Prakash Karat

নয়া ফ্যাসিবাদকে এখনই রুখতে না পারলে সমূহ বিপদ দেশের

জাতীয় রাজ্য


 

প্রসূন ভট্টাচার্য: ডানকুনি 
২২ ফেব্রুয়ারি— মোদীর হাত ধরে আরএসএস’র পরিকল্পনামাফিক ভারতের বুকে নয়া ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে। শনিবার হুগলির ডানকুনিতে সিপিআই(এম)’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৭তম সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে এই মন্তব্য করে সতর্ক করেছেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর প্রকাশ কারাত। তিনি বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় বসেই মোদী নয়া ফ্যাসিবাদ কায়েম করার কাজে কোনও খামতি দেখাচ্ছেন না। মোদী সরকারের শরিকরা কেউ তাতে বাধাও দিচ্ছে না। এখনই তাদের রুখতে না পারলে দেশের সমূহ বিপদ।
সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে বিপদের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে প্রকাশ কারাত বলেছেন, বিজেপি চেষ্টা করেছিল এবারের লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে এসে দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে। ইন্ডিয়া মঞ্চ গঠনের মাধ্যমে বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করে সেই লক্ষ্য অর্জনে তাদের ঠেকানো গেছে। কিন্তু তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে বিজেপি সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ব কর্মসূচি রূপায়ণ কোনও খামতি দেখাচ্ছে না। নয়া উদারনীতি রূপায়ণেও তারা যে তীব্রভাবে এগতে চায় তাও এবারের বাজেটে স্পষ্ট। ট্রাম্প যেভাবে এলন মাস্ককে সরকারি ক্ষমতায় ভাগীদার করে তুলেছেন, সেভাবেই মোদীও তাঁর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের লুটের খোলা বন্দোবস্ত করে দিচ্ছেন, ট্রাম্পের কায়দাতেই প্লুটোক্রেসি আমদানি করেছেন ভারতীয় ব্যবস্থায়। তাছাড়া স্বৈরতান্ত্রিক আক্রমণে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে দখলদারি করছেন, ইউএপিএ ব্যবহার করে বিরোধীদের জেলে পুরছেন, টাকার ব্যবহার ও মিডিয়া এবং নির্বাচন কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্বাচনেও জিতছেন। 
এটাকেই নয়া ফ্যাসিবাদের উত্থান হিসাবে বর্ণনা করে কারাত বলেছেন, চরম দক্ষিণপন্থীরা বিশ্বজুড়ে একই কায়দায় চলছে না, তাদের মধ্যে কেউ কেউ গত শতকের তিনের দশকের নাৎসিদের, কিংবা ইতালির মুসোলিনির মতো ক্ষমতা দখল করতে চাইছে। কিন্তু নয়া ফ্যাসিবাদীরা সংসদীয় ব্যবস্থার বৈধতাকে খাতায় কলমে জিইয়ে রেখেই ক্ষমতা দখল করে। ভারতে আরএসএস সেই নয়া ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটাচ্ছে, এখনই সতর্ক হয়ে তাকে থামাতে হবে। ভারতের মোদী সরকারকে বিশ্বব্যাপী চরম দক্ষিণপন্থীদের অংশ হিসাবে চিহ্নিত করে প্রকাশ কারাত বলেছেন, ‘ট্রাম্পইজম’ অনুসরণ করছেন ভারতে মোদী। 
এদিন সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত উল্লেখ করে প্রকাশ কারাত বলেছেন, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদে ফের বসেই ট্রাম্প এমন সব সিদ্ধান্ত ঘোষণা শুরু করেছেন যাতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মধ্যে স্তিমিত দ্বন্দ্ব নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে, বিশ্বে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। সেই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলির দ্বন্দ্ব এবং সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছে। গাজায় মানুষকে উৎখাত করে দখলের মন্তব্য করে কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের জাত্যভিমানের পক্ষ নিয়ে সেদেশে সব সাহায্য বন্ধের ঘোষণা ট্রাম্প বুঝিয়ে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশের দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। অন্যদিকে, চীনের বিরুদ্ধে মাশুল এবং বাণিজ্য যুদ্ধের হুমকি দিয়ে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সংঘাত তীব্র করার ইঙ্গিতও দিচ্ছে। এটাই বিশ্ব রাজনীতিতে ‘ট্রাম্পইজম’র প্রভাব। 
