, ‘গণতন্ত্রের আত্মা শুষে নেওয়া হয়েছে’। শুধু উদ্বোধনের অনুষ্ঠানেই নয়, মোদী সরকারের আমলে সংসদকে প্রতিষ্ঠান হিসাবেই শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। 


সংসদ অধিবেশনের দিকে তাকানো যাক। মোদীর রাজত্বেই ষোড়শ লোকসভা (২০১৪-১৯) পাঁচ বছরে বসেছে ৩৩১ দিন। ১৯৫২ সালের পর থেকে পাঁচ বছর সম্পূর্ণ করা লোকসভায় এটিই সর্বনিম্ন। এই নজিরও ভাঙতে চলেছে সপ্তদশ লোকসভা (২০১৯-২৪)। আর এক বছরও বাকি নেই। গড়ে বছরে ৫৮ দিন করে অধিবেশন চলেছে, সুতরাং সপ্তদশ লোকসভাই স্বাধীন ভারতে সংক্ষিপ্ততম অধিবেশনের রেকর্ড করবে। এ শুধু ঘোষিত অধিবেশনের দিন। বাস্তবে কী হচ্ছে? এ বছরের বাজেট অধিবেশনে লোকসভার নির্ধারিত সময় ছিল ১৩৩ ঘণ্টা, চলেছে ৪৫.৯ ঘণ্টা। রাজ্যসভার নির্ধারিত সময় ছিল ১৩০ ঘণ্টা, চলেছে ৩২.৩ ঘণ্টা। শাসক দলই চলতে দেয়নি সভা। বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বে লন্ডনে তাঁর ভাষণের জন্য রাহুল গান্ধীকে ক্ষমা চাইতে হবে বলে সমবেত হুল্লোড় শুরু করে সরকারপক্ষ। তা চলতেই থাকে। এমনকি ক্ষমা না চাইলে তাঁকে লোকসভায় আসতেই দেওয়া হবে না বলে বিচিত্র এবং স্পষ্টতই অবৈধ দাবি তুলে একটানা অধিবেশন ভণ্ডুল করে দেওয়া হয়। সকলেই বুঝতে পারেন, আদানি গোষ্ঠীর সম্পর্কে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট নিয়ে যাতে আলোচনা না হয় তার জন্যই অধিবেশন বানচাল করা হচ্ছে। এ কি শুধু এবারের ঘটনা? তথ্য বলছে, গত বছরের বাদল অধিবেশনে লোকসভা নির্ধারিত সময়ের ৭৪ ঘণ্টা এবং রাজ্যসভা ৭০ ঘণ্টা চলতে দেওয়া হয়নি। কোনও না কোনও অজুহাতে। এর পিছনে ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনা কাজ করছে। 

 


সংসদে এখন বিল নিয়ে বিতর্ক হয় না। বিল পেশ ও পাশ হয় কোনও আলোচনা ছাড়াই। গত ৯ বছরে ৭৬ শতাংশ বিল পাশ হয়েছে কোনও সংসদীয় পর্যালোচনা ছাড়াই। অর্থাৎ সংসদেও যেমন বিতর্ক হয়নি তেমনই সংসদীয় কমিটিতেও খতিয়ে দেখার জন্য বিল পাঠানো হয়নি। কৃষি সংক্রান্ত তিনটি বিলও পাশ করানো হয়েছিল বিরোধীশূন্য সংসদে। উলটে, গড়ে বছরে ১১টি করে অর্ডিন্যান্স করা হয়েছে সংসদ এড়িয়ে যেতে। সর্বশেষ উদাহরণ দিল্লির প্রশাসন সংক্রান্ত অধ্যাদেশ। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল তিনটি ক্ষেত্র বাদে দিল্লির নির্বাচিত সরকারই দিল্লির প্রশাসনিক আধিকারিকদের নিয়ন্ত্রণ করবে। রাত না পোহাতেই কেন্দ্র অধ্যাদেশ জারি করে এই রায় উলটে দিল। আরেকটি কায়দা হলো যে কোনও বিলকে অর্থবিল বলে ঘোষণা করে পাশ করিয়ে নেওয়া। রাজ্যসভা অর্থ বিল আটকাতে পারে না, সেই কক্ষে গরিষ্ঠতা নিয়ে সংশয় আছে সরকারের। সেই কারণেই রাজ্যসভাকে এড়ানোর এই বিকৃত কৌশল। এ বছরের বাজেটেও রেল সহ বড় মন্ত্রকগুলির বাজেট কোনও বিতর্ক ছাড়াই ‘গিলোটিনে’ ফেলে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে। 

