জয়তী ঘোষ
সাধারণ ভাবে ধরে নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় বাজেট শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকৃত ও প্রস্তাবিত রাজস্ব সংগ্রহ ও বরাদ্দের পরিকল্পনাই নয়, সরকারের মোদ্দা অর্থনৈতিক নীতিরও প্রতিফলন। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এবারের বাজেটের ইঙ্গিত ভয়াবহ। মনে হচ্ছে, মোদী সরকার ধরেই নিয়েছে, এমনকি নির্বাচনী বছরেও, নির্বাচনে জেতা যায় বিপুল অংশের জনগণের বাস্তব জীবনের উন্নতি না ঘটিয়েও। এমনকি তাদের দুর্দশাকে স্রেফ অস্বীকার করেও। ( ধরে নেওয়া যেতে পারে আগামী নির্বাচনের জন্য অন্য রণকৌশল ব্যবহৃত হবে)।
অর্থনৈতিক সমীক্ষাতেই দেখা গেছে সরকার ভারতের জনগণের বিপুল অংশের বাস্তব জীবন সম্পর্কে হয় অজ্ঞ বা তা উপেক্ষা করছে। মোট কর্মসংস্থানের হার ইতিহাসে সবচেয়ে নিচুতে, সংগঠিত কর্মসংস্থান কমছে, এমনকি তথ্য প্রযুক্তির মতো ‘গতিশীল’ ক্ষেত্রেও কাজ খোয়া যাচ্ছে, দু’বছর আগের তুলনায় টাকার অঙ্কে মজুরি কমে গেছে, সরকারি সমীক্ষাতেই আতঙ্ক ধরানোর মতো পুষ্টি সংক্রান্ত তথ্য আসছে, মাইক্রো স্তরের সমীক্ষায় চূড়ান্ত ক্ষুধার প্রকৃত প্রমাণ উঠে আসছে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রকের কাছে এইসবের যেন কোনো অর্থই নেই। বেছে বেছে তথ্য নিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে ২০১৪-র পর থেকে (এবং তার আগে বাজপেয়ী সরকারের ১৯৯৯-২০০৪ পর্বে) বহু চ্যালেঞ্জের মুখে ভারতীয় অর্থনীতির স্বর্ণযুগ ছিল। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, ‘সব চাঙ্গা সি’। আমাদের একমাত্র চিন্তা হলো বিশ্ব অর্থনীতির সমস্যা থেকে আমরা কীভাবে নিজেদের নিরাপদ রাখব, কেননা আমাদের নিজেদের তো কোনো সমস্যাই নেই।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে রাখা দরকার। কেন্দ্রীয় বাজেটে উল্লিখিত ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের প্রস্তাবিত ঘোষণা এবং চলতি অর্থবর্ষ ২০২২-২৩-এর ‘সংশোধিত হিসেব’ সন্দেহজনক। চলতি অর্থবর্ষের প্রাথমিক সংখ্যা এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত, ২০২৩-এর জানুয়ারির সংখ্যা অর্থ মন্ত্রকের কাছেও নেই। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে এখনও কিছু ঘটেইনি। বছরের শেষ ত্রৈমাসিকের হিসেব যেহেতু এখনও অজ্ঞাত অর্থমন্ত্রকের পুরো বছরের হিসেব করতে ইচ্ছামতো অত্য ঢুকিয়ে দিতে পারে। রাজস্ব সংগ্রহ, ব্যয় ও কোষাগারীয় ঘাটতি সম্পর্কে নিজেদের পছন্দমতো সংখ্যা ঘোষণা করে দিতে পারে। আগামী বছরের জন্যও যে কোনো সংখ্যা ঘোষণা করে দিলেই হলো।
এটি সত্ত্বেও ২০২৩-২৪’র বাজেটে যে সব সংখ্যা বলা হয়েছে কম করে বললে তাকে বিস্ময়কর বলা চলে। দীর্ঘদিন অবশ্য প্রয়োজনীয় সামাজিক বরাদ্দে এমন নির্মম ছাঁটাই আমরা দেখিনি। দু’দশকে তো নয়ই। কর্মসংস্থান যখন কমছে এবং বিশেষ করে গ্রামীণ দরিদ্রদের প্রকৃত মজুরি কমে আসছে তখন রেগার বরাদ্দ চলতি বছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে দেওয়া হলো। তা মাত্র ৬০ হাজার কোটি টাকায় এসে ঠেকেছে। পিপলস অ্যাকশন ফর এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি হিসেব করে দেখিয়েছে আগামী বছরে যদি এ বছরে যারা কাজ করেছে তাদেরও ১০০ দিনের কাজ দিতে হয় তাহলে অন্তত ২,৭২,০০০কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। বাজেটে বরাদ্দ টাকা এই প্রয়োজনের এক-পঞ্চমাংশ।
অপুষ্টি ও ক্ষুধার পরিপ্রেক্ষিতে এমনই মারাত্মক খাদ্য ভরতুকি প্রায় এক তৃতীয়াংশ হ্রাস করা। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনে বরাদ্দ বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় কিছুই না, তার অর্থ প্রকৃত বরাদ্দ হ্রাস হচ্ছে, মাথাপিছু ব্যয়ে আরো বড় হ্রাস হচ্ছে। বহুঘোষিত সরকারি স্বাস্থ্য বিমা পিএম স্বাস্থ্য সুরক্ষা যোজনায় চলতি বছরে বরাদ্দ হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু মাত্র ৮২৭০ কোটি টাকা খরচ করতে পেরেছে। আগামী বছরের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৩৩৬৫ কোটি টাকা! তাহলে ইতিমধ্যেই এই বিমার অধীনে যাঁরা রয়েছেন সেই দুর্ভাগাদের কী হবে? তাঁদের ‘বিমা’ কি স্রেফ লোপাট হয়ে যাবে?
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ মহামারীর সময়ে যে ক্ষতি হয়েছে তা সামলাতে স্কুল শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়িয়েছে। ভারত সরকার তা করেনি। তার পরিবর্তে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ৬৩৪৪৯ কোটি টাকার যে বাজেট অনুমান করা হয়েছিল সেখানো পৌঁছানো যায়নি, ৪৩৯৬ কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে। এই বছরের বাজজেটে ৫৩৬৫ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে যা আবারও বড়জোর প্রত্যাশিত মুদ্রাস্ফীতির সমান। উচ্চশিক্ষায় মাত্র ৩২৬৭ কোটি টাকা বৃদ্ধি হয়েছে, প্রকৃত অর্থে বৃদ্ধি হয়নি।
অর্থমন্ত্রী কৃষি নিয়ে বহু কথার বিস্তার ঘটিয়েছেন। কিন্তু কৃষির মোট বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রেও তাই। কিছু ক্ষেত্রে হ্রাস খুবই লক্ষণীয়। বাজারের দাম যখন একটি নির্দিষ্ট ন্যূনতম স্তরের নিচে নেমে যায় তখন কৃষকদের দাম পেতে সহায়তা করার জন্য ঢাকঢোল বাজিয়ে বাজারে হস্তক্ষেপের একটি প্রকল্প কয়েক বছর আগে ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রকল্পে বরাদ্দ ১৫০০ কোটি টাকা থেকে কমে ১ লক্ষ টাকা হয়েছে ( ঠিকই পড়ছেন, মুদ্রণ প্রমাদ নয়!)। অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন পিএফ কিসানে প্রতি কৃষকপিছু ৬ হাজার টাকার বদলে ৮ হাজার টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু টাকা বরাদ্দ আগেও ছিল ৬০ হাজার কোটি, এবারও তাই।
Comments :0