বইকথা
নতুনপাতা
খেলা শুধুই খেলা নয়
সুমিত গাঙ্গুলি
১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩খেলা শুধুই খেলা নয়
খেলার জগতকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা আসলে চিরকালই শাসক শ্রেণীর কাজ। ‘খেলায় রাজনীতি থাকা উচিত নয়’, ‘রাজনীতি থেকে খেলা দূরে রাখা উচিত’– এই জাতীয় গালভরা কথাবার্তার মাধ্যমে আসলে খেলাকে আরও বেশি রাজনৈতিক করে তোলার কাজটাই তারা করেন। শ্রেণি চেতনায় উদ্বুদ্ধ ব্যক্তির বোঝা উচিত খেলার জগৎ রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয় বরং তা সমাজেরই অংশ।
লেখক দীপ্তজিৎ দাস একজন বামপন্থী কর্মী। তাঁর শ্রেণি চেতনার জায়গা থেকেই তিনি এই ‘গেম অফ লাইফ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। যার প্রতিটি ছত্রে ফুটে উঠেছে খেলার জগতের রাজনীতি এবং লড়াইয়ের কথা।
উঠে এসেছে ১৯০৬ সালের অলিম্পিক বা ‘ফরগটেন গেমস’-র কথা। উচ্চারিত হয়েছে আইরিশ অ্যাথলেট পিটার ও’ কোনরের কথা। আয়ারল্যান্ডের সরকারি অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন না থাকার ফলে, কিভাবে গ্রেট ব্রিটেন কার্যত কারচুপি করেই কিছু আইরিশ অ্যাথলিটকে দলে নিয়েছিল। কিন্তু অলিম্পিকের আসরকেই প্রতিবাদের জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া জন ডেলি, পিটার ও’ কোনর, কন লিহ আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামের মশাল বহন করে নিয়ে যান।
উঠে এসেছে অ্যান্টওয়ার্প অলিম্পিকের (১৯২০) কথাও। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং স্প্যানিশ ফ্লু থেকে নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলা আধুনিক সভ্যতা শুরু হয়েছিল এই অলিম্পিকের মাধ্যমে বেলজিয়ামের মাটি থেকে। লেখক এই গ্রন্থে জার্মান নাৎসিদের অত্যাচারের কথাও তুলে ধরেছেন। একইসঙ্গে জেসি ওয়েন্স সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দলের ১৮ জন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের সাফল্যের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। একটা গোটা অধ্যায় জুড়ে আলোচনা করা হয়েছে নাৎসি কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ফিরে আসা সোভিয়েত জিমন্যাস্ট ভিক্টর চুখারিন সম্পর্কে। লাল ফৌজের হার না মারা মনোভাব নিয়ে যিনি নতুন উদ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর খেলার মাঠে ফিরে আসেন। ১৯৫৪ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের সোভিয়েত জিমন্যাস্টিক দল অসাধারণ পারফরম্যান্সের মূল কান্ডারীতে নিয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালের অলিম্পিকেও তিনটি পদক পেয়েছিলেন তিনি।
১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিককে ঘিরে কি খবর রাজনৈতিক জটিলতা নিয়ে একটি অধ্যায় রয়েছে। সুয়েজ খাল সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে এই অলিম্পিক শুরু হয়েছিল। অজস্র দেশ বয়কট করেছিল এই অলিম্পিক। দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল সমাপ্তি অনুষ্ঠানে ক্রীড়াবিদদের অংশগ্রহণ এবং একসঙ্গে ভাবমনিময় প্রচলনের।
ক্ল্যাসিয়াস ক্লে-কে নিয়ে আছে গোটা একটা অধ্যায়। পরবর্তীকালে বিশ্বজুড়ে শান্তি সম্প্রীতির আইকন হয়ে ওঠা মহম্মদ আলি একদা এই নামেই পরিচিত ছিলেন তা আমরা সকলেই জানি। তবে বারংবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অমানবিক নীতির বিরোধিতা করে চক্ষুশুল হওয়া আলী ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে অন্যতম পতাকা বাহুক ছিলেন। বিভাজনের বিরুদ্ধে সংহতির এই প্রতীককে এই গ্রন্থে স্থান দেওয়া হয়েছে।
১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিক, ১৯৬৮ র অলিম্পিকের ‘ব্ল্যাক পাওয়ার প্রোটেস্ট’, বিশ্বের দরবারে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে বার্তা তুলে ধরার লড়াই, ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে অ্যাবরিজিনালদের প্রতিনিধি ক্যাথি ফ্রিম্যান উঠে এসেছেন এই গ্রন্থে।
প্রকৃতপক্ষে অলিম্পিকের মঞ্চকে রাজনৈতিক প্রতিবাদের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করেছেন ক্রীড়াবিদরা। তাদের শাস্তিও পেতে হয়েছে, তারপরও তারা হাল ছাড়েন নি। তারা জানতেন এই মঞ্চে সাফল্যই একমাত্র তাদের ওপর ঘটে যাওয়া নিপীড়ন এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে সবথেকে বড় হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে সারা বিশ্বের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে বার্তা। ফলে যারা মনে করে খেলা রাজনীতির বাইরে, খেলা নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়, তাদের আরেকবার এই বইটা পড়া উচিত। জানা উচিত ইথিওপিয়ার ক্রীড়াবিদ ফেইসা লিলেসার কথা। ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটলে লেখক, প্রকাশক এবং সভ্যতা সকলেই খুশি হবে।
শেষে দুটি প্রসঙ্গ বলতেই হয়। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আলোচনায় ‘স্টপ দ্য সেভেন্টি টুর’-র আলোচনা হওয়া উচিত ছিল।
‘গেম অফ লাইফ’। দীপ্তজিৎ দাস। স্নিগ্ধা প্রকাশনী। ১৫০ টাকা।
Comments :0