হরিলাল নাথ
চলতি লোকসভা নির্বাচনে ২০১৯ সালের তুলনায় ভোট পড়ার হার বেশ খানিকটা কমে যাওয়ায় শাসক দলের অভ্যন্তরে যেমন গভীর উদ্বেগের ছায়া তেমনি বিরোধীপক্ষের মধ্যে উৎসাহের আবহ। ভোট বিশেষজ্ঞদের মতে সাধারণভাবে ভোট পড়ার হার কমলে শাসক দলের দুশ্চিন্তা বাড়ে। পাঁচ বছর অন্তর ভোট মানে দেশের মানুষ বিগত পাঁচ বছর সরকারের কাজকর্মের বিচার বিশ্লেষণ করে রায় দেন। সরকারের কাজ যদি উৎসাহব্যঞ্জক হয়, মানুষ সন্তুষ্ট থাকেন। তখন তারা উৎসাহিত হয়ে সেই সরকারকে রক্ষা করতে বা ফের ক্ষমতায় আনতে দ্বিগুণ উদ্যমে এগিয়ে আসেন ভোট কেন্দ্রে। কিন্তু সরকার সম্পর্কে মানুষের মনোভাব অন্যরকম হয় তাহলে সরকারকে ক্ষমতায় ফেরানোর দায় তারা অনুভব করেন না। নিরুৎসাহী মানুষের ভোট কেন্দ্রে যেতে অনীহা দেখা দেয়। এবারের নির্বাচনে মোদী সরকারের প্রতি অনীহার লক্ষণ স্পষ্ট।
ইতিমধ্যে পাঁচ দফা নির্বাচন হয়ে গেছে। প্রথম দফা থেকেই দেখা যাচ্ছে প্রদত্ত ভোটের হার প্রতি পর্বেই কমেছে। শাসক দলের তরফ থেকে বিষয়টিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা হলেও বিরোধী মহল কিন্তু রীতিমতো সোচ্চার। তেমনি এই প্রবণতার গুরুতর প্রভাব পড়েছে শেয়ার বাজারে। ভোটের হার কম পড়াটা শেয়ার বাজারে লগ্নিকারীদের কাছে প্রতিফলিত হচ্ছে মোদী সরকারের প্রতি ভোটারদের অনাস্থার দ্যোতক হিসেবে। লগ্নিকারীদের মধ্যে এই মনোভাবই প্রবল হয়ে উঠেছে যে মোদী সরকার কোনমতেই তাদের প্রত্যাশিত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না। এমনকি আদৌ ক্ষমতায় ফিরতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও তাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধছে। এই অবস্থায় পরবর্তী সরকার ঠিক কতটা লগ্নিবান্ধব হবে সেই নিয়ে দুশ্চিন্তাই তাদের লগ্নি নিয়ে প্রবল দ্বিধা দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছে। তাই তারা এখন আর কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। অন্তত ভোটের ফল প্রকাশের আগে পর্যন্ত হাত গুটিয়ে অপেক্ষা করতে চায়।
এরই মধ্যে আর একটি ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও একটু ঘোলাটে করে দিয়েছে। গত ৮ মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আচমকাই বলে বসেন তাঁরই অতি ঘনিষ্ট কর্পোরেট বন্ধু আদানি-আম্বানিদের কাছ থেকে নাকি রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস মোটা অঙ্কের কালো টাকা পেয়েছে। মোদীর প্রশ্ন রাহুলকে জানাতে হবে এই নির্বাচনে আদানি-আম্বানিদের কাছ থেকে কত টাকা পেয়েছে। কত বস্তা কালো টাকা টেম্পো বোঝাই করে পৌঁছেছে। মোদীর মুখে প্রকাশ্যে কখনো আদানি-আম্বানিদের নাম শোনা যায় না। হঠাৎ কি এমন ঘটলো যে, স্বয়ং মোদীই প্রকাশ্যে বলে দিলেন তাঁরই শিল্পপতি বন্ধুরা কংগ্রেসকে মোটা অঙ্কের কালো টাকা দিয়েছে। রাহুল গান্ধী সেদিনই অবশ্য বলেছেন, টেম্পো করে কালো টাকা পাঠিয়ে থাকলে ইডি-সিবি আই পাঠাচ্ছেন না কেনো? মোেদীর কোন উত্তর অবশ্য মেলেনি।
পরদিনই শেয়ার বাজারে ঘটে বড়সড় পতন। সূচকে পতন ঘটে এক ধাক্কায় দেড় শতাংশ। দেশের সবচেয়ে ধনকুবের দুই শিল্পপতির সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে বিস্ময় নয়, রীতিমতো উদ্বেগ ছড়ায় নানা মহলে। ভোট চলাকালীন আদানি-আদবানিকে কেন এভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন ভেবে কেউ কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। শেষে কিনা আদানিরা কালো টাকার বস্তা পাঠাচ্ছে কংগ্রেসের ঘরে। প্রধানমন্ত্রী সেটা জানা