‘জব মুল্লে কাটে জায়ঙ্গে রাম রাম চিল্লায়েঙ্গে, জব শূয়োর কাটে জায়েঙ্গে রাম রাম চিল্লায়েঙ্গে, হিন্দুস্তান মে রহনা হোগা জয় শ্রী রাম কহনা হোগা’।
কয়েকদিন আগেই গেরুয়া পতাকাধারীদের মিছিল থেকে এমন হুঙ্কারই শোনা গিয়েছে দিল্লির সংসদ মার্গ থানার সামনেই। অবশ্য শুধু দিল্লি নয়, রামমন্দির উদ্বোধনকে ঘিরে এমন হুমকিই ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে গোটা দেশে। এমনিতেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দাপদাপানিতে ভারতের মুসলিমরা কেমন কুঁকড়ে গিয়েছেন। একারণেই ২২ জানুয়ারি রামমন্দির উদ্বোধনের দিন ‘স্বঘোষিত কারফিউ’ ঘোষণা করে বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বহু মুসলিম। উত্তর, মধ্য কিংবা পশ্চিম ভারতে বসবাসকারী মুসলিমরা আর নিজেদের তেমন নিরাপদ মনে করতে পারছেন না গেরুয়া তাণ্ডব জেরে।
রামমন্দির উদ্বোধনকে ঘিরে পূর্ণোদ্যমে ধর্মীয় জিগির তোলা শুরু হয়ে গিয়েছে বহু দিন আগেই। রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা যত এগিয়ে আসছে উন্মাদনার পারদও চড়ছে। আর ততই নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে ভাবতে শুরুও করেছেন এদেশের মুসলিমরা। দিল্লি সহ উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা এবং মধ্য প্রদেশের মুসলিম মহল্লাগুলি বস্তুত চাপা সন্ত্রাসের শিকার। গেরুয়া ফেট্টিধারীদের বাইক, ট্রাকে বা জিপে চড়ে বড় বড় মিছিল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহর জুড়ে। মুখে জয় শ্রী রাম স্লোগান, চেহারায় আক্রমণাত্মক ভঙ্গি। দিল্লির ঐতিহাসিক জামা মসজিদের কাছের ঘাটা মসজিদের সামনে দিয়ে কয়েকদিন আগেই পেরিয়ে গেল সেই ধর্মোন্মাদদের মিছিল। এমনকি জয় শ্রী রাম ধ্বনির দাপটে সন্ধ্যার নমাজও কার্যত বন্ধ করে দিতে হয়। আবার খান মার্কটের সামনে লাউডস্পিকারে সমানে বেজে চলেছে রামধূন। পান্ডারা রোডের মতো বহু মসজিদেই সকাল-বিকালের প্রার্থনায় জনসমাগম চোখে পড়ছে কম। বাড়িতেই নমাজ পড়ে নিচ্ছেন অধিকাংশ।
এ দৃশ্য শুধু দিল্লি নয়, গোটা উত্তর ভারতেই চোখে পড়ছে। উত্তরাখণ্ডের রাজধানী শহর দেরাদুনে ওল্ড ক্লক টাওয়ারের মাথা থেকে নিচ পর্যন্ত মুড়ে দেওয়া হয়েছে রামের ছবি আঁকা কাপড়ে। ওই শহরেরই পুরোলায় মুসলিমদের দোকানের সামনে ‘ক্রশ’ লাগিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। অনেক দোকানদারই আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিলেন। কেউ কেউ ফিরে এলেও অনেকেই আসেননি। হয়তো মন্দির উদ্বোধনের পর কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরলে এসে দোকান খুলবেন আবার! উত্তর প্রদেশের মীরাটে বাড়ির গুরুজনদের কথা শুনে বহু মুসলিম যুবক ট্রেনের টিকিট কেটেও বাতিল করে দিয়েছেন রামমন্দির উদ্বোধনের আশপাশের দিনগুলিতে। বিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অনেক জায়গায় বা হলেও পালিত হচ্ছে সাদামাটাভাবে। আতঙ্ক এতটাই যে রামমন্দির উদ্বোধনের দিন রাস্তাঘাটে বেরনো কিংবা বাসে-ট্রেনে চড়বেন কী না—তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন মুসলিমরা। তাঁরা যে মুসলিম, সেই পরিচয় গোপন রাখতেই বাড়িতে থাকা শ্রেয় মনে করছেন অনেকে। মুম্বাইয়ের এক মুসলিম যুবকের খেদ, ‘‘যখন সরকার পক্ষে থাকে তখন অপরাধও উৎসবের চেহারা নেয়।’’
