RSS BENGALI CULTURE

বাঙালির সমন্বয়ী লোকাচারকে ধ্বংস করাও কৌশল আরএসএস’র

রাজ্য বিশেষ বিভাগ

অলঙ্করণ: মনীষ দেব

গৌতম রায়
লোকসভা ভোটকে লক্ষ্যবস্তু ধরে পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক প্রযুক্তির কাজে এই মুহূর্তে আরএসএস’র সব থেকে বড়ো টার্গেট বাংলার যুব সমাজ। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর অসম্পূর্ণ রামমন্দিরের উদ্বোধন ঘিরে গোটা দেশে উন্মাদনার পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। সরকারকে ব্যবহার করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের তাকে উন্মত্ত চেহারায় প্রতিষ্ঠিত করাই গুরুত্বপূর্ণ গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের কাছে।
এই উন্মত্ততার প্রয়োগে পশ্চিমবঙ্গে এখন সঙ্ঘের সব থেকে বড়ো লক্ষ্য হলো বাঙালির সংস্কৃতি। যেটি বহু শতাব্দী ধরে হিন্দু- মুসলিম, উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের যৌথ সমন্বয়ী সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত। সেই ধারাকে বিনষ্ট করে উত্তর ভারতের নিজেদের পছন্দের সামাজিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে তারা বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গীভূত করবার জন্যে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছে।
হিন্দু বাঙালির সামাজিক অনুষ্ঠানগুলিতে, যেমন বিবাহ ইত্যাদিতে, যে প্রচলিত লোকাচারের রেওয়াজ বহুকাল ধরে চলে আসছে, সেখানে বাঙালি লোকাচারগুলিকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করে সেই জায়গাতে উত্তর ভারতের হিন্দু লোকাচারগুলিকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। হিন্দু বাঙালির বিবাহে দধি মঙ্গল থেকে শুরু করে কড়ি খেলার মতো লোকাচারের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের বিবাহের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান পালনের ধারা একাত্ম হয়ে গেছে। কলাগাছ দিয়ে ছাদনাতলা সাজানোর মত রীতি, নানা ধরণের বিবাহ জনিত মেয়েদের গান। 
আরএসএস তাদের নিজস্ব সামাজিক প্রযুক্তির ভিতর দিয়ে হিন্দু- মুসলমানের যৌথ সাংস্কৃতিক প্রবাহ থেকে বাঙালি হিন্দুকে বের করে আনার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। তার ফসল হিসেবেই এখন একটু বিত্তবান হিন্দু বাঙালির বিবাহ ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে ধর্মীয় প্রথার বাইরে যে লোকাচারের প্রচলন ছিল, স্ত্রী আচারের প্রচলন ছিল- সেগুলিকে ধীরে ধীরে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গাতে উত্তর ভারতের হিন্দি সংস্কৃতির অঙ্গ, মেহেন্দি। রঙ্গোলি ইত্যাদি বিষয়, যেগুলির সঙ্গে প্রচলিত বাঙালি লোকাচারের, স্ত্রী আচারের এতটুকু সম্পর্ক নেই, সেগুলিকেই বাঙালির বৈঠকখানায় প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে।
বাঙালি সংস্কৃতিতে যে সমন্বয়ীধারা আছে , সেটির পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে রাজনৈতিক হিন্দু সংস্কৃতিকে এখন বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে তুলে ধরতে চায় আরএসএস। সমন্বয়ী সংস্কৃতির ধারাতে হিন্দু- মুসলমান, উভয়ের সামাজিক রীতিনীতি, সাংস্কৃতিক ধারাপ্রবাহের যেহেতু মিশ্রণ আছে, তাই সঙ্ঘ ঘরানার হিন্দু সংস্কৃতি, মুসলমান প্রভাব মুক্ত হোক- এটাই হলো হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক টার্গেট। এই লক্ষ্যে সাফল্য অর্জন করতে পারলে আসন্ন লোকসভার ভোটে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ঝুলি অনেকটা ভরাবে বলে মনেও করছে। 
