চন্দন দাস
আপনি আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। আপনি মহান।
গত ২৯ মে, সোমবার, আপনি সারাদিন টেলিভিশনে খবরই দেখেননি। শুধু সিরিয়াল দেখেছেন? সিনেমা দেখেছেন? হতে পারে। নবান্নের অথবা বাড়ির টেলিভিশন সেটের রিমোটে হাতই ছোঁয়াননি আপনি? এমনকি আপনার মোবাইলের নেটও অন করেননি? যদিও আপনার টুইটার অ্যাকাউন্ট বলছে, আপনি, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সেদিন, অর্থাৎ গত ২৯ মে টুইটারে ছবি পোস্ট করেছেন।
কিন্তু তবু আপনি সিপিআই(এম)’র সমর্থনে সাগরদিঘিতে জেতা কংগ্রেসের বিধায়ককে আপনার ভাইপোর তৃণমূলে বরণ করে নেওয়ার খবর সেদিন জানতে পারেননি।
আপনি, মমতা ব্যানার্জি মঙ্গলবার নবান্নে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন যে, সাগরদিঘির বিধায়কের তৃণমূলের যোগ দেওয়ার খবর আপনি জানতেন না। পরেরদিন খবরের কাগজ পড়ে জেনেছেন! অর্থাৎ আপনার ভাইপো, যিনি অনেকগুলি দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, তিনি আপনার সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই বায়রন বিশ্বাসকে দলে টেনে নিয়ে নিয়েছেন। এমনকি বায়রনের তৃণমূলে যোগ দেওয়ার আগেরদিন, শালবনির সভাতে আপনারা দু’জনেই মঞ্চে ছিলেন। তখনও অভিষেক তাঁর দল ভাঙানোর পরিকল্পনার কথা আপনাকে বলেননি।
বিশ্বাস করা শক্ত। খুব শক্ত। তবু যেহেতু বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, সূর্য সেন, প্রীতিলতার মাটিতে আপনি প্রশাসনের প্রধান, আমরা বিশ্বাস করতে চাই আপনি সত্যিই বলছেন। আপনাকে না জানিয়ে, আপনাকে স্রেফ অন্ধকারে রেখে বিরোধীদের বিধায়ককে মঞ্চে এনে, দলীয় পতাকা হাতে তুলে, হেসে হেসে ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে ‘বিজয়ী’-র আচরণ করার নির্লজ্জতা, দুঃসাহস অর্জন করা লোকের জন্ম তৃণমূলে হয়ে গেছে।
তৃণমূল নামের চোরের সিন্ডিকেট আর আপনার কন্ট্রোলে নেই— এই যে আপনি বোঝাতে চাইলেন, আমরা বিশ্বাস করার চেষ্টা করব। খুব কঠিন। খুবই কঠিন।
কঠিন এই কারণে যে, আপনার ট্র্যাক রেকর্ড অন্য কথা বলছে। আপনি বলেছেন যে, সিপিআই(এম) নেতাদের আপনি গ্রেপ্তার করেননি, ক্ষমা করে দিয়েছেন। আসলে আপনি একটি ‘অডিট টিম’ বানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী হয়েই। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালের দুর্নীতি খুঁজে বের করার জন্য। কিন্তু টিম কিছু পায়নি। তাই সেই অডিট বন্ধ হয়েছে। আপনি বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু প্রমাণ করতে পারেননি। আপনি বলেছেন যে, প্রয়াত সুব্রত মুখার্জি আপনাকে বলেছিলেন সিপিআই(এম)-কে রেশন দেওয়ার মতো ‘সপ্তাহে একবার করে পেটাই করার’ জন্য। কিন্তু আপনি করেননি। মিথ্যা বলেছেন। আপনার শাসনে সিপিআই(এম)’র অনেক নেতা, কর্মী শহীদ হয়েছেন। হাজার হাজার বাড়িতে লুট হয়েছে। অনেকে ঘরছাড়া হয়েছেন। লক্ষাধিকের নামে মিথ্যা মামলা। এমনকি বামফ্রন্টের মহিলা কর্মী, পঞ্চায়েতে প্রার্থী হতে চাওয়া মহিলাকে চুলের মুঠি ধরে রাস্তায় প্রায় বিবস্ত্র করেছিল তৃণমূল কর্মীরা। বিধানসভার মধ্যে আপনার বিধায়করা দেবলীনা হেমব্রম, গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি, সুশান্ত বেসরার মতো বামপন্থী বিধায়কদের মাটিতে ফেলে মেরেছিল। তাঁদের হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগও দেওয়া হয়নি।
সবই আপনি জানতেন। এই সবই আপনি করতে দিয়েছেন সেই একজনের পরামর্শে। যিনি ২০১১-র মে-তে আমেদাবাদ থেকে আপনাকে অভিনন্দন জানিয়ে উপদেশ দিয়েছিলেন— ‘প্রথম রাতেই বিড়াল মেরে দিন।’ সেই উপদেশ আমরা সংবাদপত্রে দিনের দিনই পড়েছিলাম।
সেই লোকটিকে নিশ্চই ভোলেননি। তিনি নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। আপনি তাঁর পরামর্শে রাজ্য চালান। উনি আপনার বন্ধুত্ব নিয়ে দেশ চালান।
মোদী মানেই তো বিজেপি। মোদী মানে? সঙ্ঘ। আপনি জানেন। আর এবারের ‘সাগরদিঘি কাণ্ড’-এ সঙ্ঘ আছে। আছে নাগপুরের নির্দেশ। আছে বিজেপি।
কেন? আপনি বলবেন — ‘বাজে কথা।’ আমরা বলি — ঘোর সত্যি। ঘটনাক্রম কী বলছে?
