Post Editorial

মনুবাদে বিশ্বাসী বিজেপি’র যা করার তাই করেছে রাষ্ট্রপতি হলে কী হবে, আদিবাসী তো!

উত্তর সম্পাদকীয়​

দেবেশ দাস
 

রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনে আমন্ত্রিত হননি। তা নিয়ে নানাদিক থেকে কথা উঠলেও বিজেপি পাত্তাই দিচ্ছে না সে সব কথায়, কোনও কথা বলছে না।
আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি পদ আলঙ্কারিক হলেও, তিনিই দেশের প্রথম নাগরিক, তিনিই সবচেয়ে সম্মানিত। বর্তমানে যে সংসদ ভবন আছে, তার উদ্বোধন হয়েছিল ১৯২৭ সালে, পরাধীন ভারতে তা উদ্বোধন করেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের প্রধান প্রতিনিধি ভাইসরয় তথা গভর্নর জেনারেল অব ইন্ডিয়া। তাই এটা আশা করা অস্বাভাবিক না যে সংসদ ভবনের রাষ্টপতিই উদ্বোধন করবেন।
ব্রিটিশ সরকারের আলঙ্কারিক পদ রাজা বা রানি। ইংল্যান্ডের যা সংসদ ভবন, তার নাম ওয়েস্টমিনিস্টার প্রাসাদ, সেই ভবনটি ১৮৫২ সালে উদ্বোধন করেছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া। আমেরিকার সংসদ ভবন মানে রাষ্ট্রপতি ভবন, হোয়াইট হাউস। হোয়াইট হাউসের উদ্বোধন হয়েছিল ১৮০০ সালে, করেছিলেন সে দেশের রাষ্ট্রপতি। ওখানে রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা, সে দেশে কাজে কর্মে রাষ্ট্রপতিই প্রধান। আমাদের পাশের দেশ বাংলাদেশ, সেখানে রাষ্টপতির অবস্থান আলঙ্কারিক, কিন্তু তাদের সংসদ ভবন সে দেশের রাষ্ট্রপতি উদ্বোধন করেন ১৯৮২ সালে। সাধারণত দেশে দেশে রাষ্ট্রপতিই, তাঁর পদ আলঙ্কারিক হোক বা না হোক, তিনিই সংসদ ভবন উদ্বোধন করেছেন। ব্যতিক্রম, পাকিস্তান। পাকিস্তানে ১৯৯৬ সালে ৩ নভেম্বর উদ্বোধন করেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো, রাষ্ট্রপতির সাথে তাঁর তখন টানাপোড়েন চলছে, এর তিন দিন বাদেই অবশ্য তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বরখাস্ত হন।
আমাদের দেশে অবশ্য রাষ্ট্রপতির সাথে সরকারের টানাপোড়েন নেই, তবু তাঁকে ডাকা গেল না। আদিবাসীকে রাষ্টপতি করা যায়, করার দরকার হয় সারা দেশের আদিবাসীদের মন জয় করার জন্য। কিন্তু সেই আদিবাসীকে দিয়ে অতি সম্মানের এই কাজ করানোটা যায় না। এর আগের রাষ্ট্রপতি ছিলেন রামনাথ কোবিন্দ। তিনি দলিত। তিনিও এই নতুন ভবনের যখন শিলান্যাস হয়েছিল ২০২০ সালে, সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন না।
সরকারি ট্রাস্ট বানিয়ে সরকারি উদ্যোগে অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরি হচ্ছে।  মনুস্মৃতির শ্লোক আউড়ে ২০২০ সালের ৫ আগস্ট তার শিলান্যাস উদ্বোধন করেছিলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা ছিলেন। এই রাষ্টপতি তো বিজেপি’র পছন্দ, কাছের মানুষ, কিন্তু তাঁকে আমন্ত্রণ করা হয়নি। সমস্ত দলিত বা আদিবাসী যদি কখনো উচ্চ পদে চলেও যায় বা রাজনৈতিক স্বার্থে তাঁকে কোনও উচ্চপদে বসানোও যায়, তবু তাঁকে দিয়ে অত্যন্ত সম্মানীয় কাজটি করানো যায় না।
এখন এই ধরনের ঘটনা, যেখানে তাঁর আমন্ত্রণ পাওয়াটা স্বাভাবিক, তবু তাঁকে ডাকা হচ্ছে না, তাতে রাষ্ট্রপতিকে নিশ্চয়ই কিছুটা বিড়ম্বনায় ফেলে। যে দলের জোরে একজন রাষ্টপতি নির্বাচিত হন, সেই দলের প্রতি তাঁর একটা আনুগত্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়, তা অস্বস্তির তো বটেই। মাঝে মাঝেই কিছু অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটে যায়, তখন না সেটা সওয়া যায়, না কিছু বলা যায়।
এরকম একটা অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটেছিল আগের দলিত রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের আমলে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে এই দলিত রাষ্ট্রপতি ঢুকতে গিয়ে অপমানিত হন। অপমানিত হয়ে চেপে গেলে পারতেন, কিন্তু সংবাদে প্রকাশ যে তিনি বিষয়টা নিয়ে অভিযোগ করেছেন। তিনি বিজেপি’র পছন্দের রাষ্ট্রপতি হয়ে দেশের এক নম্বর নাগরিক হলেও, তিনি যে মনুস্মৃতির কোপ থেকে মুক্তি পাবেন না, সেটা তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি। তিনি কী জানিয়েছিলেন অভিযোগে? অভিযোগ যে জানিয়েছিলেন সেটা পরিষ্কার, কারণ অভিযোগ না করলে তদন্ত হলো কেন? আর সেই তদন্ত করে সংবাদে প্রকাশ করতে হলো কেন যে কোনও কিছুই ঘটেনি।