সত্ত্বেও ইডি-সিবিআই পাঠালেন না। দেশের সবচেয়ে ধনী দুই শিল্পপতির বিরুদ্ধে তাদেরই পরমপ্রিয় বন্ধু প্রধানমন্ত্রীর এমন গুরুতর অভিযোগে শেয়ার বাজারে জল্পনা তুঙ্গে। বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে জল্পনা যতটা উসকে দিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে শেয়ার বাজারে মোদী বন্ধু লগ্নীকারীদের মধ্যে। মোদী ভাষ্য থেকে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এই ধারণাই দানা বেঁধেছে যে দেশের শিল্পমহল কি তবে আর মোদীর ওপর ভরসা রাখতে পারছে না, তারা কি বিকল্প ভরসার জায়গা খুঁজছে? আদানি-আম্বানিদের মতো বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ট শিল্পপতিদের ওপরও কি মোদীর আস্থায় চিড় ধরেছে? দেশের গোটা শিল্পমহলই যদি অন্য পথে পা ফেলতে চায় তাতে আশ্চর্য কি।
বস্তুত এমন মনোভাবেরই প্রাথমিক প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে শেয়ার বাজারের সাম্প্রতিক অস্থিরতায়। পুঁজিবাদের খোলা হাওয়ায় সবচেয়ে সংবেদনশীল শেয়ার বাজারের ফাটকাবাজি। এখানে পুঁজিবাদী উচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ প্রকাশ যেমন ঘটে তেমনি বিপর্যয়কালে মরাকান্নাও প্রথম শুরু হয় এখান থেকে। অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ঠিক কোনদিকে মোড় নিতে যাচ্ছে তার আঁচ অনেকটাই মেলে শেয়ার বাজারের খেলোয়াড়দের মনোভাবে। জাহাজের তলায় ফাটল হলে ডুবন্ত জাহাজ থেকে সবার আগে যেমন ইঁদুররা পালায় তেমনি বিপর্যয়ের আগাম আঁচ পেয়ে শেয়ার বাজার থেকে লগ্নি তুলে পালাবার চেষ্টা করে বাঘা খেলোয়াড়রা। শেয়ারে দেশি-বিদেশি লগ্নিকারীরা পরিস্থিতির উপর বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও আচরণের উপর নজর রেখে আন্দাজ করছে মোদীর দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা ৪০০ আসনে জয় হচ্ছে না। এমনকি আদৌ সংখ্যাগরিষ্ঠতা মিলবে কিনা তাতে ঘোর সন্দেহ আছে।
প্রথম দফার ভোট গ্রহণ হয় ১৯ এপ্রিল। তার আগে থেকেই শেয়ার বাজারে অস্থিরতার লক্ষণ ফুটে ওঠে। শেয়ার বাজারের লগ্নিকারীদের মনোভাব যে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার ছাপ সেটা প্রতিফলিত হয় ভিআইএক্স (VIX) সূচকে। এটা এখন গত ২২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই সূচক সাধারণভাবে ১০ থেকে ২০-এর মধ্যে থাকে। এখন ২০-এর উপরে ঘোরাফেরা করছে। অর্থাৎ লগ্নিকারীরা বিস্তর দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। অস্থির বাজারে সবচেয়ে সতর্ক বিদেশি লগ্নিকারীরা (এফপিআই)। এই ভোট পর্বে মে মাসের প্রথম দুই সপ্তাহেই তারা ভারতের বাজার থেকে তাদের ২২ হাজার কোটি টাকার লগ্নি তুলে নিয়ে গেছে। তার জেরে শেয়ার সূচক সেন্সেক্স ও নিফটি প্রতিদিনই নামছে। সূচকের পতন মানে লগ্নিকারীদের সম্পদ মূল্য কমে যাওয়া। বিদেশি লগ্নি পালিয়ে যাচ্ছে দেখে দেশিয় লগ্নিও সতর্ক। লগ্নির আগে তারা দশবার ভাবছে। এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব যত বাড়বে ততই শেয়ার বাজারে কালোছায়া ঘনীভূত হবে।
বর্তমানকালে অনেকটাই সংহত বিশ্ব অর্থনীতিতে বিশ্ব বাণিজ্য, বিদেশি লগ্নি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য দেশের সঙ্গে পণ্য পরিষেবার আমদানি-রপ্তানি ছাড়া কোনও দেশের পক্ষেই টিকে থাকা বা শক্তিশালী হওয়া সম্ভব নয়। তাই কোনও দেশের ভবিষ্যৎ বিকাশ বিদেশি লগ্নি (তা সে প্রত্যক্ষ হোক বা শেয়ার বাজারে) বা পণ্য পরিষেবার আদান-প্রদান ছাড়া অসম্ভব। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির লেনদেনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি লগ্নিকারীরা দেশের অর্থনীতি, শেয়ার বাজারের হাল নিয়ে কি ভাবছে তার ওপর নির্ভর করে তাদের সক্রিয়তা।
সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গের এক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে ভারতে শেয়ার বাজারের হাল গত দশ বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়। বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থাগুলির মনোভাব অনেকটাই নেতিবাচক। তাদের অনুমান বহুল বিজ্ঞাপিত ৪০০ আসনের গরিষ্ঠতা নিয়ে মোদী সরকার ফিরবে না। শেষ পর্যন্ত টেনেটুনে মোদী সরকার গড়লেও সেই সরকার হবে দুর্বল। সিদ্ধান্ত গ্রহণের বা নীতি নির্ধারণের দৃঢ়তা সেই সরকারের থাকবে না।
ভোট চলাকালীন শেয়ার বাজারে অস্থিরতা, টালমাটাল অবস্থা বাড়তে থাকায় উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় সরকার, উদ্বিগ্ন শাসক দল। ভোটে বিজেপি বা এনডিএ ঠিক কত আসন পাবে, মোদীর নেতৃত্বে আদৌ সরকার গড়া সম্ভব হবে কিনা এমন জল্পনাই এখন শেয়ার বাজারের কেন্দ্রবিন্দুতে। ফলে দালালদের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও লগ্নিকারীরা লগ্নিতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। শেয়ার বাজারের মনোভাব যাতে দাবানলের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে না পড়ে তাই আসরে নেমে পড়েছেন শাসক দলের নেতামন্ত্রীরা। অমিত শাহ থেকে শুরু করে জয়শঙ্কর সকলেই নানাভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন লগ্নিকারীদের।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, গত দশ বছরে কোনোদিন যাকে শেয়ার বাজার নিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করতে শোনা যায়নি তিনি আগবাড়িয়ে লগ্নিকারীদের আশ্বাস ও ভরসা দিয়ে বলছেন আপনারা বাজারে যান, শেয়ার কিনুন। নিশ্চিত থাকুন ৪ জুন ভোটের ফল প্রকাশের পর বিপুল মুনাফা ঘরে তুলতে পারবেন। কিন্তু বিদেশি লগ্নিকারীরা শাহ’র আশ্বাসকে আমল দেয়নি। তারা যথারীতি তাদের লগ্নি তুলে নিয়ে চীন ও হঙকঙে পাড়ি দিয়েছে। কঠোর করোনা নিষেধাজ্ঞার জেরে ২০২২ সালে চীনে অর্থনীতি বড়সড় ধাক্কা খায়। তখন বিশ্বব্যাপী রব ওঠে চীনের উত্থানের যুগ শেষ। এবার ‘চীন প্লাস’ জমানা শুরু। অর্থাৎ এফডিআই, এফপিআই লগ্নি এবার চীন থেকে সরে ভারত সহ বিকাশমান দেশে ঢুকবে। দীর্ঘ খরা কাটিয়ে চীনের অর্থনীতি ফের ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে সম্প্রতি। তাতেই এফপিআই ভারতের বাজার ছেড়ে দ্রুত ছুট দিয়েছে চীন, হঙকঙে।
শেয়ার বাজার নিয়ে মন্তব্য করে অবাক করে দিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করও। পাঁচ দফায় ভোটে হার কমে যাওয়ার ফলে শেয়ার বাজারের অস্থিরতা সামাল দিতে তাঁর আশ্বাস যতই নির্বাচন এগোবে ততই শেয়ার বাজারের অস্থিরতা কমবে। কারণ বাজার টের পাবে ঠিক কি হতে চলেছে। আমি নিশ্চিত শেষ পর্যন্ত একটা বড়সড় সংখ্যা আমরা পেয়ে যাব।
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেন প্রাণবন্ত ও গভীর আর্থিক বাজারের পূর্বশর্ত হলো একটি স্থিতিশীল সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার এবং একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতার অধীনে সরকার। সেটা একমাত্র দিতে পারে বিজেপি তথা এনডিএ। আমরা নিশ্চিত মোদী তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু তা যে হবার নয় তা বুঝতে পারছে গোটা দেশ।
Comments :0