Post Editorial

নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ: রাজ্যের উচ্চশিক্ষায় অশনিসঙ্কেত

উত্তর সম্পাদকীয়​

Post Editorial


নিলয়কুমার সাহা
অবশেষে আগামী শিক্ষাবর্ষ অর্থাৎ ২০২৩-২৪ থেকে পশ্চিমবঙ্গে স্নাতকস্তরে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ নির্দেশিত নয়া শিক্ষাক্রম চালু হতে চলেছে। ৩১ মে, ২০২৩ রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর এক প্রেস বিজ্ঞতিতে রাজ্যের সরকারি, সাহায্যপ্রাপ্ত এবং বেসরকারি সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের বর্তমান সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের পাশাপাশি নিজেদের উদ্যোগে অতিরিক্ত সম্পদ সৃষ্টি করে এই নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসৃত শিক্ষাক্রম কার্যকর করার সুপারিশ করেছে। মজার কথা, বিকল্প শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর তিন-তিনবার বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করলেও আজ এই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রাজ্য সরকার আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে স্নাতকস্তরের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগে নির্দেশিত ‘জাতীয় কারিকুলাম অ্যান্ড ক্রেডিট ফ্রেমওয়ার্ক' পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করে ডিগ্রি প্রদানের কথা ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ স্নাতকস্তরে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতির সবটাই গ্রহণ করে তা কার্যকর করার সবুজ সঙ্কেত দিল রাজ্য সরকার। প্রাথমিকভাবে বিরোধিতা, বিকল্পের খোঁজে তিন-তিনবার কমিটি গঠন এবং অবশেষে ওই শিক্ষানীতি কার্যকর করার নির্দেশে কি রাজ্য সরকারের দুরভিসন্ধি প্রকট হয়ে ওঠে না? সম্ভবত রাজনৈতিক ছায়া যুদ্ধের গভীরে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো প্রবাহিত কেন্দ্র ও রাজ্যের পারস্পরিক যোগসাজশই রাজ্যের এই অবস্থানের কারণ বলে মনে হয়। এই পরিস্থিতিতে যে সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অত্যন্ত জরুরি তা হলো, এই শিক্ষানীতি রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে বিপন্ন করবে না তো? নয়া এই শিক্ষানীতি রাজ্যের শিক্ষার্থীদের জন্য কী কী নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে? আর সবশেষে যে প্রশ্নটি রাজ্যের লাখো লাখো কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সহ সমগ্র অভিভাবক সমাজকে চরম আতঙ্কে রেখেছে তা হলো, রাজভবন আর নবান্নের ‘যুক্তসাধনা’য় কতটা সুরক্ষিত রাজ্যের উচ্চশিক্ষা?


রাজ্যে উচ্চশিক্ষার হালহকিকত
দীর্ঘ সময় ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ সম্পর্কে রাজ্যের অস্বচ্ছ অবস্থান রাজ্যবাসীকে মূলত শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক সমাজকে চরম মানসিক উৎকণ্ঠায় রেখেছে। রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে নজিরবিহীন, লাগামহীন নিয়োগ দুর্নীতির পরিমণ্ডলে এই উৎকণ্ঠা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যে কোভিড উত্তর পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাফে কমেছে চার লক্ষ! রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রী অবাস্তব একমুখী যুক্তির অবতারণা করলেও, রাজ্যে বিদ্যালয় ছুট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিই এই অবস্থার অন্যতম কারণ আর এই অকল্পনীয় বাস্তব পরিস্থিতির ভিত্তি হলো বেকারি, বেরোজগারি যা কোভিড পরবর্তী সময়ে সংক্রামক ব্যটাধির মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে সারা দেশের সাথে এরাজ্যেও বেড়ে চলেছে। এই অবস্থায় রাজ্যের বর্তমান উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার হালহকিকত সম্পর্কে আলোকপাত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, এই রাজ্যে বিগত এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই হারে নতুন পদ সৃষ্টি হয়নি, শূন্যপদ পূরণ হয়নি, কলেজগুলিতে কিছু নিয়োগ হলেও বহু পদ এখনও শূন্য। রাজ্যের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীর শূন্য পদে দীর্ঘ সময় কোনও নিয়োগ না হওয়াতে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা কার্যত ‘ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট’-এ জীবন-মৃত্যুর লড়াই করে চলেছে। দ্বিতীয়ত, সারা দেশের সাথে রাজ্যে স্নাতক স্তরে ‘চয়েজ বেস ক্রেডিট সিস্টেম’-এ কার্যত শিক্ষার্থীর চয়েজের কোনও অবকাশ নেই, আছে কেবল ছ’মাস অন্তর পরীক্ষার চাপ। বর্তমানে পরীক্ষা নির্ভর এই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির হার ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। এই বিষয়ে রাজ্য প্রশাসনের চরম উদাসীনতায় রাজ্যের অধিকাংশ কলেজ কেবলমাত্র ‘এনরোলমেন্ট সেন্টার’-এ পরিণত হতে চলেছে। তৃতীয়ত, কোভিড অতিমারীর দুটি বছর অনন্যোপায় হয়ে উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো ছাড়া বাধ্যতামূলক অনলাইন ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরসনে আজ পর্যন্ত কোনও সরকারি উদ্যোগ গৃহীত হয়নি।

