GAZA DEVASTATION

গাজা জ্বলছে, তাবু খাটিয়ে মর্গ

আন্তর্জাতিক


গাজা ও জেরুজালেম, ১০ অক্টোবর— গাজায় ইজরায়েলের নির্বিচার বোমা বর্ষণ ও ক্ষেপণাস্ত্র হানায় এযাবৎ ৮৩০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত ৪ হাজারের বেশি। গাজায় ‘নিরাপদ’ স্থান বলে কিছু আর নেই। চারদিক থেকে এমনিতেই ১৬ বছর ধরে অবরুদ্ধ গাজার মানুষ রাফা সীমান্ত দিয়ে মিশরে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবেন অনুমান করে সেই সীমান্তেও বোমা বর্ষণ করেছে ইজরায়েল। বোমা পড়েছে সাধারণ মানুষের আবাসনে, শরণার্থী শিবিরে, স্কুলে, হাসপাতালেও। বাসস্থান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন ১লক্ষ ৮০ হাজার মানুষ। ইজরায়েলের মাটিতে হামাসের আক্রমণের পরে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানিয়েই দিয়েছিলেন, গাজাকে মরুভূমিতে পরিণত করে দেওয়া হবে। তারপর থেকে যেভাবে ইজরায়েল বেপরোয়া বোমাবর্ষণ করছে তা থেকে স্পষ্ট সমগ্র গাজা ভূখণ্ডকেই তারা দখলে নিয়ে আসবে। এখন অবরোধের মধ্যে থাকা গাজাকে প্যালেস্তিনীয়-মুক্ত করার অভিযান শুরু হয়েছে। ‘এই বোমাবর্ষণ প্রারম্ভিক’, বলেছেন স্বয়ং ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। 
সোমবার রাত এবং মঙ্গলবারও ২০০ বার ইজরায়েলী যুদ্ধ বিমান গাজায় আক্রমণ চালিয়েছে। একের পর এক অসামরিক আবাসন এলাকা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গাজার এক বাসিন্দা শাদি আল-হাস্সি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমাদের এলাকায় বোমা পড়ায় রাত একটায় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আমি অন্য এলাকায় পালিয়ে যাই। সেখানেও বোমা পড়তে থাকে। গাজায় নিরাপদ এলাকা বলে কিছু নেই’। রাষ্ট্রসঙ্ঘের একটি স্কুলে আশ্রয় নেওয়া জামাল আল-জিনাতির বাড়ি উড়ে গেছে। তাঁর ভাষায়, ‘ আমরা ভেবেছিলাম ইজরায়েল ভয় দেখানোর জন্য আক্রমণ করবে কিন্তু সত্যি সত্যিই একেকটি এলাকাকে গুঁড়িয়ে দেবে, আগুনে পুড়িয়ে দেবে তা ভাবিনি। আমাদের বাড়িই ছিল সব। সেখানেই আমরা যা কিছু স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু এখন তা ধ্বংসস্তূপ মাত্র। পালিয়ে এসেছিলাম এই স্কুলে, এখানে একেক ঘরে কয়েকশো মানুষ বসে আছেন। শিশুদের কান্নায় ভরে যাচ্ছে।’ প্যালেস্তাইন সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে টেনে বের করেছেন আবদুল্লা মুসলেকে। মুসলে কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, ‘আমি খেলনা বিক্রি করি, মিসাইল বিক্রি করি না।’ রাতের বোমাবর্ষণের পরে বেঁচে থাকা মানুষ যখন সকালে আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়েছেন তখন চারপাশে বাড়ির ভগ্নস্তূপ, রাস্তায় বোমার ক্ষতচিহ্ন, পুড়ে যাওয়া গাড়ি ও গাছের সারি। ‘বস্তুত গাজার মানুষ এখন একটি বন্ধ বাক্সের মধ্যে, একটি জেলের মধ্যে রয়েছে’, বলছেন গাজা থেকে প্রতিবেদন পাঠানো সাংবাদিক। 
গাজার বৃহত্তম হাসপাতাল আল-শিফায় উপচে পড়েছে আহতদের ভিড়। মিনিটে মিনিটে মারা যাচ্ছেন চিকিৎসা পাওয়া অথবা না-পাওয়া মানুষ। এত মৃত্যু যে তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী মর্গ বানাতে হয়েছে। যারা মারা যাচ্ছে তাদের জন্য শেষকৃত্যেরও কোনও নিয়ম মানার এখন আর উপায় নেই। গাজায় চিকিৎসার তীব্র সঙ্কট। ওষুধ নেই, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক নেই, নার্স নেই, অ্যাম্বুলেন্স নেই— জানাচ্ছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলি দ্রুত গাজার জন্য মানবিক সাহায্যের করিডর খুলে দেবার আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু ইজরায়েল তাতে সাড়া দেয়নি। খাদ্য, বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ পুরোই বন্ধ করে দিয়েছে ইজরায়েল। 
ইজরায়েল এদিন গাজা বন্দরেও বোমাবর্ষণ করেছে। মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারও আগুনে জ্বলে যাবার ছবি দেখা গেছে। ইজরায়েল দাবি করেছে, গাজার রিমাল এলাকায় কয়েকশত লক্ষ্যবস্তুতে তারা আঘাত করেছে। ঠিক এই এলাকাতেই গাজার সরকারি দপ্তর ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদ সংস্থার অফিস, বিভিন্ন সহায়তা সংস্থার দপ্তর। 
ইজরায়েলে নিহতের সংখ্যা ৯০০ বলে জানানো হয়েছে। শনিবার হামাস যোদ্ধারা ইজরায়েলের বাহিনীকে হতচকিত করে তাদের মাটিতে ঢুকে যায়। মুখোমুখি সংঘর্ষে অসংখ্য ইজরায়েলী নাগরিকের প্রাণ গেছে। তাছাড়াও হামাস প্রায় ৪ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। ইজরায়েলের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়া ১৫০০ প্যালেস্তিনীয়কে তারা হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও হামাসের পক্ষ থেকে এ খবর সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। হামাস এখনও ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ছে। হামাসের আল-কসম ব্রিগেডের মুখপাত্র ইজরায়েলের আশকেলন শহরের নাগরিকদের মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে সরে যেতে বলেছিল। তারপরে সেই শহরে ক্ষেপণান্ত্র আছড়ে পড়েছে। 
এদিকে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্যালেস্তাইনের সমর্থনে মিছিল, বিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে। লন্ডনেও প্যালেস্তাইনের পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১টি ছাত্র সংগঠন পরিস্থিতির জন্য ইজরায়েলকে দায়ী করে বিবৃতি দিয়েছে। খোলা চিঠিতে তারা বলেছে, হামাসের আক্রমণ শূন্য থেকে উদয় হয়নি। ইজরায়েলের তরফে ধারাবাহিক আক্রমণ ও অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায় এই সংঘাত। এখন প্রত্যাঘাতের নামে প্যালেস্তিনীয়দের নির্মূল করার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর অবস্থান নেওয়া উচিত।

Comments :0

Login to leave a comment