আবার ধরুন, বর্তমান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে একগাদা বিচারপতি, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সামনে তাঁদেরকে মনে করিয়ে দিলেন যে নতুন জেলখানা বানানোর চেয়েও বেশি জরুরি উপচে পড়া জেলগুলিকে খালি করা। কী অস্বস্তিকর উপদেশ! জেলগুলিতে মোট থাকার জায়গা থেকে ৩০ শতাংশ লোক বেশি আছেন, আবার তাদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ বিচারাধীন, মানে এখনো দোষী সাব্যস্ত হননি। রাষ্ট্রপতির অজানা থাকার কথা নয়, তিনি আদিবাসীদের মধ্য থেকে রাষ্টপতি হওয়ার জন্য যে হইচই হয়েছে, সেই আদিবাসীদের অনেক মানুষ বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার কারণে বিচারাধীন, এখনো দোষী সাব্যস্ত হননি, বিনাবিচারে দিনের পর দিন জেলে পড়ে আছেন। পয়সার অভাবে অনেকে মামলা লড়তে পারেন না, জামিনও নিতে পারেন না। জেলে বিচারাধীনদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই দলিত, আদিবাসী ও মুসলমান। কোনও না কোনোভাবে মনুস্মৃতির বহমানতা আজও চলছে, যেখানে বলা হয়েছিল বিচারের অগ্রাধিকার ঠিক হবে বর্ণ দেখে (মনুস্মৃতি,  অধ্যায় ৮, শ্লোক ২৪)। রাষ্ট্রপতি বলার পরেও কি কোনও ব্যবস্থা হবে? না, ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও লক্ষণ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। তবে এটা ঠিক, কর্তাব্যক্তিরা নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপতির বক্তব্য হজম করতে পারেননি।
তবে শাসক দলের পক্ষে সবচেয়ে অস্বস্তিকর বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে দলিত রাষ্টপতিকে আর নারায়ণন ২০০০ সালে সাধারণতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে: “সাধারণতন্ত্রের পঞ্চাশ বছর পার করেও আমরা দেখছি যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার আমাদের লক্ষ লক্ষ সহনাগরিকদের কাছে একটি অবাস্তব স্বপ্ন হিসাবে রয়ে গেছে। আমাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সুফল এখনও তাদের কাছে পৌঁছায়নি।... দুঃখজনকভাবে, আমাদের অর্থনীতির বৃদ্ধি সমানভাবে হয়নি। এর সাথে বড় আঞ্চলিক ও সামাজিক বৈষম্য রয়েছে। ... দলিত ও আদিবাসীরা এসবের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। গ্রামীণ ভারতের কিছু অংশে দলিত মহিলাদের যৌন লালসার শিকার হতে হয়। ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে দ্রৌপদীর সময় থেকে আমাদের নারীদের প্রকাশ্যে বস্ত্রহানি ও অবমাননা ঘটছে। গ্রামীণ এলাকায় দলিত মহিলাদের জন্য এটি একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে” ।
প্রায় সব সময়েই রাষ্ট্রপতিরা সরকারের পক্ষেই বক্তব্য রেখে থাকেন, তবু মাঝে মাঝে দু’-একটা আলটপকা মন্তব্য বেরিয়ে পড়ে। তবে সংসদ ভবনের উদ্বোধনে বিজেপি’র রাষ্ট্রপতিকে ডাকা হয়নি অন্য কারণে। প্রধানমন্ত্রীর শুধু নিজেকেই তুলে ধরার কারণ তো আছেই।  নতুন সংসদ ভবন তৈরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, বিজেপি’র মতে রামমন্দির তৈরিও তাই। মনুস্মৃতিও মানবো, আবার উচ্চপদের দলিত বা আদিবাসীকে রামমন্দির বা সংসদ ভবন উদ্বোধনের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় ডেকে চুপচাপ তাঁর বক্তৃতা শুনবো, এ দুটো একসাথে চলে না। ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় মশগুল ব্যক্তিদের তা আত্মশ্লাঘায় আঘাত করে। এই ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে কোনও দলিত বা আদিবাসীর নাম যুক্ত হয়ে থাকুক, মনুবাদী বিজেপি কীভাবে তা চাইতে পারে? ঐতিহাসিক একটি কর্মে কোনও দলিত বা আদিবাসীকে মাহিমান্বিত করা আরএসএস আদর্শের পরিপন্থী, তিনি যেই হোন না কেন।
বিরোধীরা যতই প্রতিবাদ করুক, বিজেপি’র দিক থেকে আদিবাসী রাষ্ট্রপতিকে না ডাকাটাই অতি স্বাভাবিক ঘটনা। উদ্বোধন তো দূরের কথা, আমন্ত্রণও জানানো হয়নি, হবেও না। বিজেপি সেটাই করেছে আরএসএস’র নির্দেশে, যেটা তার দিক দিয়ে করা উচিত। শত সমালোচনা হলেও তার পক্ষে অন্য কিছু করা সম্ভব নয়।

Comments :0

Login to leave a comment