 সর্বোপরি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তৈরি রাজ্যের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থা ধূলিসাৎ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার রাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে যে মনোনীত স্বৈরাচারি শাসন কায়েম করেছে, রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করে চলেছেন সেই কু-শাসনের ভয়াবহ পরিণাম, যা রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। এই স্বৈরাচারী শাসনে ২০১৬ সালের পর রাজ্যের কোনও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি কারণ রাজ্য প্রশাসন পরিকল্পিতভাবে দলীয় স্বার্থ কায়েম করতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করেছে। রাজ্যের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব করছে ছাত্র নামধারী এলাকার উচ্ছৃঙ্খল তৃণমূল সেবক। এই মহান কাজে প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ আধিকারিক, অধ্যক্ষ এবং উপাচার্যগণ যাঁরা প্রশ্নাতীত আনুগত্যকেই গদি বাঁচানোর হাতিয়ার করেছেন। নেতৃত্বে আছেন ‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এর নাট্যকার নাট্য ব্যক্তিত্ব মাননীয় অধ্যাপক শিক্ষামন্ত্রী। 


নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি এবং উচ্চশিক্ষা
এই দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘ সময় পরিচালিত অত্যন্ত সুষম বণ্টিত, ভারসাম্যপূর্ণ ৩+২ প্রথার পরিবর্তে প্রধানত মার্কিনী প্রথা অনুসরণ করে ৪+১ প্রথার প্রবর্তন কেবল দেশীয় উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করবে না, বদলে দেবে আগামীদিনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত দেশের সার্বিক শিক্ষাচিত্র। নতুন শিক্ষানীতিতে একজন বিদ্যার্থীকে স্নাতক স্তরে প্রস্তাবিত চার বছরের পাঠ্যক্রম সাত বছরে শেষ করতে হবে। মজার কথা উল্লিখিত সাত বছরের সময়কালে কোনও একজন শিক্ষার্থী একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাধিক বার ভর্তি হয়ে একাধিক মাধ্যমে এই শিক্ষাক্রম শেষ করতে সক্ষম হবে। এমন ‘ছাত্রবন্ধু’ শিক্ষাক্রম স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের নাগরিক সমাজ কি আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেছেন? প্রস্তাবিত এই শিক্ষানীতিতে একজন শিক্ষার্থী ‘মাল্টিপিল এন্ট্রি, মাল্টিপিল এক্সিট’ নামক ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’ হাতে নিয়ে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ বর্ষের শিক্ষাক্রম শেষ করে যথাক্রমে অর্জন করবে সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, ডিগ্রি এবং ডিগ্রি উইথ রিসার্চ। ‘মাল্টিপিল এন্টি’র সুবিধা নিয়ে একজন শিক্ষার্থী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এক বছরের শিক্ষাক্রম শেষ করে সার্টিফিকেটের অধিকারী হয়ে নিজের প্রয়োজনে শিক্ষাক্রম থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে আবার সময় সুযোগ মতো দেশের অন্য যেকোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার বাকি অংশের শিক্ষাক্রম শেষ করার জন্য পুনরায় ভর্তি হতে পারবে, যদি সেই শিক্ষার্থীর পছন্দের প্রতিষ্ঠানে আসন ফাঁকা থাকে। এই প্রক্রিয়া দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ বর্ষে একইরকমভাবে কার্যকর হবে এবং শিক্ষাক্রমের কোনও এক পর্বে শিক্ষাক্রম ছেড়ে যাওয়া শিক্ষার্থীর অর্জিত ‘ক্রেডিট’ জমা থাকবে ‘ডিজিটাল লকার’-এ। সাত বছর সময়ের যে পর্বে ওই শিক্ষার্থীর অর্জিত ‘ক্রেডিট’ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাবে, সেই সময়েই তাকে ডিগ্রি অথবা ডিগ্রি উইথ রিসার্চ প্রদান করা হবে। অভিনব এই ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীর জন্য ‘মাল্টিপিল এন্টি’র সর্বোচ্চ সীমা না থাকলেও চারটি ‘মাল্টিপিল এক্সিট’-এর উল্লেখ আছে। নয়া এই শিক্ষানীতি অনুসারে একজন শিক্ষার্থী চার বছরের শিক্ষাক্রমে অনলাইন, ওপেন ডিসট্যান্স লানিং, অফলাইন হাইব্রিড অর্থাং লেকচার এবং টিউটোরিয়াল — ভিন্ন ধারার এই তিন মাধ্যমের যে কোনও একটি অথবা একাধিক মাধ্যম ব্যবহার করতে পারবে। ‘কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক’ শিরোনামে এই শিক্ষানীতিতে ‘হলিস্টিক এডুকেশন’-এর কথা উল্লিখিত হয়েছে। প্রস্তাবিত এই ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী প্রথমবর্ষে ইংরেজি সাহিত্যের সাথে রাশিবিজ্ঞান, দ্বিতীয়, তৃতীয়, এবং চতুর্থবর্ষে সেই একই শিক্ষার্থী পর্যায়ক্রমে গণিতের সাথে ফ্লিম স্ট্যাডিজ, কম্পিউটার সায়েন্সের সাথে ফ্যাশান ডিজাইন এবং ইতিহাসের সাথে পরিবেশ বিদ্যা নিয়ে তার স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম সম্পন্ন করতে পারবে। অর্থাৎ এই অভিনব শিক্ষাক্রমে একজন শিক্ষার্থী ভিন্ন ধর্মী একাধিক বিষয়ে জ্ঞার্নাজনে সক্ষম হবে। এই ফেমওয়ার্কে ‘ভোকেশনাল ট্রেনিং’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানে এই ট্রেনিং সম্পন্ন করার নির্দেশিকাও নয়া এই জাতীয় শিক্ষানীতিতে বর্তমান। আলোচ্য বিষয়ে যে সব প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই সেগুলি হলো, একাধিক বিষয়ে স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী একজন স্নাতক শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর পর্বে কোন বিষয়ে পরবর্তী শিক্ষা লাভ করবে? বর্তমান পরিকাঠামোয় শিক্ষার্থীদের সামনে একাধিক মাধ্যম পরিবেশনের অঙ্গীকার কতটা বাস্তবসম্মত? ‘ডিজিটাল লকার’, ‘ক্রেডিট ট্রান্সফার’, ‘মাল্টিপিল এন্ট্রি মাল্টিপিল একজিট’ ইত্যাদি প্রযুক্তি নির্ভর অত্যাধুনিক কৃৎকৌশলের প্রয়োগ দেশের বর্তমান উচ্চশিক্ষা পরিকাঠামোয় অবিশ্বাস্য নয় কি? স্নাতক স্তরের তৃতীয়বর্ষে যে সকল শিক্ষার্থী ৭৫ শতাংশ নম্বর অর্জনে সমর্থ হবে কেবল তারাই স্নাতক পর্যায়ে চতুর্থবর্ষের শিক্ষাক্রমে প্রবেশের সুযোগ পাবে এবং চতুর্থ বর্ষের শিক্ষাক্রমের শেষে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছরের স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে প্রবেশ করবে অথবা সরাসরি গবেষণায় যুক্ত হবে। যারা স্নাতক স্তরের তৃতীয়বর্ষে ৭৫ শতাংশ নম্বর অর্জনে ব্যর্থ হবে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ বছরের স্নাতকোত্তর পাঠক্রমের সুযোগ পাবে। ২ বছরের স্নাতকোত্তর পাঠক্রমের দ্বিতীয় বছরটি সম্পূর্ণ গবেষণা কেন্দ্রিক হবে। এই দুই বিকল্পের পাশাপাশি এই শিক্ষানীতি অখণ্ড ৫ বছরের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাঠক্রমেরও সুপারিশ করেছে।

