Education

কেন্দ্রের নীতিতে সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠদের খপ্পরেই সিংহভাগ সৈনিক স্কুল

জাতীয়

 এবার সঙ্ঘের খপ্পরে সৈনিক স্কুলগুলিও! কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া নীতির সুযোগে দেশের সৈনিক স্কুলগুলির পরিচালনভার পেয়েছে আরএসএস, বিজেপি কিংবা তাদের শাগরেদরা। জানা গিয়েছে, কেন্দ্রের পাবলিক-প্রাইভেট নীতি অনুসারে এখনও পর্যন্ত যে ৪০টি সৈনিক স্কুলের পরিচালনভার বদলের চুক্তি হয়েছে তার মধ্যে ৬২ শতাংশই গিয়েছে এদেরই হাতে। শিক্ষায় গৈরিকীকরণের পর গেরুয়া রং লাগলো সৈনিক স্কুলগুলিতেও। স্বভাবতই পঠনপাঠনেও এর প্রতিফলন ঘটবে। সৈনিক স্কুলের এমন সাম্প্রদায়িকীকরণের তীব্র নিন্দার পাশাপাশি অবিলম্বে ওই নীতি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো।
১৯৬১ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে দেশে সৈনিক স্কুল তৈরি হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে আঞ্চলিক, জাতপাত কিংবা শ্রেণিগত বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যেই এই স্কুল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আর এই স্কুলগুলির পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকেরই অধীন স্বশাসিত সৈনিক স্কুল সোসাইটি (এসএসএস)-র হাতে। এভাবেই এত বছর ধরে পরিচালিত হয়ে এসেছে সৈনিক স্কুলগুলি। ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা এই স্কুলগুলির পরিচালনায় বেসরকারি সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় বাজেটেও ওই নীতি উল্লেখ করা হয়। তখন থেকেই সৈনিক স্কুলের চরিত্র কার্যত বদলে ফেলা হলো কেন্দ্রের ফতোয়ায়। ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে সৈনিক স্কুলগুলিকেও ধর্মীয় মোড়কে ঢেকে ফেলা হলো।
তথ্য জানার অধিকার আইন (আরটিআই) এবং বিকল্প সাংবাদিকতার অন্যতম মঞ্চ ওয়েব পোর্টাল ‘দ্য রিপোর্টার্স কালেক্টিভ’র অনুসন্ধানেই ফাঁস হয়ে যায় সৈনিক স্কুলের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের নীতি বদলের আসল স্বরূপ। দেখা যায়, এখনও যে ৪০টি স্কুলের পরিচালনভার পরিবর্তন সংক্রান্ত চুক্তি বেসরকারি সংস্থা বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছে তার মধ্যে ১১টি সরাসরি বিজেপি’র নেতা, সহযোগী কিংবা বন্ধুদেরই। ৮টি সরাসরি আরএসএস অথবা সঙ্গের সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। আবার ৬টি স্কুলের পরিচালনভার পেয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, অতি দক্ষিণপন্থী কোনও গোষ্ঠী কিংবা অন্যান্য হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন। একটি স্কুলের দায়িত্ব পেয়েছে মোদী-ঘনিষ্ঠ ধনকুবের আদানি গোষ্ঠীর অধীন সংস্থা বা ফাউন্ডেশন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, খ্রিস্টান, মুসলিম সহ কোনও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মাধ্যমে পরিচালিত কোনও গোষ্ঠী বা সংগঠনের হাতে দেওয়া হয়নি সৈনিক স্কুলের দায়িত্ব।
সৈনিক স্কুলগুলির দায়িত্বভার বদলের এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে অধিকাংশই বিজেপি অথবা তার সহযোগীদের শাসিত রাজ্যগুলিতেই। রাজ্যগুলি হলো; গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, অরুণাচল প্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং অন্ধ্র প্রদেশ। আবার এই স্কুলগুলির দায়িত্বও পেয়েছে স্বাভাবিকভাবে ওই সঙ্ঘ অথবা বিজেপি ঘনিষ্ঠরা। যেমন, বিজেপি নেত্রী সাধ্বী ঋতম্ভরা পরিচালিত দু’টি স্কুল দায়িত্ব পেয়েছে উত্তর প্রদেশের বৃন্দাবন এবং হিমাচল প্রদেশের সালানের সৈনিক স্কুল পরিচালনার। অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত শহর তাওয়াঙে সৈনিক স্কুলের দায়িত্ব পেয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং প্রেমা খাণ্ডু। তিনি স্কুলের চেয়ারম্যান আর তাঁর ভাই তাওয়াঙের বিজেপি বিধায়ক সেরিং খাণ্ডু হলেন ম্যানেজিং ডিরেক্টর। গুজরাটের মেহসানায় দায়িত্ব পেয়েছে দুধসাগর ডেয়ারি গোষ্ঠী পরিচালিত স্কুল। যার চেয়ারম্যান হলেন মেহসানার বিজেপি’র প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক অশোক কুমার ভবসাঙভাই চৌধুরি। ওই রাজ্যেরই বনসকন্ঠের স্কুলটির দায়িত্ব যে ট্রাস্ট পেয়েছে তা চলে বনস ডেয়ারির তত্ত্বাবধানে। এর মাথা হলেন থারডের বিজেপি বিধায়ক তথা গুজরাট বিধানসভার অধ্যক্ষ শঙ্কর সিং। উত্তর প্রদেশের এটাওয়ায় স্কুলের দায়িত্ব পেয়েছে বিজেপি বিধায়ক সরিতা ভাদাউরিয়ার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। হরিয়ানার রোহতকের সৈনিক স্কুল চালাবে বর্তমানে রাজস্থানের বিজেপি বিধায়ক মহন্ত বালকনাথ যোগীর সংগঠন। মধ্য প্রদেশের কাটনির স্কুলের পরিচালনভার পেয়েছেন বিজেপি বিধায়ক সঞ্জয় পাঠকের স্ত্রী নিধি পাঠক। আদানি গোষ্ঠী পেয়েছে অন্ধ্র প্রদেশের নেল্লোরের সৈনিক স্কুল পরিচালনার। কেরালার এর্নাকুলামে স্কুতেমনই দায়িত্ব পেয়েছে হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন আদি শঙ্করা ট্রাস্ট।
সৈনিক স্কুল চলবে যেহেতু পাবলিক-প্রাইভেট মডেল অনুসারে ফলে যারা দায়িত্বভার নিচ্ছে তারা সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি অনুদানও পাবে। অথচ সরকার দায়ভার ঝেড়ে ফেলায় পড়ুয়াদের পঠনপঠনের খরচও বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। ‘দ্য রিপোর্টার্স কালেক্টিভ’র বক্তব্য, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পড়ুয়াদের পড়ার খরচ বার্ষিক ১৩, ৮০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২,৪৭,৯০০ টাকা পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াতে পারে। স্পষ্টতই, পড়ুয়াদের বেতন কাঠামোর ক্ষেত্রে বৈষম্যও বহু গুণ বেড়ে যাবে। তেমনই বাড়বে জাতপাত, উঁচু-নিচের ভেদাভেদও। একই সঙ্গে পঠনপাঠনেও ধর্মীয় বিভাজনের আধিক্য বাড়বে বলেই মনে করছে অভিজ্ঞ মহল।

 

Comments :0

Login to leave a comment