নয়া উদারনীতির সঙ্কটে কীভাবে নয়া ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশ কারাত। তিনি বলেছেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কোথাও গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের ফ্যাসিবাদের উত্তরসূরি হিসাবে, আবার কোথাও অন্য রূপে নয়া ফ্যাসিবাদ মাথা তুলছে। তবে এর মানে এই নয় যে বামপন্থীরা পরাস্ত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। ব্রাজিল, কলম্বিয়া, উরুগুয়ে, মেক্সিকো এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কাতে বামপন্থীরা সরকারে আসীন হয়েছে। তবে বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদী মদতে দক্ষিণপন্থী ইসলামিক মৌলবাদীরা ক্ষমতায় বসেছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ধারণাকে আক্রমণ করছে। 
কারাত বলেছেন, ভারতে এবং বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-আরএসএস বাংলাদেশের ঘটনা ঘিরে যে প্রচার করছে তা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাঁচাতে নয়, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের আক্রমণ করতে। 
তিনি বলেছেন, গত লোকসভা নির্বাচনের আগে ইন্ডিয়া মঞ্চ গঠনের মধ্য দিয়ে বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করে বিজেপি’র সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন ঠেকানো গেছে। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির বৃহত্তর ঐক্য এর জন্যই জরুরি। কিন্তু সিপিআই(এম)’র স্বাধীন শক্তি বৃদ্ধি ও বামপন্থীদের শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি রয়েছে। আরএসএস’এর সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ এখন দেশের নানা প্রান্তে জনভিত্তি পেয়েছে, এই আদর্শের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে সিপিআই(এম)’র স্বাধীন শক্তি ও বামপন্থীদের শক্তিশালী করা প্রয়োজন। 
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রসঙ্গে বামশক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে কারাত বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট ও বাম আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সবসময়েই সারা দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখনকার পরিস্থিতিতে এরাজ্যে বিজেপি এবং তৃণমূল দুয়ের বিরুদ্ধেই বামপন্থীদের যমজ লড়াই করতে হচ্ছে, কারণ দেশে বিজেপি’র ‘কমিউনাল-কর্পোরেট’ শাসনের মতো এরাজ্যে ‘করাপ্ট-ক্রিমিনাল’ শাসন চলছে, বামপন্থী কর্মীরা হিংসাত্মক আক্রমণের মুখে পড়ছে। তার মধ্যেও বিগত তিন বছরে এরাজ্যে সিপিআই(এম) শ্রেণি ও গণসংগ্রাম সংগঠিত করতে অগ্রগতি ঘটিয়েছে। বিশেষত আর জি কর আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকার জন্য আপনাদের অভিনন্দন জানাই।
একই সঙ্গে গ্রামের গরিব শ্রমজীবী মানুষ এবং নতুন প্রজন্মকে পার্টি সংগঠনে আরও বেশি করে টেনে এনে গণআন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করার আহবান করেছেন প্রকাশ কারাত। তাঁর উদ্বোধনী ভাষণের মধ্য দিয়ে এদিন রাজ্য সম্মেলনের প্রতিনিধি অধিবেশন শুরু হয়েছে। এরপরে খসড়া রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ করেছেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। এর আগে সম্মেলন স্থলে প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা বিমান বসু পার্টির রক্তপতাকা উত্তোলন করেছেন এবং তারপরে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর প্রকাশ কারাত সহ নেতৃবৃন্দ শহীদ বেদীতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন। রাজ্য সম্মেলনে সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য মানিক সরকার, বৃন্দা কারাত, সূর্য মিশ্র, এম এ বেবি, তপন সেন, অশোক ধাওয়ালে, নীলোৎপল বসু, রামচন্দ্র ডোম প্রমুখ নেতৃবৃন্দও উপস্থিত রয়েছেন। সম্মেলন মঞ্চের নামকরণ হয়েছে কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি মঞ্চ এবং সম্মেলনস্থলের নামকরণ হয়েছে কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নগর।

 

Comments :0

Login to leave a comment