Bangla Bachao

প্রান্তজনের জীবনের ছবি বাংলা বাঁচাও যাত্রার আয়নায়

বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা বাংলা বাঁচাও যাত্রা

দিধীতি রায়

অন্ধকার ভেদ করে "বাংলা বাঁচাও যাত্রা" চলেছে মাটির রাস্তা ধরে। গোটা রাস্তা সহ আশপাশের জমি নাকি জলের তলাতেই থাকে বর্ষা ও তার পরের তিন চার মাস। নদীবাঁধে পৌঁছালো বাংলা বাঁচাও যাত্রা। নদী বাঁধ বলতে কেবলই বালির বস্তা। জোরে বৃষ্টি হলে কয়েক ঘণ্টায় ভেসে যাবে গোটা বাঁধ। তার ওপরে সারি সারি ঘর। ৭০০ পরিবার দরমার বেড়ার ঘরে দিন কাটাচ্ছে। কান্না ভেজা গলায় বাঁধের এক দিদি বলে উঠল আমরা একটা কাপড়ও নিয়ে আসতে পারিনি সাথে করে, এই শীতে কিভাবে বেঁচে আছি তা আমরাই জানি! সত্যিই তো, ঘর গুলোতে উঁকি মারলে দেখা যায় ছাগল মানুষ একসাথে শুয়ে আছে। ঘরে দরজা বলতে কিছু নেই! জল আনতে ঘরের বাইরে গেলে গোরু ঢুকে সব খাবার ফেলে দেয়। না খেয়ে সেদিন বেলা কাটে। অথচ এদের "খবর" আসে না প্রাইম টাইমে। 
গত ১০ বছরে ৪০টি গ্রামের ঠিকানা মুছে গেছে মালদা মুর্শিদাবাদের মানচিত্র থেকে। ক্রমশ এগচ্ছে ফুলহার নদী আর গঙ্গা একে অপরের দিকে। এই দুটো নদী মিশে গেলে পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার ভৌগোলিক চিত্রটা ভয়াবহভাবে বদল হয়ে যাবে। রতুয়া, মানিকচক, ফারাক্কা, সামশেরগঞ্জ, জলঙ্গি একের পর ব্লকে মানুষ রাতারাতি হয়ে যাচ্ছে আশ্রয়হীন। কেবল বাড়ি নয় গত কয়েক বছরে  তলিয়ে গেছে স্কুল, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, পোস্ট অফিস। ঠান্ডায় মানুষগুলো কিভাবে বেঁচে আছে,কী খেয়ে বেঁচে আছে সরকার খোঁজ রাখেনি। নমামি গঙ্গার প্রকল্পের বিজ্ঞাপনে চারদিক ছেয়ে গেলেও ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে এই ভাঙনকে রুখতে কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ করছে না কেন্দ্রের সরকার। আর রাজ্যের সরকার এই সর্বস্বান্ত মানুষগুলোর ত্রাণের বরাদ্দ থেকেও চুরি করছে। দূরে রাজমহল পাহাড় আর এখানেই গঙ্গা ৪.৫ কিলোমিটার চওড়া হয়ে বইছে। মাটি গিলতে গিলতে বইছে। বেড়ার ঘরের ভিতর ও বাইরে হাওয়ার কোনও তফাত নেই!  দুই সরকার না দিচ্ছে পুনর্বাসনের জমি, না বানাচ্ছে পোক্ত বাঁধ। সরকারের ভাবনা থেকে এই মানুষগুলো ব্রাত্য। প্রান্তজনের কথা, ভূতনীর চরের কথা, রতুয়ার দিয়ারার চরের কথা তৃণমূল বিজেপি না শুনলেও লাল ঝান্ডা তাঁদের পাশে আছে। বিকল্প স্কুল চলছে, ৭০-৮০ টা ছোট ছোট শিশু লেখাপড়া করার জেদ আঁকড়ে আছে। আর পরিবারগুলো সাহস নিয়ে বেঁচে আছে নতুন করে ঘর বাঁধার। বাংলা বাঁচাও যাত্রা আসলে এই মানুষগুলোর মাথা গোঁজার স্থায়ী আস্তানার জন্য এগচ্ছে। আবাসের ঘরের টাকায় কিভাবে স্থানীয় তৃণমূল নেতার বাড়ি আরও বড় হচ্ছে তার হিসাব চাইতে চাইতে এগচ্ছে।
(২)