এই ক্ষেত্রে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য স্নাতকোত্তর অথবা ৪ বছরের গবেষণা- স্নাতক পাঠক্রমের যে কোনও একটিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।  সুতরাং এই নীতি অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে একই সাথে ২ বছর এবং ১ বছরের স্নাতকোত্তর পাঠক্রম পরিচালিত হবে। ৪ বছরের গবেষণা-স্নাতক পাঠক্রমের সফল শিক্ষার্থী এই নীতি অনুসারে স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে প্রবেশ না করেই গবেষণায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। 
এই শিক্ষানীতিতে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ‘রিসার্চ ইনটেনসিভ ইউনির্ভাসিটি’, ‘টিচিং ইনটেনসিভ ইউনির্ভাসিটি’, ‘অটোনমাস ডিগ্রি গ্র্যান্টিং কলেজেস’— এই তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। নয়া এই শিক্ষানীতির সুপারিশ অনুযায়ী সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত আর কোনও কলেজের অস্তিত্ব থাকবে না। ‘অটোনমাস ডিগ্রি গ্র্যান্টিং কলেজেস’এ উন্নীত হতে না পারলে মৃত্যু ঘটবে রাজ্যের বহু কলেজের। কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘রিসার্চ ইনটেনসিভ’ আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘টিচিং ইনটেনসিভ’-এর তকমা দেওয়া হবে অথবা কীসের ভিত্তিতে এই বিভাজন কার্যকর হবে সেই বিষয়ও স্পষ্ট নয়। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রম এবং গবেষণার এই বিভাজন আগামীতে দেশের উচ্চশিক্ষাকে কোন অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে তার উত্তর আমাদের অজানা।