নয়ডায় মুসলিম মহল্লার আশাপাশে অথবা প্রবেশের মুখে ঢাউস ঢাউস রামের ছবি টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। দু’জনের দেখা হলে এখন আর ‘নমস্কার’ নয়, প্রীতি বিনিময় চলছে ‘জয় শ্রী রাম’ বলে। মুম্বাইয়ে যেমন রাস্তাঘাট ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে আলোর রোশনাইয়ে। বড় বড় গেরুয়া পতাকা, রামের ছবি ভরা বিশালাকৃতির ব্যানার ভরে গিয়েছে। বিলবোর্ড-এ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানো হচ্ছে রামের ছবি দিয়ে। দিল্লিতে ২২ জানুয়ারি সমস্ত মাংস বিক্রির দোকান বন্ধ রাখা হচ্ছে। কয়েকটি আমিষ রেস্তোরাঁ সেদিনের জন্য শুধুই নিরামিষ খাদ্য পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবার শনিবারই দিল্লির বাবর রোড লেখা ফলকের ওপর অযোধ্যা মার্গ লেখা পোস্টার সেঁটে দিয়েছে হিন্দু সেনারা।
এমনিতে দিল্লির তখতে নরেন্দ্র মোদী বসার পর থেকেই সঙ্ঘের দাপট বাড়তে শুরু করে। দেশের বহুত্ববাদী চরিত্রকে নষ্ট করে নিজেদের পছন্দমাফিক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জোর করেই। মুসলিম পড়ুয়ারা স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন, তাঁদের গোরুর মাংস খাওয়ার অভ্যাসও পালটে দেওয়ার হুমকি চলছে। মোদীর ভারতে তাঁরা যেন ভারতীয় নন, অন্য কোনও দেশের বাসিন্দা— এতটাই বিচ্ছিন্ন মনে করছেন নিজেদের। রামমন্দির উদ্বোধনকে ঘিরে সেই আতঙ্ক যেন আরও বেশি করে গ্রাস করছে তাঁদের।
আবার মহারাষ্ট্রের যবতমালের ছবিটা আরেক রকম। এই সেই যবতমাল— যেখানে কৃষির প্রবল সঙ্কটে ঋণের দায়ে আত্মঘাতী হয়েছেন ৫,৮০০ কৃষক। কয়েকদিন যাবত সেই যবতমাল জেলার গ্রামগুলিতে গোলকধাঁধা রাস্তা পেরিয়ে ঢুকছে একের পর এক ট্রাক। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য কোনও ত্রাণ নয়, উলটে রামের বড় বড় ছবি, পোস্টার লাগানো ট্রাকগুলি ঢুকে যাচ্ছে গ্রামের প্রত্যন্ত প্রান্তে। ট্রাকের সওয়ারিরা দেনায় দীর্ণ কৃষকদের কাছ থেকেই চাইছেন খাদ্যশস্য। ট্রাকে ভরে ওই খাদ্যশস্য পাঠানো হবে অযোধ্যায়, যেখানে রামমন্দির উদ্বোধনে আসছেন গোটা দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ। গরিব কৃষকদের থেকে ‘দান’ হিসাবে খাদ্যশস্য নিয়ে পেট ভরানো হবে ‘ভক্তবৃন্দকে’। এই ট্রাকগুলি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।
সবমিলিয়ে মন্দির উদ্বোধনকে ঘিরে বহুত্ববাদী, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী ভাষ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। জিগির তুলে স্পষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে, ‘এই উন্মাদনায় শামিল হও, নাহলে একঘরে হয়ে থাকো’।
RAM MANDIR MINORITY
গেরুয়া তাণ্ডবে ক্রমশ নিজেদের ‘একঘরে’ মনে করছেন মুসলিমরা
×
Comments :0