Modi on Manipur

সুপ্রিম কোর্টের ঠেলায় মণিপুর নিয়ে শেষে মুখ খুললেন মোদী

জাতীয়

শেষে সুপ্রিম কোর্টের ঠেলায় মণিপুর নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাও ওই রাজ্যে জাতি সংঘর্ষ চলার ৭৭ দিনের মাথায় এবং সর্বোপরি দুই জনজাতি মহিলাকে নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটানোর ভিডিও সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার পর! এতদিনে তাঁর মনে পড়ল মণিপুরের হিংসার কথা এবং এর জন্য তিনি ‘অত্যন্ত ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ’ বলে বৃহস্পতিবার দাবি করলেন। তবে এই ‘বিবেক-জাগ্রত’ বাণী তিনি সংসদের অভ্যন্তরে নয়, শুনিয়েছেন বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কাছে। এমনকি এদিন সংসদ শুরুর মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী প্রথামাফিক কুশল বিনিময়ে সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে কাছে গেলে কংগ্রেস নেত্রী মণিপুর প্রসঙ্গই টেনে এনে তাঁকে আলোচনার দাবি জানান। তিনি মোদীকে বলেন, ‘‘আমি ভালো আছি। কিন্তু মণিপুরের মেয়েরা ভালো নেই।’’ আবার সংসদের বাদল অধিবেশন শুরুর দিন ভেস্তে গেল সেই মণিপুরকে ঘিরেই। ওই রাজ্যের হিংসা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে বিরোধীরা অনড় অবস্থান নেওয়ায় মুলতুবি হয়ে যায় সংসদের উভয় কক্ষ।
সুপ্রিম কোর্ট এদিন স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই মণিপুরে জনজাতি দুই মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় কড়া মন্তব্য করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সম্পর্কে। ওইরকম নৃশংস ভিডিও দেখে অ্যাটর্নি জেনারেল আর ভেঙ্কটারামানি এবং সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার উপস্থিতিতেই প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, ‘ওই ভিডিও দেখে আমরা বিরক্ত। এটা মোটেই মেনে নেওয়া যায় না। দুই সরকারকে সময় দেওয়া হচ্ছে। তারা যদি পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয় তাহলে সুপ্রিম কোর্ট ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।’ বস্তুত, সুপ্রিম কোর্টের এই কড়া অবস্থানের পর মণিপুর নিয়ে ‘নীরব’ মোদী মুখ খুলতে বাধ্য হলেন। বাদল অধিবেশন শুরুর আগে সংসদ চত্বরে সাংবাদিকদের কাছে স্বভাবসিদ্ধ ঢ‌ঙে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘আজ, গণতন্ত্রের এই মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে বলছি আমার হৃদয় সম্পূর্ণভাবে ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ। ওখানে যা ঘটেছে তা যে কোনও সভ্য সমাজকে লজ্জায় ফেলে দেবে। গোটা দেশকে অপমানিত করেছে। ১৪০ কোটি দেশবাসী এরজন্য লজ্জিত।’’ এরপরেই দাবি করেন, ‘‘আমি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছি যে, কোনও অপরাধীকেই রেয়াত করা হবে না। আইন প্রয়োগ করা হবে কড়াভাবেই।’’ তবে তিনি অত্যন্ত সুচতুরভাবে মণিপুরের হিংসার সঙ্গে কংগ্রেস শাসিত রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়ের বিক্ষিপ্ত কিছু হিংসার ঘটনাকে জুড়ে দেন। আড়াই মাস ধরে চলা জাতি সংঘর্ষের ঘটনার সঙ্গে ওই দু’রাজ্যের কয়েকটি হিংসার ঘটনাকে যে এক আসনে বাসনো যায় না তা মোদী বিলক্ষণ বুঝলেও বিষয়টিকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের ব্যর্থতা আড়ালেরও নির্লজ্জ প্রয়াস চালালেন তিনি। মণিপুরে হিংসায় ১০০ জনেরও বেশি মৃত্যু, হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া, মহিলাদের ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা ঘটে