DYFI Brigade Rally

ইনসাফ চাই, স্ফুলিঙ্গের দাবানল হয়ে ওঠার লড়াই

রাজ্য

 অঝোরে দু’গাল দিয়ে ঝরে পড়ছে জল। সামনে তাক করা আছে মিডিয়ার ক্যামেরা। বাঁধ মানছে চোখের জল। মাথা মুড়িয়ে এক মহিলা সেদিন ক্যামেরার সামনে দু’হাত জড়ো করে বলে গেছেন, ‘‘আজ ১ হাজার দিন আমরা পথে বসে আছি। আমরা স্কুলে যেতে চাই।’’ 
এ কোন স্কুলছুট শিশুর স্কুলে যেতে চাওয়ার যন্ত্রণার গল্প নয়। স্কুলে শিক্ষকতার করার জন্য গোটা জীবনকে বাজি রেখে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে চাকরি না পাওয়ার যন্ত্রণাবিদ্ধ জীবনের কাহিনি। 
সেদিন রাসমণি পাত্রকে চিনেছে গোটা বাংলা। এর আগে রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে নিজেদের জানান দিয়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা। মুখে কালো কাপড় বেঁধে পথ হেঁটেছেন। কালীঘাটের বাড়ির সামনে গিয়ে নিজেদের কথা বলতে গিয়ে গ্রেপ্তার হতে হয়েছেন। কিন্তু কলকাতার রাজপথে এক মহিলার মাথা থেকে গোছা ভরা চুল কাটা হচ্ছে। উবু হয়ে বসে একরাশ ঘৃণা, হতাশায় দগ্ধ হতে থাকা এক মহিলার চোখ দিয়ে নামছে জলের স্রোত। সেদিন রাসমণিকে দেখে কেঁদেছে গোটা বাংলা। টিভির পর্দায় এ দৃশ্য দেখার পর চোখ রাখা শিউরে উঠেছে রাজ্যবাসী। সেই কোনও শৈশব থেকে মেয়েদের চুলের প্রতি যত্ন নেওয়া। ছোট্ট বয়স থেকে মাথায় বাঁধতে হয় ফিতে। কত রং তার। বয়সের প্রতিটি মাপে তৈরি হয় বিনুনির রকমফের। সেই রাজ্যের এক মহিলা তিনি মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর রাজ্যেই এক মহিলা চুল বিসর্জন দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
হাজার দিনের প্রতিবাদ সেরে রাসমণিদের অবস্থান এখন বহমান। ইনসাফ মেলেনি তাঁদের। তাই চুল কেটে প্রতিবাদী রাসমণি পাত্র এদিনও বলেন, ‘‘কী করে বোঝাবো হাজারটা দিন। চোখের সামনে দিয়ে ঋতুগুলোকে চলে যেতে দেখেছি। ছোটবেলা থেকে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি। আমরা যারা হাজার দিন বসে আছি, তারা সকলেই গ্রামের গরিব বাড়ির ছেলে মেয়ে। প্রতিটি মহূর্তে আমার ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা বিপর্যস্ত হচ্ছি। দিনের পর দিন, এইভাবে চলতে পারে না।’’
সত্যই চলার কথা নয়। হাজার দিনের ধরনায় ইনসাফের দাবিতে মাথা নেড়া মেয়েটার কান্না দেখে স্তব্ধ হওয়া উচিত ছিল বাংলার। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, প্রতিরোধের যে যে পন্থা আমরা দেখতে অভ্যস্ত তার সবই ব্যবহার চোখে দেখার প্রবল ইচ্ছার তো কোনও প্রতিফলন সেদিন থেকে দেখা যায়নি। এ কোন বাংলা? পরিস্থিতির মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততার কোনও উপাদান নেই। স্ফুলিঙ্গ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারছে কোথায়। কোনও একটা গাছ শুকনো হলে তো আর দাবানল হয়ে উঠবে না। গোটা জঙ্গলের গাছকে শুকিয়ে থাকতে হবে। একটা গাছ শুকিয়ে গেলে সে তো নিজেই পুড়ে খানিক সময়েই শেষ হয়ে যাবে। 
