গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি
১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে সাথে নিয়ে ক্ষমতার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণের কাজ বামফ্রন্ট সরকারই শুরু করে। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে পঞ্চায়েতী রাজ গঠিত হলেও কার্যত তার কোনও কাজ ছিল না। এদের কোনও দপ্তর বা অফিস সহ কিছুই ছিল না। মূলত সুদখোর মহাজন, ধনী, জোতদারদের ঘুঘুর বাসা ছিল সেই পঞ্চায়েত।
পঞ্চায়েতী রাজের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার প্রথম পথ প্রদর্শকের ভুমিকা পালন করে। স্বাধীনোত্তর ভারতে পশ্চিমবঙ্গই প্রথম রাজ্য যেখানে ১৯৭৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম প্রকৃত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরনের মধ্যে দিয়ে গ্রামীণ উন্নয়নের কাজ শুরু হয়।
পশ্চিমবঙ্গে এত সুন্দর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার থাকতেও তৃণমূল সরকার “দুয়ারে সরকার" নামক তথাকথিত "সোনার পাথরবাটি মার্কা" কার্যক্রমের ঘোষণা ক'রে কার্যত পঞ্চায়েতী রাজের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করার পরিকল্পিত প্রয়াস চালাচ্ছে। বর্তমান রাজ্য সরকারের এই ধরনের প্রয়াস কার্যত পঞ্চায়েতী রাজের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছে।
পঞ্চায়েতকে নিয়ে এই ধরনের শিশুসুলভ ভাবনার বিরুদ্ধে অনেক আগেই বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার সময়েই কমরেড জ্যোতি বসু বলেছিলেন- রাইটার্স থেকে সরকার পরিচালনা নয়, সরকারকে পৌঁছতে হবে গ্রামীণ মানুষের দোরগোড়ায়। গ্রামের মানুষ ঠিক করবেন গ্রামের উন্নয়ন।
এজন্য রাইটার্স থেকে তিনি কোনও কৃতিত্ব নেবার কথা কখনোই ভাবেননি। এ কারণেই পঞ্চায়েতী রাজের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা তিনি বলেছিলেন। ক্ষমতার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প ‘দুয়ারে সরকার নয়', জনগনের প্রকৃত নির্বাচিত পঞ্চায়েতই হল জনগণের সমস্যার নিরসনের এবং বিকেন্দ্রীভূত গণতান্ত্রিক ক্ষমতার মুল চাবিকাঠি।
প্রকৃত পঞ্চায়েতী রাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে ১৯৯২ সালে তৈরি হয় গ্রাম সংসদ। আর সেটা ৭৩ তম সংবিধান সংশোধনের আগেই আমাদের রাজ্যে কার্যকর করা হয়েছিল।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সাথে তুলনামূলক বিচারে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম সংসদ ছিল অনেক গণতান্ত্রিক, শক্তিশালী এবং কার্যকর। কার্যত পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে বামফ্রন্ট সমাজের দুর্বলতর অংশের দ্বারা দুর্বলতর মানুষের শক্তিশালী জনগনের সরকারের স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সেটাকেই ভাঙার কাজে গ্রাম সংসদ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নিরন্তর যুক্ত ছিল প্রতিক্রিয়ার শক্তি সমুহ।
বামফ্রন্ট সময়কালে পঞ্চায়েতী রাজের উপযুক্ত প্রয়োগের ফলে বিতারিত হয় “ঘুঘুর বাসা" নামধারী পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা। গ্রামীন জনগণের উন্নয়নের চাবি কাঠিতে পরিণত হয় পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতী রাজ, যা বিশ্বের কাছে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে ভারতকে।