 


বিরোধীরা ঘন ঘন বহিষ্কৃত হন অধিবেশন থেকে। ২০১৪ থেকে ১৫৫ জন সাংসদ বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কৃত হয়েছেন। এগুলি সাময়িক বহিষ্কার। কিন্তু রাহুল গান্ধীকে সংসদ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করার জন্য গুজরাটের নিম্ন আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করিয়ে, সেখান  থেকে রায় ঘোষণার পরপরই ঝড়ের গতিতে লোকসভার অধ্যক্ষ তাঁর সাংসদ পদ খারিজ করে দিয়েছেন। অন্যতম প্রধান বিরোধী নেতার সাংসদ পদ কাড়তে যে ছুতোয় এই ঘটনা ঘটেছে, তা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সমালোচনার মুখে পড়েছেন মোদী। সেইসঙ্গে ভারতের সংসদ কীভাবে চলছে, প্রশ্ন উঠে গেছে তা নিয়েও। 
মন্ত্রীরা প্রশ্নের উত্তর দেন না। আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নিজে কোনও মৌখিক প্রশ্নের উত্তর দেননি। তিনি যেমন আজ পর্যন্ত কোনও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি তেমনই সংসদেও বিরোধীদের কোনও প্রশ্নের উত্তর দেননি। 


সংসদীয় কমিটি সংসদীয় কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সংসদীয় কমিটির পর্যালোচনার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানে শাসক দলের সদস্যরা এমন ভাবে চলছেন যাতে বিরোধীদের আপত্তি নথিভুক্ত না করা হয়। এমনকি এই খবরও রয়েছে যে সব মন্ত্রকের কাছে নির্দেশ রয়েছে সংসদীয় কমিটির খসড়া রিপোর্ট সরকারকে দেখাতে হবে। যদিও তা আইনে বৈধ নয়। বাদ যায় সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর কথা। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান আরও একটি কাণ্ড ঘটিয়েছেন। তিনি রাজ্যসভার অধীন সব সংসদীয় কমিটিতেই তাঁর সচিবালয়ের একজনকে যুক্ত করে দিয়েছেন। অতীতে এমন ঘটনা কেউ দেখেনি। 
এ এমন সংসদ যেখানে চার বছরে লোকসভায় কোনও উপাধ্যক্ষ নির্বাচিত হননি। যেহেতু রীতি হলো বিরোধীদের মধ্যে থেকে উপাধ্যক্ষ হয়ে থাকেন, ওই পদ ফাঁকা রেখেই চলছে সরকার। 
সংসদে প্রায় নিষেধাজ্ঞা সংবাদমাধ্যমের। ২০২০-র বাজেট অধিবেশনের সময়ে কোভিড সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কথা বলে সংবাদমাধ্যমের ওপরে নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছিল। তা আজও বহাল রাখা হয়েছে। বাছাই করা কয়েকজনকে প্রেস গ্যালারিতে ঢুকতে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে সংসদের প্রতিবেদন লিখছেন এমন সাংবাদিকরা এখন দরজা পেরোতে পারেন না। সেন্ট্রাল হলে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ। নতুন ভবন উদ্বোধনের আগে প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার তরফে লোকসভার অধ্যক্ষকে চিঠি দিয়ে তীব্র ক্ষোভ জানানো হয়েছে, বলা হয়েছে বারংবার অনুরোধ করেও সাংবাদিকদের জন্য অনুমতি পাওয়া যায়নি। সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারাকেই তা লঙ্ঘিত করছে। 

 


এ সবই করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। সংসদীয় ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আরএসএস যে রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করতে চায়, সেখানে সজীব সংসদের কোনও স্থান নেই। সব স্বৈরশাসকই নিজেকেই স্থাপিত করতে চায় কোনও না কোনও স্থাপত্যের রূপে। নতুন সংসদ ভবনও তেমনই।  
সংসদের শরীর আছে, প্রাণ নেই। 
----------- 
তথ্য সহায়তা: অরূপ সেন
 

Comments :0

Login to leave a comment