চলার পর প্রধানমন্ত্রী এখন এসে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন তাও আবার আরও দুটি রাজ্যকে জুড়ে দিয়ে। সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের কড়া হাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা উচিত বলে উপদেশ দিলেন মোদী। বললেন, মহিলাদের সুরক্ষার দিকটি বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত। আইন শৃঙ্খলা প্রয়োগ, মহিলাদের সম্মান জানানোর বিষয়টিকে যাবতীয় রাজনৈতিক বিতর্ককে দূরে সরিয়ে রেখে দলমত নির্বিশেষে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলেও ‘সুপরামর্শ’ দিতেও কসুর করলেন না।
মণিপুর যখন জ্বলছে, একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে, তখন বিরোধীরা সহ নানা মহল থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করা হলেও আর পাঁচটি বিষয়ে হাজার রকমের কথা বললেও তিনি ওই বিষয়ে মৌনতা অবলম্বন করেই ছিলেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী হিংসা কবলিত মণিপুরে গেলেন, ওখানকার আশ্রয় শিবিরে গিয়ে ঘরছাড়াদের সঙ্গে কথা বললেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী ওই রাজ্যে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। এই অবস্থায় গত ৪ মে ঘটে যাওয়া ন্যক্কারজনক ঘটনার ভিডিও এতদিনে প্রকাশ্যে আসার পর প্রধানমন্ত্রীর মণিপুর প্রসঙ্গ মনে পড়ল! 
ফলে এদিন সংসদের বাদল অধিবেশন যে মণিপুর নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে সেই আঁচ আগেই পাওয়া গিয়েছিল। এদিন অধিবেশন শুরু হতেই লোকসভা এবং রাজ্যসভায় বিরোধীরা ‘মণিপুর’, ‘মণিপুর’ বলে ধ্বনি তুলতে থাকেন। তাঁরা স্পষ্টতই মণিপুর নিয়ে সংসদের অভ্যন্তরে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি এবং বিস্তৃত আলোচনার দাবি করেন। সরকারপক্ষ মণিপুর নিয়ে আলোচনায় রাজি থাকলেও বিবৃতি প্রধানমন্ত্রী নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ দেবেন বলে জানানো হয়েছিল। বিরোধীরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন। এদিন সকালে বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জ্জুন খাড়গের দপ্তরে বসে বিরোধীরা বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি এবং মণিপুর নিয়ে আলোচনার দাবিতে সরব হবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। তারপরেই সংসদে তাঁরা সোচ্চারভাবে ওই দাবি জানাতে থাকলে সংসদের উভয় কক্ষের অধিবেশন বারংবার ব্যাহত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সারাদিনের জন্য মুলতুবি হয়ে যায়।
এর আগে সিপিআই(এম)’র সাংসদ এলামারাম করিম, ভি শিবদাসন, জন ব্রিটাস এবং এ এ রহিম ২৬৭ ধারায় যাবতীয় আলোচনা বাতিল করে মণিপুর নিয়ে আলোচনার দাবি জানিয়ে রাজ্যসভার সচিবের কাছে নোটিস দেন। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তাঁর বিবৃতি সহ আলোচনার দাবি জানিয়েছিলেন তাঁরা। এদিনই সেই আলোচনা করতে হবে বলে দাবি করেন তাঁরা। নোটিস দিয়েছিলেন আরজেডি সাংসদ মনোজ ঝা-ও।
ওদিকে, সংসদ অচল হয়ে পড়ায় স্বভাবসিদ্ধভাবে বিরোধীদেরই দুষলেন অনুরাগ ঠাকুর থেকে পীযূষ গোয়েলরা। তাঁদের দাবি, সরকার তো মণিপুর নিয়ে আলোচনায় রাজি ছিল। বিবৃতি দেওয়ার কথা ছিল অমিত শাহের। তা সত্ত্বেও সংসদে অন্য আলোচনা করতে না দিয়ে বিরোধীরা মণিপুর নিয়েই চিৎকার করে গেলেন। বস্তুত, সরকার যে সুচতুরভাবে মণিপুর নিয়ে আলোচনা অধিবেশনের একেবারে শেষের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে তা বুঝেই বিরোধীরা সরব হলেন প্রথম দিন থেকেই।

Comments :0

Login to leave a comment