সেই ভাবনা থেকেই ২০১৯’র লোকসভা ভোটে , এই রাজ্য থেকে বিজেপির অভাবনীয় সাফল্য পাওয়ার পর, গত পাঁচ বছর ধরে বাঙালি সংস্কৃতি, যা হিন্দু- মুসলমানের যৌথ সংস্কৃতি হিসেবেই বাংলার বুকে প্রবাহমান কাল ধরে প্রচলিত, সেই ধারাকে ধ্বংস করে , উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী হিন্দুদের যে সামাজিক বৈশিষ্ট্য, সেগুলিকে বাঙালির সংস্কৃতি হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বাঙালি সংস্কৃতির ভিতরে, হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সাধনার ধারাটিকে আরএসএস যে অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক ভেঙেচুরে তছনছ করে দেওয়ার উপক্রম করছে, এই বিষয়টি কিন্তু বাঙালি সমাজ খুব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না। যে সমস্ত  বাঙালি পরিবার, যারা কোনো অবস্থাতেই কোনোরকম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি মানসিক ভাবে সহানুভূতিশীল নন, সেই ধরণের পরিবারগুলিতেও বাঙালি সংস্কৃতির যে পরম্পরা, সেগুলো ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে, সেই জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে, উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী মানুষের সামাজিক রীতিনীতির নানা ধরনের আঙ্গিক। খাঁটি হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি হিসেবে যে ধরনের সাংস্কৃতিক ভাবধারা বা বিনোদনকে আরএসএস স্বীকৃতি দেয়, সেগুলি ক্রমশ বাঙালি জীবনে অঙ্গীভূত হয়ে চলেছে। 
বহু প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আরএসএসের এই আঘাত, যা ক্রমে বাঙালির বৈঠকখানাকে অতিক্রম করে একেবারে শয়নকক্ষে ঢুকে যাচ্ছে, বুঝে উঠতে পারছেন না। সাম্প্রদায়িক মানসিকতার অনুপ্রবেশ ঘটানোর এই তৎপরতা তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না। অদ্ভুতভাবে প্রবাহমান বাঙালি সংস্কৃতির সামাজিক আচারগুলি, যার সঙ্গে বাংলা-বাঙালির আর্থ-সামাজিক নানা ধরনের খুঁটিনাটির অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক ছিল, সেই সমস্ত বিষয়গুলিকে ব্রাত্য করে, সেগুলিকে বর্জন করে, 'রঙ্গোলি',' মেহেন্দি ' ইত্যাদি এই যে উত্তর ভারতের প্রথাকে ধীরে ধীরে বাঙালি র সামাজিক জীবনের অঙ্গ করে তোলা হচ্ছে।
এই বিষয়গুলিকে বহু সচেতন, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষও আদৌ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখছেন না। সাধারণ বিনোদনের একটা উপকরণ হিসেবে দেখছেন। কিন্তু এই বিনোদনের দুনিয়াতেও কিভাবে বিভাজনের রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে, সে সম্পর্কে যদি আমরা এখনই সচেতন না হই , তাহলে বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সংস্কৃতির প্রবাহমানতা, যা বাঙালি জীবনকে সঞ্জীবিত রেখেছে, সেই ধারার অপমৃত্যু ঘটতে বাধ্য।
আসন্ন লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে রাজনৈতিক বিভাজনের যে পদ্ধতি আরএসএর রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি চালাচ্ছে সেটির থেকে আরএসএসের বিভিন্ন ধরনের শাখা সংগঠনের দ্বারা সংগঠিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিভাজনের মাত্রা কোনো অংশে কম ক্ষতিকারক নয়। সাংস্কৃতিক বিভাজনের ভেতর দিয়ে বাঙালিকে শুধু হিন্দু মুসলমানের যে বিভাজিত করছে আরএসএস তা নয় ।
বাংলার বাইরে বাঙালি হিসেবে মানুষের পরিচয় যেভাবে, 'বাংলাদেশের নাগরিক ' হিসেবে দেখিয়ে এনআরসির পথকে মসৃণ করবার চেষ্টা করছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি, ঠিক সেইভাবেই  'অনুপ্রবেশ'-র বিষয়টিকে ঘিরে একটা ভয়ঙ্কর আগুন নিয়ে খেলা খেলে ভোট রাজনীতিতে সাফল্য পেতে চায় হিন্দুত্ববাদী শক্তি।

Comments :0

Login to leave a comment