একের পর এক গ্রামে কোনও কমবয়সি ছেলে নেই। পুরুষশূন্য বললে কম বলা হয় না। মুর্শিদাবাদ মালদার ব্লকের পর ব্লক তরুণ প্রজন্মরা চলে গেছে দিল্লি, হরিয়ানা কিংবা দক্ষিণ ভারতে। বাংলায় দৈনিক আয়ের চেয়ে ওখানে দৈনিক আয় অনেক বেশি। অথচ এখন বাংলায় কথা বললে, বা তার নাম শুনে তাকে বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দিচ্ছে বাইরের রাজ্যে। ওডিশায় কাজ করতে গেছিল সাফিক। বিজেপি’র সরকার আসার পর একদিন চায়ের দোকানে ভিড় করে একদল নাকি ওর আধার কার্ড চেক করতে চায়! ও দেখালে ওকে বাংলাদেশি বলে পুলিশে ধরিয়ে দিতে চায়। ভয়ে গ্রামে ফেরত আসে। আয় বন্ধ। সরকার ঘোষণা করে দিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের ৫০০০ টাকার ভাতার কথা! অথচ একজন পরিযায়ী শ্রমিকও এক পয়সা পায়নি। রাজ্য সরকার তো জানেই না ক’জন পরিযায়ী শ্রমিক বাংলা থেকে যাচ্ছে অন্য রাজ্যে। ভোটের আগে প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে গেলেও এই মানুষগুলোর না আছে ভিন রাজ্যে নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার, না আছে চিকিৎসা করানোর সুযোগ, না আছে কাজের নিরাপত্তা। "বাংলা বাঁচাও যাত্রা" দাওয়ায় বসে একের পর এক পরিবারের, পরিযায়ী শ্রমিকদের আশঙ্কা উদ্বেগ শুনছে। কেউ ভাবে না যাদের কথা, যারা সরকারের কাছে কেবল ভোটার, কেবল পার্সেন্টেজ তাদের জীবনযন্ত্রণাকে ভাগ করে নেওয়ার জন্য এই "বাংলা বাঁচাও যাত্রা" এগনোর পথে খুলে ফেলেছে পরিযায়ী শ্রমিক সহায়তা কেন্দ্র। লাল ঝান্ডার দাবি তিনটে কার্ড প্রতিটি পরিযায়ী শ্রমিককে দিতে হবে। একটা কার্ড সে শ্রমিক হিসাবে কাজে যাচ্ছে অন্য রাজ্যের সেই পরিচয়ের জন্য, একটা কার্ড রেশনের জন্য, আর একটা কার্ড ওই রাজ্যে চিকিৎসা করানোর জন্য। আর এই সহায়তা কেন্দ্র উদ্বোধন করলেন একজন পরিযায়ী শ্রমিকের মা। 
(৩) 
এই বাংলার ঘরে ঘরে বিড়ি বাঁধে মহিলারা। কিন্তু মজুরি? প্রতি ১০০০ বিড়ি বাঁধলে পাওয়ার কথা ২৬৮ টাকা, কিন্তু এ বাংলায় সেই মজুরি মিলছে খাতায় কলমে ১২০ টাকা,অথচ বাতিল হওয়া বিড়ি, ছেঁড়া ফাটা পাতা সব বাদ দিয়ে মালিক দেয় ১০০০ বিড়ি পিছু ৮০-৯০ টাকা। অর্থাৎ নির্ধারিত মজুরির এক তৃতীয়াংশ পাচ্ছে বিড়ি শ্রমিকরা। তার সাথে উপরি পাওনা শ্বাসকষ্ট, ঘাড়ে কোমরে ব্যথা। সংসারের কাজ করে তিনদিন বিড়ি বাঁধলে তবে হাজার বিড়ি বাঁধা যায়, মাস শেষে সব মিলিয়ে আয় ২০০০ টাকাও হয় না। বাড়ছে মাইক্রোফিনান্সের মতো ঋণের বোঝা। "বাংলা বাঁচাও যাত্রা" বিড়ি শ্রমিকদের উঠানে বসে তাদের যন্ত্রণার কথা শুনলো। বিড়ি শ্রমিকদের লড়ার সাহস জোগালো। 
(৪)
বাংলা বাঁচাও যাত্রা যখন এগচ্ছে, পাশের স্কুলবাড়িগুলো দেখলেই বোঝা যায় তার অবস্থা কী। ৮০০০ -এর বেশি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে রাজ্যে। আরও ২০০০ এর মতো স্কুল বন্ধ হওয়ার মুখে। স্কুলবাড়ি ভেঙে পড়ছে কোথাও, কোথাও স্কুলে শিক্ষক নেই, মিড ডে মিলের বরাদ্দ কমাচ্ছে কেন্দ্রের সরকার আর রাজ্যের সরকার সেই বরাদ্দ থেকেও চুরি করছে, কম্পোজিট গ্রান্টের টাকা আসে না, চক ডাস্টার কেনার টাকা নেই, মার্কশিট ছাপানোর টাকা নেই। বাংলার স্কুল শিক্ষাকে শেষ করে দিয়েছে রাজ্যের সরকার। এক ঝাঁক কচিকাঁচা বাংলা বাঁচাও যাত্রার মিছিলের বাইকের আওয়াজে যখন পাকা