আপনার ভাইপো, অভিষেক ব্যানার্জি প্রায় তিনদিন ছিলেন মুর্শিদাবাদে। গত ৬, ৭, ৮ মে। তাঁর ‘নবজোয়ারে’ ভেসে এসে তখন বায়রন বিশ্বাস তৃণমূলের পতাকা হাতে তুলে নেননি। অভিষেককে সিবিআই’র জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল গত ২০ মে। নিজাম প্যালেসে। সেখানে ঠিক কী হয়েছিল, জেরা নাকি অন্যকিছু— রাজ্যবাসীর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে অভিষেক দাবি করেছিলেন, ‘অশ্বডিম্ব।’ ডিম ঘোড়ার নাকি বিজেপি-র তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ওই ৯ঘন্টা ৩৯ মিনিট জেরার ৯দিন পরে সিপিআই(এম)’র সমর্থনে, কংগ্রেসের প্রতীকে জেতা বিধায়ক গত ২৯ মে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির বিধায়ক প্রায় ২৩০ কিমি পথ উজিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে এসে তৃণমূলের পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন। তাঁকে তৃণমূলে বরণ করে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো।
আগের দিন আপনার আর আপনার ভাইপোর শালবনিতে সভা। তারপর ঘাটালে বায়রনের তৃণমূলে যোগদান। ঘাটাল কেন? রাজ্যের যে কটি জায়গায় তৃণমূল হালে পানি পাচ্ছে না, তার একটি ঘাটাল, দাসপুর সহ পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা। কাছেই পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং হুগলী। পূর্ব মেদিনীপুরে বিজেপি’র নেতা, আসলে তৃণমূলী শুভেন্দু অধিকারীর বাড়ি। কিন্তু সেখানেও তৃণমূল-বিজেপি’র লোক কমছে। লাল ঝান্ডা বড় বড় মিছিল করছে। আর বাঁকুড়া, হুগলীতেও সব ভয় ভেঙে মানুষ এসে দাঁড়াচ্ছেন লাল ঝান্ডার পাশে।
তবে বায়রন বিশ্বাসকে তৃণমূলে টেনে নিয়ে শুধু কয়েকটি জেলায় নয়, সারা রাজ্যেই একটি বার্তা দিতে চেয়েছে আপনার দল। বায়রন বেইমান— কোনও সন্দেহ নেই। এর আগেও আপনার দল বামফ্রন্ট, কংগ্রেসের অনেক বিধায়ককে ভাঙিয়েছেন। কয়েকজন বিজেপি-তেও গেছে। লোভের, ধান্দার কোনও দলীয় লক্ষ্মণরেখা নেই। সবাই একই মাত্রায় আদর্শে অটল থাকবেন— এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। কোনোদিন ছিল না। কৃষক আন্দোলনের দীর্ঘ কয়েক দশকের নেতা, একসময় প্রবল লড়াকু মানুষকেও আমরা দেখেছি আপনার দলে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হতে— বিলকুল হেলে সাপ হয়ে যেতে।
এসবে আদর্শ মিথ্যা হয়ে যায় না।
যেমন ‘সাগরদিঘি’ মিথ্যা হয়ে যায় না বায়রন বিশ্বাসের বেইমানিতে।
আপনারা বায়রনকে নয়, ‘সাগরদিঘি’-র শিক্ষাকে ভাঙতে চেয়েছেন। ওহো, মহান আপনি তো কিছু জানতেনই না! আপনার ভাইপো চেয়েছে।
কেন চেয়েছে? অমিত শাহের কাছে যাই। সম্প্রতি কলকাতায় এসে দলীয় বৈঠকে বিজেপি’র এই নেতা, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী দলের নেতাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন,‘বামপন্থীরা এত বাড়ছে কী করে?’ গত কয়েকমাসে ভুল করে এক সময়ে বিজেপি-কে সমর্থন করা অনেকে লাল ঝান্ডার নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন। তৃণমূলের অনেকে, বিভিন্ন জেলায় সিপিআই(এম)’র পক্ষে এসেছেন। তৃণমূলের দুর্নীতি, অপশাসনে বিক্ষুব্ধ মানুষ এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন— বিজেপি নয়, চাই বামপন্থীদেরই। বামফ্রন্টকেই। কারণ— বিজেপি যে সিবিআই, ইডি-কে কালীঘাটে পৌঁছাতে দেবে না, চুরির মূলে আঘাত করা যে বিজেপি’র লক্ষ্য নয়— তা অনেকটা স্পষ্ট। সারদা থেকে কয়লা, বালি, চাকরি-নিয়োগ— দুর্নীতির তদন্তগুলিতে কী হয়েছে? তৃণমূলের দুর্বলতম অংশ পার্থ চ্যাটার্জি গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর অনুব্রত মণ্ডল তিহারে গেছেন।