 জাতীয় এই শিক্ষানীতির আর একটি অভিনব দিক হলো পাঠ্যক্রমে ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’-এর অন্তর্ভুক্তি। এই নির্দেশিকা অনুসারে দেশের বর্তমান শিক্ষার্থীদের সাথে প্রাচীন ভারতবর্ষের ঐতিহ্য, প্রথা, ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্যবিদ্যা ইত্যাদির পরিচিত ঘটানোর উদ্দেশ্যে প্রথমবর্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠক্রম শুরুর আগে তাদের জন্য ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ ভিত্তিক ‘ইনডাকশন প্রোগাম’-এর সুপারিশ করা হয়েছে। এই নির্দেশিকায় শিক্ষার্থীদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র, গণিত, সমাজ বিজ্ঞানের নানান ধারার সাথে প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যের সংমিশ্রণের পাঠদানের উদ্দেশ্যে শিক্ষকদের জন্য বাধ্যতামূলক ‘ইনডাকশন প্রোগাম’ এবং ‘রিফ্রেসার কোর্স’-এর সুপারিশও বর্তমান। বৈদিক যুগের গণিত, আধুনিক গণিতের সাথে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ, জৈব রসায়ন, জৈব পদার্থবিদ্যার সাথে আয়ুর্বেদ চর্চা, এবং প্রাচীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে পড়ুয়াদের সম্যক পরিচয় ঘটানোর উদ্দেশ্যে ক্ষেত্র সমীক্ষার সময় তাদেরকে মন্দির, গুরুকুল, আয়ুর্বেদ চর্চা কেন্দ্র ইত্যাদি স্থানে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশিকা এই শিক্ষানীতির উজ্জ্বলতম বৈশিষ্ট্য।
রাজভবন এবং নবান্নের যুক্তসাধনা
বিগত বেশ কয়েক বছর রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে আলোচিত বিষয় রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান এবং প্রশাসনিক প্রধানের দ্বৈরথ। রাজ্য সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদ থেকে রাজ্যপালকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বসাতে বদ্ধপরিকর রাজ্য প্রশাসন। এই সঙ্ঘাতের আবহে রাজ্যের বিশিষ্ট কোনও শিক্ষাবিদকে আচার্যপদে নিযুক্ত করার দাবিও বর্তমান। ড. সি বি আনন্দ বোস রাজ্যপালের দায়িত্বভার গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যেই গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করেন রাজভবন এবং নবান্নের এক অভূতপূর্ব সমন্বয় আর এই সমন্বয়ের ফলশ্রুতিতে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য নিয়োগের আইনি জটিলতারও অবসান হয়। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে রাজ্যপাল ড. বোস বিতর্কিত উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়াটিকে অত্যন্ত কৌশলে বৈধতা প্রদান করেন এবং রাজ্য সরকারও রাজ্যপালকেই আচার্যের মর্যাদা প্রদান করে নিজেরা কণ্টকমুক্ত হন। মজার কথা রাজ্য প্রশাসন এই পর্বে ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনির্ভার্সিটি লজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২২’ সম্পর্কে একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্যের হঠাৎ হঠাৎ উপস্থিতি রাজ্য প্রশাসনের দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রী রাজ্যপালের এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনকে ‘মত্ত হস্তীর পদচারণা’র সাথে তুলনা করে পুনরায় হিমঘরে চলে যাওয়া ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনির্ভার্সিটি লজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২২’ দ্রুত কার্যকর করতে উদ্যত হয়েছেন। চিত্তাকর্ষক এই খেলায় তামাম বঙ্গবাসী কেবল দর্শক। রাজ্যপাল সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, ঠিক তেমনি সমর্থনযোগ্য নয় নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির প্রশস্তি বর্ণনার পাশাপাশি এই নীতি কার্যকর করতে রাজ্যপালের ধারাবাহিকভাবে রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণ। অতি সম্প্রতি রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করলেন বিশ্ববরেণ্য দুই স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ এবং শেকসপিয়রকে উদ্ধৃত করে মাননীয় রাজ্যপাল এবং রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর বাক্‌ যুদ্ধ। এখানেই শেষ নয়, এই ঘটনার পরেও রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করে চলেছেন এই ‘যুক্ত সাধনা’র দ্বৈরথ। রাজ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী এক উপাচার্যকে কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার কারণে রাজ্যপাল বরখাস্ত করলেও সেই বরখাস্ত উপাচার্যকেই অস্থায়ী উপাচার্য হিসাবে কাজ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর।

 সার্বিক এই বিপর্যয়ের মধ্যে কেন্দ্র ও রাজ্যের ছায়া যুদ্ধের পাশাপাশি রাজ্যের সাংবিধানিক এবং প্রশাসনিক প্রধানের ‘অম্লমধুর সম্পর্ক’-এর কারণে বেহাল রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা। এই আবহে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ সম্পর্কে রাজ্য সরকারের দীর্ঘ নীরবতা, হঠাৎ বিদ্রোহ ঘোষণা এবং অবশেষে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে নিঃশর্ত আত্মসমার্পণের প্রেক্ষাপটে রাজ্যের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী সহ বৃহত্তর নাগরিক সমাজ অদূর ভবিষ্যতে প্রত্যক্ষ করতে চলেছেন পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া!


 

Comments :0

Login to leave a comment