রাস্তায় এসে দাঁড়াচ্ছে, নেতৃবৃন্দ জিজ্ঞেস করছেন, স্কুলে যাস? ফিকে হাসি বলে দিচ্ছে, স্কুলে বন্ধু আছে, টিচার নেই। আবার বেসরকারি বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোর বাইরে বাবা মায়ের লম্বা লাইন ছেলেমেয়েকে ভর্তি করার জন্য, মাসে হাজার দুয়েক টাকা বেতন দিয়ে পড়াতে হবে ছেলেমেয়েদের বেসরকারি স্কুলে। সরকারি স্কুলেও নির্ধারিত ২৪০/- টাকার থেকে বেশি বেতন নিচ্ছে সর্বত্র। ভগবানগোলার এক ছাত্রী বলল, তাদের স্কুলে মেয়েদের টয়লেট নেই। ইসলামপুরের এক ছাত্র জানালো স্কুলে বিজ্ঞান পড়ানোর শিক্ষক নেই। এটাই বাংলার স্কুলের অবস্থা! মাদ্রাসারও একই হাল। এক কথায় শিক্ষার অবস্থা খুবই খারাপ! একটু বয়স বাড়লেই  গ্রাম বাংলার তরুণ প্রজন্ম আসক্ত হচ্ছে ডিয়ার লটারিতে। প্রতিটা বাসস্ট্যান্ডে আট নয়টা করে ডিয়ার লটারির কাউন্টার। সারাদিন বসে সেখানে লটারি বিক্রি চলছে। মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে, তৃণমূক নেতারা কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছে।
(৫)
বাংলা বাঁচাও যাত্রা এগচ্ছে। বাংলাকে বাঁচানোর জন্য। সেই কবে থেকে বাংলাকে গড়ার কাজ করে আসছে লাল ঝান্ডার কর্মীরা। ১৯৭৭ এ সরকার গড়ার পর থেকে কৃষকের হাতে জমি, তার পেটে ভাত, ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠানো,পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা,সরকারি চাকরি একের পর এক প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ বাংলার জনজীবনের মান উন্নত করেছিল বামফ্রন্ট। ২০১১ সালের পর থেকে এই বাংলার শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্মসংস্থানের অবস্থা কী তা পরিষ্কার বাংলা বাঁচাও যাত্রার একের পর এক ছবিতে। যে মানুষগুলোর অধিকার ব্রাত্য করে রেখেছে দুইই সরকার, যাদের শ্রমের দাম জমা হয় স্থানীয় তৃণমূল নেতার বাড়িতে, যাদের বাড়িটুকুর ঠিকানা এখন নদীর বাঁধ, যাদের সারা সপ্তাহ জুড়ে মাথায় ঘোরে লোন শোধ করবার চিন্তা, যাদের কথা কেউ ভাবে না তাদের অধিকার আদায় করার জন্য এগচ্ছে বাংলা বাঁচাও যাত্রা। বাংলাকে বাঁচাতে হবেই, বাংলাকে বাঁচাতে হলে বাংলার মানুষকে বাঁচাতে হবে। বাংলা মানুষকে বাঁচাতে হলে বাংলার ছাত্রদের স্কুলে ফেরাতে হবে, ব্লকে ব্লকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র উন্নত করতে হবে, বিড়ি শ্রমিক, তাঁতিদের মজুরি সঠিক দিতে হবে, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে হবে, নদী ভাঙন রুখতে হবে, উত্তরাংশের পরিবেশকে, জল জঙ্গল জমিকে বাঁচাতে হবে, তরুণ প্রজন্মের হাতে কাজ দিতে হবে তবেই বাংলা বাঁচবে। ধর্মের জিগির তুলে যারা অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্মসংস্থান এর থেকে চোখ ঘোরাতে চাইছে তারা আসলে বাংলার বহুত্ববাদ, বাংলার ঐক্য, বাংলার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চাইছে। লাল ঝান্ডার কর্মীরা বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না।

Comments :0

Login to leave a comment