ক্ষমতায় তৃণমূল থাকলে আর একটি অনুব্রত তৈরি হওয়া কোনও কঠিন কাজই নয়। আপনি জানেন। বিজেপিও জানে।
এই পরিস্থিতিতে জ্বলে উঠেছিলেন সাগরদিঘির মানুষ। হ্যাঁ— সাগরদিঘির গরিব, মধ্যবিত্ত। সাগরদিঘির হিন্দু, মুসলমান। সাগরদিঘির মহিলা, পুরুষ।
ভারতের ইতিহাসে সিপিআই(এম) অনেক পরীক্ষা দিয়েছে। কেন সাগরদিঘিতে কংগ্রেসের প্রার্থীকে সিপিআই(এম) সমর্থন করেছিল, কেন বলেছিল মানুষকে হাত চিহ্নে ভোট দিতে তার উত্তর আছে পরিস্থিতির পর্যালোচনায়। যখন বিপদ তৃণমূলের মতো একটি স্বৈরাচারী মারমুখী দুর্নীতি পরায়ণ দল, যখন একই সঙ্গে শত্রু সাম্প্রদায়িক বিজেপি, তখন বামপন্থীদের দায়িত্ব এই দুই শক্তির বিরোধী সব মানুষকে সমবেত করা। সাগরদিঘি প্রমাণ করেছিল এই পরিস্থিতির বিবেচনা সঠিক। দেশের পরিস্থিতির বিচারে ঠিক, রাজ্যের পরিস্থিতির বিচারে ঠিক। সাগরদিঘিতে ভোট লড়তে যাওয়ার সময়ে যতটা ঠিক ছিল, এখনও ততটাই ঠিক।
সাগরদিঘি দেখিয়ে দিয়েছিল— তৃণমূল এবং বিজেপি-কে পরাস্ত করা যায়। তৃণমূলের বিকল্প বিজেপি, আর বিজেপি-কে আটকাতে পারে শুধু তৃণমূল— এই বাইনারির প্রচার করে তৃণমূল, সঙ্ঘ ফয়দা তুলেছে ২০১৮ এবং তার পরবর্তী সময়ে। সাগরদিঘি আপনাদের সেই কৌশল চুরমার করে দিয়েছিল। কাজেই, সাগরদিঘি আসলে একটি রাজনীতিকে প্রতিফলিত করেছিল।
বায়রনের বেইমানিতে সাগরদিঘির মানুষের সাহস, লড়াই, উদ্যম মিথ্যা প্রমাণিত হয় না। বরং অভিষেকের জেরার পরই বেইমানকে তৃণমূলে টেনে নিয়ে আপনার ভাইপো প্রমাণ করেছে— ‘সাগরদিঘি’কে আপনারা ভয় পেয়েছেন। নাহলে যে আসনে ২৩ হাজার ভোটে হেরেছেন, যেখানে বিজেপি তৃতীয় হয়েছে, সেখানকার বিধায়ককে বিরোধী শিবির থেকে উপড়ে নেওয়ার এত মরিয়া ভাব কেন?
কী প্রমাণ করতে চাইলেন? তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপি-কে ছাড়া অন্য কোনও প্রার্থীকে জিতিয়ে লাভ নেই — এটাই তো? কাকে খুশি করলেন? সারা দেশে পিছু হটতে থাকা, সদ্য কর্নাটকে হারা বিজেপি-কে তো?
মাননীয়া, আপনাকে বলি— সাগরদিঘির বিধায়কের বেইমানি, আর আপনাদের নীতিহীনতা প্রমাণ করেছে ‘সাগরদিঘি’ মানে সাহস। আজকের পশ্চিমবঙ্গে, এখনও সাগরদিঘিই পথ। ‘সাগরদিঘি’ বেঁচে আছে। কারণ — তৃণমূল, বিজেপি ভয় পেয়েছে সেখানকার মানুষকে। তাঁদের সম্মিলিত রুখে দাঁড়ানোকে। বামপন্থীরা মনে করছে, নিজস্ব শক্তি বাড়াতে হবে। নিজেদের লড়াইয়ের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কিন্তু শুধুমাত্র সেটিই যথেষ্ট নয়। তার সঙ্গে এ রাজ্যের বিজেপি ও তৃণমূল বিরোধী সব অংশের সর্বোচ্চ সমাবেশের উদ্যোগও নিতে হবে। সেই পথেই লড়াই চলতেই থাকবে।
আপনি টিভি দেখুন, কিংবা না দেখুন — ‘সাগরদিঘি’-র সত্য বদলাচ্ছে না। কারণ — সাহসী মানুষ বেইমানি করে না।
Comments :0