বিজন বিশ্বাস: কৃষ্ণনগর
গতবার ভোটের আগে দেদার প্রচার করা হয়েছিল, এলাকার সবার চাকরির ব্যবস্থা হবে। ভোটের পর ভোট আসে, কোথায় কাজ? জবাব দিতে জেরবার দুই শাসক দলের প্রার্থী।
প্রায় আড়াই লক্ষেরও বেশি পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন নদীয়া জেলায়। কালিগঞ্জ, পলাশীপাড়া, তেহট্ট, করিমপুর চাপড়া ব্লক এলাকার প্রায় দেড় লক্ষ যুবক এরাজ্যে কাজ না পেয়ে বাইরে গিয়েছেন। এর মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যুবকের সংখ্যাই বেশি। এদের মধ্যে পলাশীর সুগার মিলের কাজ হারানো পরিবারের সদস্য থেকে মাটিয়ারির প্রতিষ্ঠিত পিতল শিল্পের শ্রমিক পরিবারের সদস্যরাও রয়েছেন। একদিকে কয়লা খাদানে কাজ করতে গিয়ে নিহত, দালালরাজের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হওয়া থেকে সম্প্রতি তেহট্ট থানার হরিপুর দক্ষিণপাড়া এলাকার বাসিন্দা সমীরণ বিশ্বাস ও সুকান্ত বিশ্বাসের সৌদি আরবে আটকে থাকার ঘটনায় পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের দুশ্চিন্তা যেমন বেড়েছে, তেমনই ক্ষোভ বেড়েছে দুই শাসক দলের বিরুদ্ধেই।
কৃষ্ণনগর পৌর এলাকাটুকু ছাড়া গোটা কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রটাই মূলত কৃষিপ্রধান এলাকা। এই কেন্দ্রের কালীগঞ্জ, পলাশীপাড়া, নাকাশিপাড়া, চাপড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। এই সীমান্তবর্তী এলাকা জুড়ে ব্যাপক অংশে ওপাড় বাংলার ছিন্নমূল মানুষের বাস।
কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে পঞ্চায়েত, বিধায়কদের কার্যকলাপে তৃণমূল আর বিজেপিকে আর আলাদাভাবে চেনার কোনও কারণ নেই, তা ইতিমধ্যেই সাধারণ মানুষের আলোচনাতেও উঠে আসছে ক্রমাগত। তৃণমূলী গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথাও প্রকাশ্যে শোনা যাচ্ছে। উন্নয়নের কাজ শিকেয় তুলে, তোলাবাজির যে রমরমা প্রতিষ্ঠা হয়েছে তৃণমূল শাসনে, বিগত ৫ বছরে মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। কৃষ্ণনগর-১ ব্লকের একাধিক পঞ্চায়েতের দখল নিয়েছে বিজেপি। কিন্তু দুর্নীতি, পঞ্চায়েতী ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেআইনিভাবে টেন্ডার পাইয়ে দেওয়া, সংস্কারের অভাবে গ্রামীণ রাস্তাঘাটের বেহাল দশা থেকে কর্মপন্থার মধ্যে কোনও ফারাক যে নেই তৃণমূল-বিজেপি’র, তা সময়ের সঙ্গেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
প্রচারের পারদ যত চড়ছে, গত ৫ বছরের সাংসদ এবং পুনরায় তৃণমূলের প্রার্থী মহুয়া মৈত্রের ভূমিকা নিয়ে জনমানুষে চলছে নানা চর্চা। প্রতিশ্রুতির যে বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছিল বিগত লোকসভা ভোটের আগে, এবার তার হিসাব দেওয়ার পালা। তেহট্ট, পলাশীপাড়া, কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়া, কৃষ্ণনগর উত্তর এবং কৃষ্ণনগর দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্র। প্রচারের কর্মসূচিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন প্রার্থী সহ বামকর্মীরা। মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে তাঁরা শুনছেন মানুষের দাবি-দাওয়ার কথা।
হাওয়ায় ভেসে যে ভোট বৈতরণী পার করা যাবে না, তা মর্মে মর্মে বুঝতে পারছে কেন্দ্রের শাসকদলও। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কৃষ্ণনগরের সভাতেও নদীয়ার উন্নয়ণের বিশেষ কোন বার্তা না শুনতে পেয়ে হতাশ হয়েছেন জনসভায় যাওয়া মানুষও। ধর্মের নামে বিভাজনের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেন তৃণমুল ঠিকা নিয়েছে বিজেপি’র কাছ থেকে। তৃণমূলের প্রত্যক্ষ মদতেই জেলার কালিগঞ্জ নাকাশীপাড়া তেহট্ট এলাকায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আরএসএস’র প্রভাব। জেলার যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, তাকে ধ্বংস করে মস্তিষ্কে বিষ ঢোকানোর জন্য গড়ে উঠেছে স্কুল, কোথাও সাংস্কৃতিক সংগঠন, কোথাও শিশু-কিশোরদের নামে প্রতিষ্ঠান ।
এই কেন্দ্রের মাটিয়ারী, নাকাশিপাড়া সহ বিস্তীর্ণ এলাকার প্রতিষ্ঠিত পিতল শিল্প কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির মৃৎশিল্পের মতোই ধুঁকছে। পাশাপাশি বেকারত্বের যন্ত্রণার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গ্রামগঞ্জে জুয়া, সাট্টা, লটারি থেকে হেরোইনের মতো মাদকের নেশার প্রকোপ। ওদিকে সীমান্তবর্তী কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত তেহট্টের নারায়ণপুর-১, নারায়ণপুর-২ বা করিমপুর-২ ব্লকের দীঘলকান্তি, নন্দনপুর আর এদিকে চাপড়ার হাটখোলা, মহখোলা, হৃদয়পুর, রানাবন্ধ ঘাট সহ একের পর এক গ্রাম সীমান্তবর্তী। এসব এলাকার গ্রামবাসীদের জীবনযন্ত্রণার সঙ্কট দূর করতে পাঁচ বছরে দেখা মেলেনি বিধায়ক বা সাংসদের। প্রচারে গিয়ে সমস্যাগুলি শুনছেন বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী এস এম সাদী। যতটুকু সম্ভব সেসব সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করছেন। একে একে লাল ঝান্ডার সংখ্যা বাড়ছে ক্রমশ, আসছেন আরও বহু মানুষ।
বিপুল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণে বিরাট পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে দেবগ্রামে। রেলগেট থেকে যাত্রা শুরু করে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক হয়ে কাটোয়া মোড় ঘুরে বাসস্ট্যান্ড হয়ে এই মিছিল চৌরাস্তায় পৌঁছে শেষ হয়েছে। মিছিলে ছাত্র-যুবদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও সাধারণ মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল নজর কাড়া। শ্রমিক নেতাকে প্রার্থী পেয়ে, বিগত সময়ে তথাকথিত হেভিওয়েট তৃণমূল সাংসদের দম্ভে দমবন্ধ করা পরিস্থিতির অবসান চাইছেন শ্রমজীবী মানুষজন। সারা বছর তাঁদের অধিকারের লড়াইয়ের অন্যতম কাছের নেতাকে প্রার্থী পেয়ে পরিবহণ শ্রমিক, ফেরিঘাট শ্রমিক, তাঁতশ্রমিক, বিড়িশ্রমিক সহ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা দাঁতে দাঁত চেপেই লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
Comments :0