২০১১ পালা বদলের পর পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতকে লুঠেরার পঞ্চায়েতে পরিণত করেছে তৃণমূল সরকার। তৃণমুল এবং বিজেপির মতো প্রতিক্রিয়ার শক্তি রাজ্য সরকারে ক্ষমতায় আসার ফলে এই কাজ সহজ হয়ে পড়ল। এদের দখলে থাকা গ্রাম সংসদ এবং পঞ্চায়েত গুলো প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতিয়ারে পরিণত হল। এমন কি তৃণমুল বিজেপির দ্বারা পরিচালিত নয়, এমন কিছু মুষ্টিমেয় যে কটা গ্রাম পঞ্চায়েত আছে, সেগুলোকেও স্বাধীনভাবে নিয়ম মেনে কাজ করতে দেওয়া হল না। এর বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করে পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকার কায়েমের যন্ত্র হিসাবেই কমিউনিস্টদের দেখতে হবে এই পঞ্চায়েতী রাজকে।
লুঠেরাদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতী রাজকে। এ সংগ্রাম এক মহা সংগ্রাম। এবারের নির্বাচন আমদের পার্টির আপামর সমর্থক দরদী এবং সদস্যদের কাছে এক মহা পরীক্ষা।
মনে রাখতে হবে ১৯৭৮ এ গ্রামীণ জনতার হাতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মূল স্রোতের প্রবাহ ছিল উপর থেকে। অর্থাৎ বামফ্রন্ট সরকারের সদিচ্ছার ফসল ছিল সেই পঞ্চায়েত। কিন্ত এবারের লড়াইটা উল্টো। এখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে শ্রমজীবীদের প্রতিষ্ঠিত করতে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লড়াই লড়তে হলে, সবার প্রথমে গঠন করতে হবে গ্রামীন শ্রমজীবীদের গ্রাম পঞ্চায়েত। এই লড়াইয়ে সাফল্যের উপরেই নির্ভর করছে আগামী দিনে দেশে আমাদের পার্টির লক্ষ্য পূরণের এক গুরুত্বপূর্ণ মহাসংগ্রাম।
এখনও নির্বাচন ঘোষণা হয়নি। কিন্ত যে কোনও সময় নির্বাচন ঘোষণা হবে। শাসক দল কখনোই বিরোধীদের অনুকুল সময়ে নির্বাচন করার ঝুঁকি নেবে এটা মনে করার কোনও কারণ নেই।
এমন মনোভাবও আছে যে "আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা হোক তখন দেখা যাবে।" এই মনোভাব নিয়ে আমাদের থাকলে চলবে না।
কোনও আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূল এবং বিজেপি সহ কোন মৌলবাদী শক্তির হাতে যাতে তুলে না দেওয়া হয়, সে দিকে পার্টিকে সতর্ক দৃষ্টি থাকতে হবে।
যেখানে কোনও প্রার্থী পাওয়া যাবে না সেখানে পার্টির নেতৃস্থানীয় কমরেডদের দাঁড়াতে হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজ্যে মোট পঞ্চায়েতের সংখ্যা ৩৩৫৭ টি। এতগুলো পঞ্চায়েতে এবারের বাজেটে তৃণমূলের সরকার গ্রাম উন্নয়ন বাবদ মোট বরাদ্দ করেছে মাত্র ১৪২২ কোটি টাকা। আসলে গ্রামোন্নয়ন নয়, পঞ্চায়েতেকে দখল করে বালি, জমি, মাটি, পাথর, কয়লা,মোরাম,গাছ, মাছ সহ পঞ্চায়েত এলাকার সম্পদের উপর মাফিয়াদের দখলদারি কায়েম করাই এই দলের লক্ষ্য। এর বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে।
সব আসনেই বামফ্রন্ট এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক শক্তি সহ প্রয়োজনে ধর্মনিরপেক্ষ তৃণমূল-বিজেপিও মৌলবাদ বিরোধী ব্যক্তি বর্গকে নিয়ে লড়াইয়ে শামিল হতে হবে। কাজেই প্রয়োজনে এবারের নির্বাচনে বাম, বামের বাইরে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি, এদের সবাইকে নিয়েই এই লড়াই করবে সিপিআই(এম)।
Comments :0