স্ফুলিঙ্গ আছে। কিন্তু দাবানল হয়ে ওঠছে না। টানা দু’বছর এরাজ্যের গ্রামের মানুষের কাজ নেই। বামপন্থীদের সাহায্যে রেগার যে আইন গ্রামের মানুষের বছরে ১০০ দিনের কাজ পাওয়ার অধিকারকে সংবিধান স্বীকৃতি দিয়েছিল, এরাজ্যে তা এখন দুর্নীতির জালে বন্দি। কাজ করেও ৩ হাজার কোটি টাকার বকেয়া। কাজ না পাওয়ার যন্ত্রণার স্ফুলিঙ্গ আছে। কিন্তু দাবানল হয়ে উঠছে না। চাকরি না পাওয়ার যন্ত্রণা আছে। আবার সরকারি চাকরি যাঁরা করেন তাঁদের ওপর সীমাহীন আর্থিক বৈষম্যের যন্ত্রণা আছে। আদালত যে অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, ন্যায়সঙ্গত আইনি মৌলিক অধিকার বলে। সেই মহার্ঘভাতার দাবিতে ইনসাফ চেয়ে গত ১০ মার্চ এরাজ্যের সরকারি ক্ষেত্র স্তব্ধ হয়েছিল ধর্মঘটে।  স্ফুলিঙ্গের সেই আগুন এখন জ্বলছে। 
এরাজ্যে ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে যেদিন ধর্মঘটকে নিষিদ্ধ করা হবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সেইদিনই উত্তরবঙ্গের চা বাগান তাদের মজুরির দাবিতে ধর্মঘট করে বাগানে, বাগানে। গত ১২ বছরে বাগিচা শ্রমিকরা সরকারের চোখে চোখ রেখে দাবি আদায়ে পালন করেছে ধর্মঘট। ন্যূনতম মজুরি, জমির অধিকারের দাবিতে ইনসাফের স্ফুলিঙ্গ এখন বইছে চা বাগান।
ইনসাফের স্ফুলিঙ্গকে দাবানল করার লড়াই তাই। 
পরিস্থিতির ভিন্নতা, প্রতিকূলতা জানে বলেও ওরা সেই ৩ নভেম্বর থেকে হাঁটতে শুরু করে। কোচবিহার থেকে হাঁটা। পথ হাঁটা আর মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে মনের মধ্যে উঁকি মেরে প্রশ্নগুলিকে জাগিয়ে তোলার কাজ করে গেছে। ঘরে বসে থাকার যে সময় এটা নয় ওরা জানে। তাই ওরা ইনসাফ চেয়েছে। ইনসাফের দাবি তুলে হেঁটেছে পথ। 
কারা পেল না ইনসাফ? এই প্রশ্ন তুলেছেন ডিওয়াইএফআই’এর রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখার্জি। উত্তর দিতে গিয়ে তিনিই জানিয়েছেন,‘‘ যাঁরা প্রতিদিন কলকাতার রাস্তায় বেকারের মেলা বানিয়ে বসে আছেন, ইনসাফ চাইছে তাঁরা। যাদের আমরা ভোট দিয়েছি। যাদের আমরা ট্যাক্স দিচ্ছি। তাদের আমরা লুট করার পাওয়ার অব অ্যা টর্নি দিয়ে দিইনি। যারা আমাদের যৌবনকে লুট করছে, আমাদের কর্মক্ষম থাকার বয়স লুট করছে ইনসাফ তাদের পেতেই হবে। 
ইনসাফের পথ দিয়েছে সেই প্রেরণা। না হলে মঙ্গলকোটের কৈচর গ্রাম থেকে এক সকালে পার হয়েছিল ইনসাফ যাত্রীরা। তারপর থেকে নাছোড়বান্দা এক মেয়ে। তাকে যেতেই হবে ব্রিগেডে। আবদারের কাছে এই প্রথমবার ব্রিগেডে রওনা দেবে পরিবার। সাদা কাপড় জোগাড় করে চারদিক সেলাই করে আনতে হয়েছে। রং দিয়ে মেয়ে তৈরি করেছে ডিওয়াইএফআই’র পতাকা। তা নিয়েই ব্রিগেড আসবে পরিবার।
ইনসাফের স্ফুলিঙ্গ একদিন দাবানল হবেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment