Suiri

তৃণমূলের তাঁবু গুটিয়ে দেবেন মানুষ

রাজ্য

রণদীপ মিত্র: সিউড়ি

বিজেপি আর তৃণমূলের সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ আর লুটের রাজনীতিকে অনেক পিছনে ফেলে দিল সিউড়িতে বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের গণজমায়েত। অবাধ ও শান্তিতে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দাবিতে বৃহস্পতিবার সিউড়ির বেণীমাধব স্কুলের মাঠ ছাপানো বিশাল সমাবেশে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘বিজেপি’র সঙ্গে সেটিং করে চোর তৃণমূল পার পাবে না। বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস মিলে আখের রস নিংড়োনোর মতো লুটেরাদের কাছ থেকে মানুষের সম্পদ এবং অধিকার আদায় করে ছাড়বে।’ এই সভাতেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি বলেছেন, ‘সাগরদিঘি দেখিয়ে দিয়েছে, বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস মিলে রাজ্যকে সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং লুটেরামুক্ত করবে।’ 
সিউড়ির স্থানীয় মানুষজনই বলছেন, এক মাস আগের তৃণমূল এবং বিজেপি’র দুটি জনসভার থেকেই এদিন অনেক বেশি মানুষের ভিড় হয়েছে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের সমাবেশে। মোড়ের দুই পাশে দুই মাঠ— একদিকে বেণীমাধব স্কুলের মাঠ অপরদিকে সেচ কলোনির মাঠ। এক মাস আগে দু’দিনের ব্যবধানে এখানেই হয়েছিল দুই সভা। প্রথমটি ছিল অমিত শাহের। দ্বিতীয়টি ছিল তার পালটা তৃণমূলের সভা। দুই সভারই সাক্ষী ছিলেন এখানকার স্থানীয় এক দোকানদার। এদিন বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের সভা দেখার পরে তিনি জোরের সঙ্গে বললেন, ‘আগের দুই সভাকেই টপকে গিয়েছে এদিনের ভিড়।’ শুধু স্থানীয় মানুষের মতামতেই নয়, এদিনের জমায়েত যে তৃণমূল-বিজেপি’র জমায়েতের থেকে অনেক বড় সেই রিপোর্ট জেলা পুলিশের আইবি’তেও জমা পড়েছে। শেষপর্যন্ত কলকাতায় কী রিপোর্ট পাঠানো হবে তা নিয়ে আইবি কর্তারা চিন্তিত বলে জানা গেছে।   
মাসখানেক আগের থেকে এদিনের গরম ছিল ঢের বেশি। রোদের তাপে গা জ্বলে যাচ্ছিল রীতিমতো। তবুও মানু্ষের ভিড় ঠেকাতে পারেনি এই দাবদাহ। বিজেপি’র সভার মতো এদিন সমবেতদের মাথার ওপরে ছিল না লক্ষ লক্ষ টাকা খরচে লাগানো হ্যাঙ্গার। তৃণমূলের সভার মতো ব্যবস্থা করা যায়নি মাথার ওপরে চাঁদোয়ার। তবুও এদিন সিউড়ি বেণীমাধব স্কুলের মাঠে ফেটে পড়েছে মানুষের জেদ। 
বিশাল সমাবেশের উদ্দেশে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, আমাদের তো আর কয়লা পাচারের টাকা নেই যে মাথার ওপরে প্যান্ডেল করে চাঁদোয়া করে দিতে পারব। কিন্তু জেলার মানুষের জেদ আছে। মানুষ সেই লড়াকু জেদ দেখাচ্ছেন। লুটের ভরকেন্দ্র বীরভূমে। একটা গিয়েছে তিহার জেলে। কিন্তু রাজ্যের প্রত্যেক জেলায়, ব্লকে, অঞ্চলে অসংখ্য চোর কেষ্টা আছে যাদের মমতা ব্যানার্জি বীর বানিয়েছেন। এবার তাদের বীরত্ব বুঝে নেবে মানুষ।
মানুষের ক্ষোভ সামলাতে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর বিলাসবহুল নবজোয়ার যাত্রা সম্পর্কে সেলিম বলেছেন, আগে জমিদাররা নায়েবকে নিয়ে বেরোতেন সব খাজনা ঠিকঠাক আদায় হচ্ছে কি না দেখতে। সেই রকমই এখন এক যাত্রা বেরিয়েছে। অনুব্রত জেলে যাওয়ার পরেও মমতা ব্যানার্জি এখানে এসে বলেছিলেন সব সিস্টেম আগের মতোই চলবে। বালি খাদান, পাথর খাদান, কয়লা পাচার— সব লুটের ভাগ এঘাট ওঘাট ঘুরে কালীঘাটে পৌঁছেছে। সেই টাকা লুটের বন্দোবস্ত পোক্ত করতেই তো জেলায় জেলায় তাঁবু ফেলছেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো। তাঁবু এখন রয়েছে বীরভূমে। এদিনের মানুষের মেজাজই বলে দিচ্ছে তৃণমূলের তাঁবু এবার মানুষই গুটিয়ে দেবে।
সিউড়ির মানুষ দেখেছেন এখান দিয়ে অভিষেক ব্যানার্জির ‘নবজোয়ারের’ বাতানুকূল পঞ্চাশ গাড়ির কনভয় পেরিয়ে যেতে। এদিন দুপুরে যখন প্রচণ্ড গরম, লু বইছে, রোদ যেন পিন ফোটাচ্ছে শরীরে, তখন সেসব উপেক্ষা করেই পায়ে হেঁটে সিউড়ির বেণীমাধব মাঠে একের পর এক আছড়ে পড়েছে লাল ঝান্ডা- তেরঙ্গা ঝান্ডার মিছিল। সমাবেশে দাঁড়িয়ে অধীর চৌধুরি বলেছেন, চার বছর হয়ে গেল, ক্রমাগত এনআরসি’র ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে বিজেপি আর তৃণমূল। আসলে এটা মানুষকে ভাগাভাগি করতে জুজু দেখানো। আবার ভোট এলেই ফের এনআরসি’র আওয়াজ তুলবেন মোদী। আর হিজাব পরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়বেন এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বোঝাপড়া করে ওদের এই রাজনৈতিক ছলচাতুরি মানুষের কাছে ধরা পড়ে গেছে।  সাগরদিঘির মানুষ তার জবাব দিয়েছে। দেশে এবং রাজ্যে দারিদ্র বেড়ে চলেছে। মানুষের কাজ নেই, আয় কমছে। তাই মানুষ এককাট্টা হয়েছেন। এনআরসি’কে হাতিয়ার করে বিজেপি-তৃণমূল নির্বাচনে আর পার পাবে না। বাংলায় পরিবর্তন আসছেই, দিল্লিতেও মোদী জমানা শেষ হচ্ছেই। তার জন্য এরাজ্যে লুটেরা এবং সাম্প্রদায়িকতার দুই শক্তিকে তাড়াতে আমরা বামফ্রন্টকে সমর্থন করছি। এরমধ্যে কোনও চালাকি নেই।
সমাবেশে মহম্মদ সেলিম আরও বলেন, মানুষের কাছে পুরানো তৃণমূল আর চলছে না, তাই ওরা বলছে নব তৃণমূল। অন্যদিকে আদালত বলে দিয়েছে ভাইপোকে জেরা করতে বাধা নেই। আমরাও দাবি করছি কয়লা পাচার, বালি, পাচার, সোনা পাচারের টাকা – সব অপরাধের তদন্তে জেরা করতে হবে। যত অপরাধী আছে সবাইকে জেলে ঢোকাতে হবে। উকিলদের পরামর্শে জেলযাত্রা এড়াতে এয়ার কন্ডিশন তাঁবু নিয়ে যাত্রায় বেরিয়ে রেহাই পাওয়া যাবে না। বাংলার মানুষ শপথ নিয়েছেন আর সর্বনাশ হতে দেবেন না। আমরা বারবার বলছি এখনই পঞ্চায়েত ভোট করো, মানুষ মাথার ঝুঁটি ধরে তৃণমূলকে তাড়িয়ে দেবে। তৃণমূল আর বিজেপি বিপদ বুঝে এখন ভোট না করার জন্য আদালতে গিয়েছিল, আদালত খারিজ করে দিয়েছে। দিল্লি ও রাজ্যের লুট কায়েম রাখতে তৃণমূল-বিজেপি এখন মানুষে মানুষে ভাগাভাগির খেলা খেলছে। কিন্তু এরাজ্যে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস এই খেলা সফল হতে দেবে না। 
সিপিআই(এম)’র বীরভূম জেলা কমিটির সম্পাদক গৌতম ঘোষ সভাপতিত্ব করেন সভায়। সভায় এছাড়াও ভাষণ দেন সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য রামচন্দ্র ডোম। তিনি বলেছেন, ‘এদিন মানুষের জেদে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেশের ডাকাত বিজেপি, আর রাজ্যের চোর তৃণমূলকে তাড়াতে মানুষ এককাট্টা। মানুষের এই ঐক্যকে জোরদার করে সংগ্রামকে তীব্রতর করতে হবে।’ সভায় ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি বলেছেন, ‘তৃণমূলের শেষের যাত্রা শুরু হয়েছে, অপর দিকে মানুষের সংগ্রামকে সাথি করে শুরু হয়ে মানুষের জয় যাত্রা।’ দুই চোরকে তাড়ানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সভার আরেক বক্তা জেলা কংগ্রেসের সভাপতি মিলটন রশিদও। সভায় উপস্থিত ছিলেন সিপিআই নেতা স্বপন দাস, মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা চিত্ত মালাকার প্রমুখ নেতৃবৃন্দও। 
 

Comments :0

Login to leave a comment